মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলের মানবচিত্র

মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলের মানবচিত্র
মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলের মানবচিত্র  © টিডিসি ফটো

দেশে করোনা পরিস্থিতি আবির্ভাব হওয়ার কারণে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের পর হল ছেড়ে গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরাতে চলে আসি ২১ মার্চ। বাড়িতে এসে দেখি জমিতে বোরো ধান রোপন করা হয়েছে।

পূর্বে পারিবারিক কৃষিতে সাহায্য করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর কৃষির দিকে মনযোগ দিতে পারিনি। দীর্ঘ ৬ বছর পর আবার এই কাজে মনোযোগের সুযোগ আসলো। আস্তে আস্তে দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাজারঘাটের সুযোগ-সুবিধা কমতে থাকার ভয়ে নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। এ সময় একটাই চিন্তা করতাম কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে, তার জন্য বাড়াতে হবে উৎপাদন।

নিয়ম করে ধানের জমিতে পানি দিতে শুরু করলাম। ১০০টা কলাগাছ সহ আরো কিছু সবজি লাগালাম।

একথা সত্য যে আমরা পূর্বের তুলনায় বিগত কিছু বছর ধানের উৎপাদন বাড়িয়েছিলাম কিন্তু সার ও কিটনাশকের দাম বৃদ্ধি, সেচের জন্য জ্বালানীর দাম বৃদ্ধি, শ্রমিকের খরচ বৃদ্ধি ও প্রতিনিয়ত ধানের দাম কম পাবার জন্য পারিবারিক আয়ের অংকটা খুব একটা বাড়াতে পারছিলাম না। সবকিছুর পরেও বাজারে পূর্বের তুলনায় বেশি ধান সরবরাহ করতে পারছিলাম এটুকুই সুখের ছিল।

তবে করোনা ভাইরসা জীবনের গতিপথ যেমন এক রকম রুদ্ধ করে দিয়েছে. সেখানে আবার নতুন মাত্র যুক্ত করেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। জলবায়ু পরিবর্তন যে কৃষির উপর কতটা প্রভাব ফেলেছে এ পর্যায়ে তার কিছুটা বলতে চাই।

আমরা কৃষিকে মোটামুটি সাজিয়েছি আমাদের আবহাওয়ার সাথে মিল রেখে। এমন সময় চাষাবাদ শুরু করি যেন জমিতে সেচের জন্য বৃষ্টির পানি ব্যবহার করতে পারি অথবা শুষ্ক আবহাওয়া কাজে লাগিয়ে চাষের পরিবেশ অনুকূলে রাখতে পারি। আমাদের পূর্বপুরুষরা এভাবেই শতাব্দী ধরে চাষাবাদ করে আসছে। কিন্তু এখন আবহাওয়ার এই অস্বাভাবিক আচরণ চাষের প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করছে।

অনাবৃষ্টি ফসলের উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছে আবার অতিবৃষ্টি ফসল ঘরে তোলার সময় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। চিংড়ি খুব সংবেদনশীল হওয়ায় বিলম্বিত বৃষ্টিপাতের কারণে অত্যধিক তাপে চিংড়ি চাষীসহ অন্য মৎসচাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবার প্রলম্বিত বৃষ্টিপাতের কারণে অত্যধিক পানি বৃদ্ধির জন্য ঘের ডুবে যাওয়াতে চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

বৈশাখের মাঝামাঝি সমস্ত প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা পেরিয়ে ধান ঘরে তুলতে পারলাম ২৮ বৈশাখ তারিখ অর্থাৎ ১১ মে। তখন থেকে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে খবর পাচ্ছিলাম আমরা একটা প্রলয়কারী ঘূর্ণিঝড়ের সামনে পড়তে যাচ্ছি যার নাম ‘আম্ফান’।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিগত বছরগুলোতে বারংবার এমন ঝড়ের মুখোমুখি হওয়াতে ঝড়গুলি আমাদের দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের গা-সওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমদিকে কম গুরুত্ব দিলেও সময়ের সাথে সাথে আমরা এই ঝড়ের বিশলতা ও তীব্রতা অনুভব করতে শুরু করলাম।

জানতে পারলাম ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান আমাদের উপকূলে অর্থাৎ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আঘাত হানতে পারে। উপকূলীয় অঞ্চল সহ দেশের ১৪ টি জেলায় ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে হুঁশিয়ার করছে বাংলাদেশ আবহাওযা অধিদপ্তর।

গ্রামে সবাই নিজেদের মত প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। ১৯ মে সকাল থেকে আকাশেরর মেঘে সূর্য ডাকা পড়লো। হঠাৎ হঠাৎ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর মৃদু হাওয়া বইছিল। বিকালের দিকে বাতাসের বেগ কিছুটা বাড়লো আর বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বাড়তে থাকলো। সবাই শঙ্কিত মুখে গোয়ালের গরু-ছাগল ভালো করে বাঁধলো। অনেকে নিজেদের টিনের ঘরের কয়েকটা জায়গাতে বাঁধন মজবুত করলো। এভাবে মৃদু বাতাস, বৃষ্টির মধ্যদিয়ে ২০ তারিখ সকাল হলো।

২০ তারিখ সকালে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখানো হলো। আমরা সবাই সেদিন প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম বিকালের আসন্ন ঘূর্ণিঝড় নিয়ে। বুঝতেছিলাম বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হতে পারে তাই মোমবাতি, কেরোসিন, দিয়াশলাই কিনে রাখলাম। সারাদিন ক্রমাগত বৃষ্টিপাত আর বাতাসের মধ্যে দিনের শেষ প্রান্তে উপস্থিত হলাম।

বিকাল ৬ টা থেকে সবাই নিজেদের বাসায় অবস্থান নিলাম। ক্রমাগত বাতাসের বেগ বেড়ে চলছে এবং তা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করলো। তখন বুঝতে পারলাম ঘূর্ণিঝড়ের মূল অংশের দ্বারপ্রান্তে আমরা এখন। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি আমরা। সময় বাড়ার সাথে সাথে পাল্লাদিয়ে বাতাসের বেগ বেড়ে চললো আর তার সাথে বৃষ্টি। বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম গাছগুলো প্রচণ্ড ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করছে। প্রচণ্ড থেকে প্রচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টিপাতের মধ্যে রাত ১১ টা নাগাদ আমরা বাতাসের সর্বোচ্চ গতির মুখোমুখি হলাম। চারিদিকে বাতাসের তর্জন গর্জন আর তার মধ্যে গাছ ভেঙ্গে পড়ার শব্দে খুবই শঙ্কিত হলাম। এভাবে বাতাস তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে এবং প্রকৃতির উপর মানুষের অবিচারের প্রতিশোধ নিয়ে ভোর ৬টা নাগাদ শান্ত হলো।

আমরা বুঝেছিলাম প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি কিন্তু সেই ক্ষতি যে কতটা ভয়াবহ তা বুঝতে আমাদের আর একটু সময় লাগলো।

ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম বাড়ির পাশে প্রচুর শিরিশ, মেহগনি, কাঠাল গাছ, আম গাছ ভেঙ্গে পড়েছে। এমনকি বাঁশ অনেক ফ্লেক্সিবল হওয়া সত্ত্বেও বাঁশ ভেঙ্গে পড়েছে। অনেক গাছের মূল উপড়ে ফেলেছে বাতাসে। এভাবে আসলে আমি প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝাতে পারছি না।

আমি যে অঞ্চলে ছিলাম তার একটা পরিসংখ্যান বলি। এখানে প্রতি ১০টা গাছের ৪টা মূল উৎপাটন বা বড় ডাল ভেঙ্গে পেড়েছে। আবার দুইটি ঘের বিভক্তকারী উঁচু জমি যাকে আইল বলি তা দৃঢ় রাখার জন্য আইলে যে বিভিন্ন ফলজ গাছ লাগানো আছে তার শতকরা ৯০ শতাংশ হেলে পড়েছে। এত গাছ ভেঙ্গে পড়ার কারণে কাঠের দাম একদিনে অর্ধেক হয়ে গেল।

আমি বাড়ির পাশে যে ১০০টা কলাগাছ লাগিয়েছিলাম তার একটাও দাঁড়িয়ে নেই। বাতাসের তীব্র বেগ সহ্য করতে না পেরে সবগুলো গাছ ভূপাতিত হয়েছে। শুধু আমাদের জমিতে না আমাদের অঞ্চলের সবগুলো কলাবাগানের প্রায় শতভাগ কলাগাছ নষ্ট হয়েছে। এটা আমাদের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হয়েছে।

আমাদের দেশে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের পর সাতক্ষীরাতে সব থেকে বেশি আমের ফলন হয়। কিন্তু আম্ফান ঝড়ে ৯০ শতাংশ আম গাছ থেকে পড়ে যায়। ঝড়ের মাত্র ১৫ দিন পর কাঁচা আম পেড়ে সংরক্ষণ করে বাজারজাত করণের উপযুক্ত করা হতো। কিন্তু ঝড়ের সময়ে আমের এমন অবস্থা ছিল যে পড়ে যাওয়া আমগুলো সংরক্ষণ করলে পাকবে না, সুতরাং কাঁচা ব্যবহার করা ছাড়া আর কোনভাবে ব্যবহার করা যাবে না। যাদের পরিবারের মূল উপার্জনের মধ্যম আমবাগান ছিল তারা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলো।

পানচাষীদের সবথেকে বেশি আর্থিক ক্ষতি হলো। পানচাষ করতে এমন এক ধরনের মাচা তৈরি করতে হয় যেখানে বাঁশ, দড়ি আর সুপারির পাতা ব্যবহৃত হয়। দীর্ঘক্ষণ ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করে শেষে হেরে গিয়ে পুরো মাচান ভূপাতিত হয়।

পান খুব দ্রুত পচনশীল হওয়ায় ভূপাতিত মাচা থেকে একটিও বিক্রয়যোগ্য পান পাতা বের করা সম্ভব ছিল না। আমবাগানের আমগাছ গুলো তবুও পরের বছর আম ফলনের উপযুক্ত ছিলো কিন্তু বরজের কিছুই থাকলো না।

অসংখ্য বসতবাড়ি আর দোকানের টিন ও সিমেন্টের শিট যাকে এসবেসটস বলি সেই চালা সম্পূর্ণ বা আংশিক উড়ে গিয়েছে। পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে জনগোষ্ঠীর একসপ্তাহের বেশি সময় লেগেছিল। ২২ মে ঈদ হওয়াতে আমরা সবাই দুঃখভারাক্রান্ত মনে ঈদের নামাজ আদায় করি। আবার বাতাসের টানে সমুদ্রের পানি যেসব অঞ্চলে প্রবেশ করেছে সে অঞ্চলের মানুষরা হাটুপানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায় করে যা ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

ঝড়ের দিন বিকালে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল আর সেই বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছিলাম আমরা জুন মাসের ৭ তারিখ। অর্থাৎ ঝড়ের ১৯ দিন পর। কারণ ঝড়ে বৈদ্যুতিক তারের উপর অনেক গাছ এবং ডালপালা পড়েছে, সেই টানে বৈদ্যুতিক খুঁটিগুলো ভেঙ্গে পড়েছিল। আমার অঞ্চলের প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ বৈদ্যুতিক খুটি ভেঙ্গেছিল। যার সবগুলো মোটামুটি ঠিক করতে ২ সপ্তাহের বেশি সময় লেগেছিল। এই সময়টাতে আমরা বাইরের দুনিয়ার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। বিদ্যুৎ না থাকায় পেট্রোলপাম্পগুলো জেনারেটর চালিয়ে জ্বালানি সেবা দিত। এই জেনারেটর ছিল আমাদের মোবাইল চার্জের একমাত্র উৎস।

এদিকে বাজারে মোমবাতি অনেকদিন আগেই শেষ। হারিকেন আর কেরোসিনের দামও চড়া। সন্ধ্যার পর থেকে ঘন এক অন্ধকার নেমে আসতো আমাদের অঞ্চলে। একটা ঝড় আমাদের ৩০-৩৫ বছর অতীতের জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে নিয়েছিল। এই যুগে ১৯ দিন বিদ্যুৎ সংযোগের বাইরে থাকা অবর্ণনীয় অবস্থার সৃষ্টি করে।

ঝড়ের পরের দিন সকাল বেলা আকাশে বেশ কিছু হেলিকপ্টার উড়তে দেখা যায়। সম্ভবত তারা ক্ষতি নিরূপনের চেষ্টা করছিল। আবার উপকূলের তীরবর্তী অঞ্চলে বাংলাদেশ আর্মড ফোর্স ডিভিশনের কিছু উদ্ধারকর্মী পৌছান দুর্যোগে সাড়া ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। তাদেরকে প্রচুর খাদ্য সহায়তা নিয়ে যেতে দেখেছি তুলনামূলক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে।

এই সময়ে গ্রামের বর্ষীয়ানদের বলতে শুনেছি আম্ফান ঝড় ১৯৮৮ এর বৃহৎ ঝড়ের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কারণ আম্ফান ঝড়ের বাতাসের তীব্রতা ১৯৮৮ সালের ঝড়ের মত হলেও এর স্থায়িত্ব ছিল ১৯৮৮ এর ঝড়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি। এ থেকে বুঝলাম ক্ষণস্থায়ী তীব্র হাওয়া যে ক্ষতি করে অপেক্ষাকৃত কম তীব্র হাওয়া বেশিক্ষণ ধরে প্রবাহিত হলে তার থেকে বেশি ক্ষতি হয়। তবুও আম্ফান ঝড়ে প্রাণনাশ হয়েছে অনেক কম। কারণ, আমরা বিগত কয়েক দশকে দুর্যোগ মোকাবিলায় নিজেদের অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছি। আবার আম্ফানে আর্থিক ক্ষতি ৮৮ এর ঝড়ের চেয়ে বেশি কারণ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও অপরিকল্পিত স্থাপনা।

সবশেষে বলতে চাই আম্ফান ঝড় কৃষক শ্রেণীর ও উপকূলীয় লোকদের এই করোনাকালীন বিচ্ছিন্ন থাকার সময়ে আর্থিক ও সামাজিকভাবে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিয়েছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ