পাকিস্তান: একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির পরিণতি
- মো. নিজাম উদ্দিন
- প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২২, ০৩:৪০ PM , আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২২, ০৪:০৭ PM
এক.
সমস্যা সমাধানের রাজনীতি করার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানের রাজনীতিতে অভিষেক ঘটে ইমরান খানের।পাকিস্তানকে ক্রিকেট বিশ্বকাপ উপহার দিয়েছেন বিশ্বের অন্যতম এই অলরাউন্ডার। খুব সহজ করে বললে ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির মূল লক্ষ্য একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ওয়েলফেয়ার স্টেট। পাকিস্তানের রাজনীতিতে বেলাওল ভুট্টোর পিপলস পার্টি ও নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচীর তুলনায় ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির রাজনৈতিক কর্মসূচী ছিল পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন কিছু করা।
আরও পড়ুন : যাদের গুলিতে প্রীতি মারা গেছে তাদের মনটা খুব খারাপ
যার জন্য প্রতিষ্ঠার মাত্র চব্বিশ বছরের মাথায় ইমরান খানের তেহরিক ই ইনসাফ পার্টি পাকিস্তানের মতো একটি রাষ্ট্রের ক্ষমতায় চলে আসে,যেখানে পিপলস পার্টি এবং মুসলিম লীগের মত প্রভাবশালী দল রয়েছে। লড়াইটা সহজ ছিল না ইমরান খানের জন্য। শুরুতে তিনি পাকিস্তানের প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর সমর্থন পেলেও পরিস্থিতি তার পক্ষে থাকেনি। গত মার্চের ৮ তারিখে পাকিস্তানের বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলো বিশেষ করে নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগ, বিলওয়াল ভুট্টোর পিপলস পার্টি এবং মাওলানা ফজলুর রেহমানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ইমরান খানের বিরুদ্ধে পাকিস্তান পার্লামেন্টে অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার অভিযোগে অনাস্থা প্রস্তাব জমা দেয়।অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও শাসনতন্ত্রের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করলেও ইমরান খানকে মূলত তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির জন্যই মূল্য দিতে হয়েছে।
দুই.
বিশ বছরের একটি অসম যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে মার্কিনীরা যখন পাকিস্তানের প্রতিবেশী একটি দেশ থেকে বিদায় নেয়,ইমরান খান সেই সময় সেখানে তার রাজনৈতিক অবস্থান আরও শক্তিশালী করেন। নতুন আ/ফ/গান সরকারের বিষয়ে ইমরান খান, চীন এবং রাশিয়ার অবস্থান এক মেরুতে এসে দাঁড়িয়ে যায়। আমেরিকা এই বিষয়টিকে সহজ ভাবে নেওয়ার কোনো কারণ দেখিনা।
ইমরান খানের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জিং ঘটনা হল- পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স বা আইএসআই এর ডিজি নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক। আইএসআই এর ডিজি কে হবেন? এটা নিয়োগ দেওয়ার এক্তিয়ার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু হঠাৎ করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান ঘোষণা দিয়ে বসেন পরবর্তী আইএসআই এর প্রধান কে হবেন?
আরও পড়ুন : বুয়েট-কুয়েট থেকে বিসিএসে প্রথম: শ্রম, সময় ও রিসোর্সের অপচয়
বিষয়টি ছিল ইমরান খানের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।এক পর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধানের প্রস্তাবিত ব্যক্তিকেই ইমরান খান আইএসআই এর প্রধান নিয়োগ করতে বাধ্য হন। এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে ডিজি নিয়োগের পর থেকে ইমরান খানের সাথে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সম্পর্ক আর স্বাভাবিক থাকেনি। বর্তমান রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ আমার কাছে ঐসব ঘটনার একটা ধারাবাহিক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া মনে হয়।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও আইএসআই সরকারের ভেতরে আরেকটা সরকারের মতো,যা সরকারের চেয়েও শক্তিশালী।রাষ্ট্রের ভেতরের এই রাষ্ট্রকে (ডিপ স্টেট) খেপিয়ে অতীতেও পাকিস্তানে কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ১৯৪৭ সালের পর থেকে পাকিস্তানের কোনো সরকারই কেন তার পুরো মেয়াদ শেষ করতে পারেনি? এই প্রশ্নের সঠিক জওয়াব হতে পারে সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্কের অবনতি।
তিন.
পাকিস্তানের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে নতুন সরকার গঠনের ফলে ভারতের অবকাঠামোগত বিশাল বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়ে। সেখানে মার্কিন ও ভারতীয় স্বার্থ এক জায়গায় এসে দাঁড়ায়। যার প্রতিপক্ষ ব্যক্তিটির নাম ইমরান খান। দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকা এমন একজন ব্যক্তিকে সমর্থন করতে পারে না যে চীন-রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যে ভারতের ঘোর বিরোধী। যে আমেরিকাকে এভয়েড করে চলে।আমার তো মনে হয় দক্ষিণ এশিয়ায় ইমরান খানের প্রভাব ঠেকানোও এই ঘটনার একটা কারণ হতে পারে। চীন ও রাশিয়ার সমর্থনে ইমরান খানের উত্থান কিভাবে মেনে নিবে আমেরিকা?
যখন বিশ বছরের এক লড়াইয়ে পরাজয়ের গ্লানিই শুকায়নি? ইমরান খান তার বক্তৃতায় বলেছেন একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে হুমকি দিয়ে তাকে চিঠি দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রটি যে আমেরিকা তাও তিনি মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন।যদিও আমেরিকা এই অভিযোগ নাকচ করেছে।ইমরান খানের বিপদের সবচেয়ে বড় কারণ সম্প্রতি তার মস্কো সফর। তিনি এমন এক সময়ে রাশিয়া গেলেন যখন রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন শুরু করে।
আরও পড়ুন : সুপেয় পানি, সুশাসন এবং টেকসই উন্নয়ন: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
রাশিয়া ইউক্রেনের ভেতর ডুকে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা করে। পূর্ব নির্ধারিত হলেও এই সফর আমেরিকা সহ পাশ্চাত্য দুনিয়াকে ইমরান খানের প্রতি আরও খেপিয়েছে।জাতিসংঘ রাশিয়ার উপর ইউক্রেনে হামলার জন্য নিন্দা প্রস্তাব আনলেও ইমরান খানের সরকার ভোট দানে বিরত থাকে।পাশ্চাত্য রাষ্ট্র গুলোর ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধের চিঠিকেও খুব একটা পাত্তা দেননি ইমরান খান।যার জন্য চীন রাশিয়াকে বন্ধু বানাতে গিয়ে পর্যায়ক্রমে বেশ বড় একটি শক্তিকেই শত্রু বানালেন।পরিণতি যা হওয়ার তাই হল!
চার.
এতদিন পাকিস্তান -আমেরিকা ও চীনের সাথে ভারসাম্য পূর্ণ বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রেখে চললেও ইমরান খান একটি স্বতন্ত্র পররাষ্ট্রনীতি (Independent Foreign policy) গ্রহণ করেন। যার মূলে রয়েছে আমেরিকা থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে চীন ও রাশিয়ার আরও কাছে চলে আসা। এটাই কাল হল।তার এই সিদ্ধান্ত সঠিক নাকি ভুল সেই রায় দেওয়ার সময় আসেনি। ইমরান খানের মার্কিন বলয় থেকে সরে আসা পাকিস্তানের বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলোকে বাড়তি সুবিধা দেয়।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সাথে আমেরিকার সম্পর্কও পুরনো। ইমরান খান রাশিয়ার পক্ষে থাকার পরেও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান সম্প্রতি একটি রাজনৈতিক বক্তৃতা করেছেন যার মূল বক্তব্য এমন যে, পাকিস্তান ইউক্রেনের পাশেই আছে! যা সরাসরি একটি সিভিল গভর্নমেন্টকে চ্যালেঞ্জ করার সমান। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল আমেরিকা, পাকিস্তান সেনাবাহিনী, আইএসআই এবং পাকিস্তানের বিরোধী দল গুলোর স্বার্থ এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে যা হচ্ছে একপাশে ইমরান খান আর অন্য পাশে নওয়াজ শরিফ, শাহবাজ শরীফ, মরিয়ম নওয়াজ, বেলাওল ভুট্টো, আসিফ আলী জারদারি, মাওলানা ফজলুর রেহমানের মত নেতারা, যাদের পাশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থন।
আরও পড়ুন : মেয়র ভাই, আর কতো বৈষম্য সৃষ্টির বাণী দিবেন: আসিফ নজরুল
৩রা এপ্রিলকে পাকিস্তানের গণতন্ত্রের জন্য একটি বিশেষ দিন মনে করেছিল বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলো। ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিরোধী দল গুলোর প্রস্তাবিত অনাস্থা প্রস্তাবের উপর ভোট হওয়ার চূড়ান্ত মুহূর্তে পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার অনাস্থা প্রস্তাবটি সংবিধানের পাঁচ নং অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক বলে সরাসরি বাতিল করে দেন। হতবাক হয়ে যায় বিরোধী দল গুলো। কারণ ৩৪২ আসনের পার্লামেন্টের ম্যাজিক ফিগার ন্যূনতম ১৭২টি এমপির সমর্থন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পক্ষে ছিল না। পার্লামেন্টে ভোট হলেই ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রীত্ব চলে যেত।
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পরামর্শ প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়ে তিনমাসের মধ্যে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে বিরোধী দলীয় সদস্যরাও একতরফা নওয়াজ শরীফের ভাই শাহবাজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী এবং তাদের একজন এমপিকে স্পিকার ঘোষণা করে। বিরোধীরা এখন ভরসা রাখছে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের উপর। খেলা মনে হয় এখনো শেষ হয়নি। যার শেষটা কী হয় বলা মুশকিল।এই ধরনের শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে যে এখনো সামরিক শাসন জারি হয়নি, সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেয়নি, এটাই মনে হয় বিস্ময়কর ঘটনা।
পাঁচ.
ইমরান খান স্পিকারের সাহায্যে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাবটি নাকচ করে দিয়ে প্রেসিডেন্টকে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিতে বলে যে কাজটি করেছেন তা একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ না হলে অসম্ভব।ইমরান খান সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন কী করেননি সেটা ভিন্ন বিষয় তবে সাবেক ক্রিকেটার, অক্সফোর্ড পড়ুয়া ইমরান খান যে বেশ দক্ষ রাজনীতিবিদ তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। শেষ মুহূর্তের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে ইমরান খান তার জীবনের একটি লজ্জা জনক হার থেকে বেঁচে গেলেন।
বিরোধী দল গুলো যেখানে নতুন সরকার গঠনের মতো অবস্থানে চলে গিয়েছিল সেখানে ইমরান খানের কৌশলে তাদের স্বপ্নও আপাতত ধূলিসাৎ হল।পাকিস্তানের রাজনীতিতে গত কয়েক সপ্তাহে যা হল তাতে সেই দেশের একটা বড় অংশ মনে করে যা হয়ে গেছে তা একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র।ইমরান খানও বিষয়টি বক্তৃতা বিবৃতি বেশ ভালো ভাবে জনগণকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন।
ইমরান খান বিরোধীদের কাছে রাজনৈতিক ভাবে হেরে গেছেন আমার কাছে এখনো তেমনটা মনে হয়নি,এইসব ঘটনা প্রবাহে ইমরান খানের জনপ্রিয়তার কী হল প্রমাণ হবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পর। খালি চোখে এটাকে পাকিস্তান তেহরিক ই ইনসাফ পার্টি বনাম বিরোধীদের রাজনৈতিক লড়াই মনে হলেও এটা আসলে পাকিস্তানের মাটিতে আমেরিকা বনাম চীন প্লাস রাশিয়ার একটা পলিটিকাল প্রক্সি ওয়ার।যার মূল কারণ ইমরান খানের পররাষ্ট্রনীতির।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক