জলবায় সম্মেলন

‘কার্যকর জলবায়ু সম্মেলন চাই ’

কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম
কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম  © টিডিসি ফটো

গত ৩১ অক্টোবর থেকে স্কটল্যান্ডে কপ–২৬ জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয়েছে, চলবে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত। ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর এটিই সবচেয়ে বড় জলবায়ু সম্মেলন। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার গতি কমাতে বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ আলোচনাকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশ্বনেতারা সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন ।

যদিও এ নিয়ে আশাবাদী নন জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্দোলনে সাড়া জাগানো সুইডেনের অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। গ্লাসগোতে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের (কপ–২৬) ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছেন না তিনি। বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবিলায় এ বৈঠক শেষ সুযোগ বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ‘বড় ধরনের পরিবর্তন’ আসবে বলে মনে করেন না তিনি। বাস্তব পরিবর্তনের জন্য বিশ্ব নেতাদের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে অধিকারকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন থুনবার্গ। বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়। 

পৃথিবীর সব শিল্পোন্নত দেশ জলবায়ুর পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে বলে ধারণা অনেকের। পৃথিবীর পরিবেশের উষ্ণতার পেছনে তাদের কর্মকাণ্ডকে দায়ি মনে করেন পরিবেশবাদীরা।

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে সর্বক্ষেত্রে। বাড়ছে তাপমাত্রা, অতিবৃষ্টি, অতিমারি, খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। গত ২০ বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের এই ক্ষতিকর প্রভাবের মুখে পড়েছে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে সুদুর আমেরিকা পর্যন্ত।
বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিআরআই)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি গ্রতিগ্রস্ত হয়েছে হন্ডুরাস, তারপরেই আছে মিয়ানমারের নাম৷ 

গেল ২০ বছরে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের নানা কুফলে মারা যায় ৫ লাখ ২৮ হাজারেরও বেশি মানুষ এবং ৩ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (পিপিপি তে) ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে৷ আর এর সরাসরি ফলাফল হিসাবে আবহাওয়া বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে ১১ হাজারটি৷

‘ইউএনইপি অ্যাডাপ্টেশন গ্যাপ'-এর  ২০১৩ সালের রিপোর্টে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বা ফলাফলের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক খরচের পরিমাণ এখনকার চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেড়ে যাবে৷ আর বর্তমানে যা ধারণা করা হচ্ছে, তার চেয়ে চার থেকে পাঁচ গুণ বাড়বে ২০৫০ সাল নাগাদ৷ অন্যদিকে ঐ রিপোর্টটিতে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বাড়ার সীমা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার ওপর জোর দেয়া হয়েছে৷ এতে করে একদিকে যেমন মানুষের দুর্ভোগ কমবে অন্যদিকে নামতে থাকবে খরচের হারও৷

জলবায়ু পরিবর্তনে অন্যতম ঝুঁকিগুলির মধ্যে দাবদাহ, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও উপকূলীয় এলাকায় বন্যা— যা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ ইউরোপ, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বড় অংশে দাবদাহ ক্রমাগত বাড়ছে৷ একইভাবে, উত্তর অ্যামেরিকা ও ইউরোপে ভারী বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বেড়েছে এবং কিছু দিন পরপরই বিশ্বের নানা জায়গায় একই উদাহরণ সৃষ্টি হচ্ছে৷ গত কিছুদিন আগে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর নানা দেশে দাবানলে পুড়েছে হাজার হাজার একর বনভূমি। ওমান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ভয়াবহ বৃষ্টিপাত ও বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রচূর। মারা গেছে বহু মানুষ, পশুপাখি। তাছাড়া, উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে মেরুঅঞ্চলের বরফ গলে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ফলে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর নিম্নাঞ্চলসমূহ সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশংকা বিশেষজ্ঞদের।

এখন বছরের প্রায় দশ মাসই গরম থাকে। শুধু গরম নয়, তীব্র গরম৷ কোনো রকমে দুই এক মাস তাপমাত্রা একটু কম থাকে, যার মধ্যে এক মাসকে আমরা এখন শীতকাল বলে ধরে নিই৷ সেটি সাধারণত নভেম্বরের শেষ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয়৷ শীত এসেই যাচ্ছে অথচ এখনও তাপমাত্রা সেভাবে কমেনি। এ বছরতো বলতে গেলে বৃষ্টির দেখাই মেলেনি। এসব ঘটনা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে দেখছেন বিজ্ঞানীরা৷ এসবের ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন কমছে, বাড়ছে নিত্য নতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অসুখ-বিসুখ৷ সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঘরহারা মানুষের সংখ্যা৷ ফলাফল হিসেবে শহরাঞ্চলে বস্তিবাসীর সংখ্যাও বাড়ছে৷

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশেও প্রচুর ক্ষতির আশংকা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) তাদের চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে আশঙ্কা জানিয়েছে যে, এই শতাব্দীর মধ্যে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যেতে পারে৷ দেশের ১৯টি জেলার প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ওই ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি আছে৷ এ কারণে ঘর হারাবে প্রায় দুই কোটি মানুষ৷ 

সব বিচার-বিশ্লেষণে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, জলবায়ুর ইতিবাচক পরিবর্তন ছাড়া প্রিয় এই পৃথিবীকে বাঁচানো অসম্ভব। এজন্য বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোকেই প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে। চলমান জলবায়ু সম্মেলনই হতে পারে বড় সুযোগ কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কেবল যেনতেন করে বিলাসী ও গতানুগতিক সম্মেলন করলে কাজের কাজ কিছুই হবেনা। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচাতে হবে প্রিয় পৃথিবীকে। তাই আনুষ্ঠানিকতা নয়, চাই কার্যকর ও বাস্তবভিত্তিক জলবায়ু সম্মেলন।

 লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট


সর্বশেষ সংবাদ