সব ছাপিয়ে কমিউনিস্টরাই এগিয়ে

  © টিডিসি ফটো

যত দোষ নন্দঘোষ। পুঁজিবাদী দেশের শত শত ভুলেও যেন সাত খুন মাফ। কিন্তু কমিউনিস্টদের একটা ভুলেই যেনো তুলকালাম হওয়ার অবস্থা। এ নিয়ে অন্নদা শঙ্কর রায় একটা ছড়া লিখেছিলেন। নাম ‘গিন্নি বলেন’।

যেখানে যা কিছু ঘটে অনিষ্টি

সকলের মূলে কমিউনিষ্টি।

মুর্শিদাবাদে হয় না বৃষ্টি

গোড়ায় কে তার? কমিউনিষ্টি।

পাবনায় ভেসে গিয়েছে সৃষ্টি

তলে তলে কেটা? কমিউনিষ্টি।

কোথা হতে এলো যত পাপিষ্ঠি

নিয়ে এলো প্লেগ কমিউনিষ্টি।

গেল সংস্কৃতি, গেল যে কৃষ্টি

ছেলেরা বললো কমিউনিষ্টি।

মেয়েরাও হতে পায় কী মিষ্টি।

সেধে গুলি খায় কমিউনিষ্টি।

যেদিকে পড়ে আমার দৃষ্টি

সেদিকেই দেখি কমিউনিষ্টি।

তাই বসে বসে করছি লিষ্টি

এ পাড়ার কে কে কমিউনিষ্টি।

১৯৪৯ সালের লেখা ছড়া। কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে যত যাই বলা হোক না কেন, তার পরেও অনেক দিন কমিউনিস্টরা ছিলেন। পৃথিবীর বহু দেশে তাদের শাসন ছিল। সেই যুগে ঠাট্টা করে বলা হত, মস্কোতে বৃষ্টি হলে না কি ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁটতেন বলিভিয়া ভিয়েতনামের কমিউনিস্টরা। মস্কোই তাদের কাছে ছিল বিশ্বের রাজধানী। পরে সেই আসন কিছুটা কেড়ে নেয় চীন। তার পর একে একে কমিউনিস্ট সরকারের পতন হতে থাকল দেশে দেশে। চিলির কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়েছিল সালভাদর অ্যালেন্দে খুন করে। ফিদেল কাস্ত্রোকে খুন করে কিউবা দখল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল আমেরিকার পাতানো গুপ্তচরেরা।

১৯৯১ সালে মানুষ কমিউনিস্টদের ত্যাগ করতে শুরু করল। প্রথমে ১৯৯১ সালে রাশিয়ায় পতন হল কমিউনিস্টদের। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হল। তার পর একে একে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। তার পর বাকি সব। সব বললে ভুল হবে। কয়েকটা দেশে থেকে গেল কমিউনিস্টরা। যেমন একনায়কতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রমুখী ধনতান্ত্রিক মহাশক্তিধর চীন। একনায়কতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়া। এছাড়া ছোট ছোট কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশ এই যেমন কিউবা, লাওস, ভিয়েতনাম। পাশের দেশ ভারতের পশ্চিবঙ্গে ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর মানুষ কমিউনিস্টদের পরিত্যাগ করেছে। ত্রিপুরাতেও কয়েক বছর আগে বিজেপি এসে দখলে নিয়েছে। বিজেপি ত্রিপুরায় ক্ষমতায় এসেই গুড়িয়ে দিয়েছে কমিউনিস্টদের সকল স্থাপনা। ভেঙে দিয়েছে লেলিনের প্রতিকৃতি। একমাত্র কেরলে কমিউনিস্টরা এখন ক্ষমতায় আছে।

পৃথিবী জুড়ে এখন তান্ডব চালাচ্ছে মহামারী করোনা। একের পর এক উন্নত পুঁজিবাদী দেশ ব্যর্থ করোনার মহামারী ঠেকাতে।নুইয়ে পড়েছে পুঁজিবাদী দেশগুলোর অর্থনীতি। আমেরিকার মত উন্নত দেশকে হুমকি ধামকি দিয়ে ভারতের থেকে ক্লোরোফ্লোরোকুইনের কাচামাল নিতে হচ্ছে।

ঠিক সেই সময় বেশ কিছু গুরুতর দোষ ত্রুটি অন্যায় কাজের জন্য যে কমিউনিস্টরা মানুষের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল, তারাই এখন মহামারির দুর্দিনে মানুষের পাশে থাকার ব্যাপারে অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে এক নজির সৃষ্টি করল। সে হোক কিউবা বা ভিয়েতনাম বা লাওসই। সারা পৃথিবী দেখছে কমিউনিস্টদের উদারতার দৃষ্টান্ত। তারা এখন সবার থেকে আলাদা। তারা অনেক বেশি বিশ্বস্ত। অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। অনেক বেশি সৎ।

চীন করোনা নিয়ন্ত্রণ করে ফের নিজেদের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে নেমে পড়েছে। তা নিয়ে অনেক লেখা লেখিও হয়েছে। চীনের বিরুদ্ধেও অনেক সমালোচনা হচ্ছে। করোনা ছড়ানোর পেঁছনে চীনের হাত রয়েছে, এমন গুরুতর অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। চীন করোনার তথ্য গোপন করছিল কি না, তারা মরণ ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছিল কিনা, সে কথা ভবিষ্যতই বলবে। বদ্ধ উন্মাদ ট্রাম্পের চিৎকারের ওপর নির্ভর করার কোনও যুক্তি নেই।

ধরা যাক লাওসের কথা। গত তিন সপ্তাহে লাওসে একটিও করোনা সংক্রমণের খবর আসেনি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছোট্ট দেশ লাও বা লাওস। কেউ হয়তো বলবেন ছোট দেশ, ওখানে এসব সম্ভব। হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন ছোট দেশ। প্রতি কিলোমিটারে ঘনত্ব প্রায় চল্লিশ জন। কিন্তু সেই যুক্তি দিয়ে লাওসের সাফল্যকে ছোট করা যাবে না।

কারণ, একই রকম সফল ভিয়েতনাম। সে দেশের ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৩১০ জন। যা ইতালি-স্পেনের থেকে অনেক বেশি। ইতালি-স্পেন তো করোনার আঘাতে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। মৃত্যুর মিছিল দেখতে দেখতে তারা ভেঙে পড়েছে। তাই জনসংখ্যা কমের যুক্তি একেবারেই অচল।

ভিয়েতনামের মতোই সমাজতান্ত্রিক দেশ ‘লাওস গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ এর বয়স মাত্র ৪৫ বছর। দেশটার জন্মই হয়েছে ১৯৭৫ সালে। দেশটির সরকার চালায় ‘লাওস পিপলস রিভলিউশনারি পার্টি’। মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা গত ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ১৯ জন। এর মধ্যে ১৬ জন রাজধানী ভিয়েনতিয়েনের বাসিন্দা। বাকি তিন জন লুয়াংপ্রবাং শহরের। ১৯ জনের মধ্যে ৭ জন এরই মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। লাওসে গত ২৪ মার্চ প্রথম একজনের শরীরে সংক্রমণ দেখা যায়।

শুরুতেই রাজধানীর একটি বড় সরকারি হাসপাতালকে করোনা রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। শুরু হয় সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং বিধি। ছুটি দিয়ে দেওয়া হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্ধ করা হয় অধিকাংশ দোকান-বাজার। বন্ধ করে দেওয়া হয় পর্যটকদের ভিসা দেওয়া। লাওসে সকলের স্বাস্থ্যের দেখভালের দায়িত্ব সরকারের। আর জনসাধারণের স্বাস্থ্য সরকারের কাছে অন্যতম অগ্রাধিকারের বিষয়।

১৯৫৪ সাল পর্যন্ত লাওস গায়ের জোরে দখল করে রেখেছিল ফরাসিরা। ফরাসিরা চলে গেলে বোমা ফেলে বন্দুক দিয়ে এই ছোট্ট দেশটা দখল করে রেখেছিল আমেরিকা। পৃথিবীর ইতিহাসে সব থেকে বেশি বোমা ফেলা হয়েছে ছোট্ট এই দেশটার ওপরে। একটা হিসেবে দেখা যায়, আমেরিকা লাওসে মাথাপিছু এক টন করে বোমা ফেলেছে। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৪ এই ১১ বছরে লাওসের ওপর ২০ লক্ষ টন বোমা বর্ষণ করেছে আমেরিকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এশিয়া এবং ইউরোপে মোট বোমা পড়েছিল ২১ লক্ষ টন। এর থেকে আন্দাজ করা যায় লাওস দখলে রাখতে কী বিধ্বংসী আক্রমণ চালিয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু তারা দখলে রাখতে পারেনি।

লাওসের মানুষ তাদের দেশকে মুক্ত করেছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ আমেরিকার হাত থেকে। তার পর থেকে শুরু হয়েছে উন্নয়ন। এই উন্নয়নে সাহায্য করেছে চীন। এখন সেখানে তৈরি হচ্ছে ২৫৭ কিলোমিটারের চীন-লাওসের মধ্যে সুপার ফাস্ট ট্রেনের লাইন পাতার কাজ। কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে আগামী বছর।

ছোট্ট দেশ লাওসকে করোনা মোকাবিলায় চীন পাঠিয়েছে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসা সামগ্রী। ভিয়েতনাম পাঠিয়েছে ৫০০ সুরক্ষা পোশাক, ১৮ হাজার মাস্ক। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত লাওসে করোনা ভাইরাসে একজনেরও মৃত্যু হয়নি।

এবার আসি ভিয়েতনামের কথায়। করোনা বিধ্বস্ত চীনের সঙ্গে যাদের দীর্ঘ সীমানা সেই ভিয়েতনামে এখন পর্যন্ত একজন মানুষেরও মৃত্যু হয়নি করোনায়। একটা ছোট্ট সমাজতান্ত্রিক দেশ দেখিয়ে দিল কী ভাবে একটা দায়িত্বশীল সরকার দেশের মানুষকে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা দিতে পারে।

ভিয়েতনাম আরও একবার আমেরিকাকে গোহারা হারালো। লাওসের মতোই বোমা-বন্দুকের ভয় দেখিয়ে প্রথমে ফরাসিরা পরে আমেরিকা দখল করে রেখেছিল হো চি মিনের ভিয়েতনাম। ৪৫ বছর আগে ৩০ এপ্রিল ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট গেরিলাদের আক্রমণে মার্কিন সেনা পিছু হটে।মুক্ত হয় আমেরিকার দখলে থাকা দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গন। যে সায়গনের বর্তমান নাম ‘হো চি মিন সিটি’। সেই হল ভিয়েতনামের কাছে আমেরিকার প্রথম পরাজয়।

দ্বিতীয় পরাজয় কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে। কী করে দেশের মানুষকে নিরাপত্তা দিতে হয়, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ভিয়েতনাম।

তবে আমেরিকার মানুষের সঙ্গে তো ভিয়েতনামের মানুষের কোনও শত্রুতা নেই। পুরোনো দিনের কথা ভুলে গিয়ে ভিয়েতনাম আমেরিকায় বন্ধুত্বমূলক ত্রাণ পাঠিয়েছে। পাঠিয়েছে সাড়ে চার লক্ষ মাস্ক এবং সুরক্ষা পোশাক। শুধু আমেরিকা নয়, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ডকে পাঁচ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়া মাস্ক উপহার দিয়েছে ভিয়েতনাম।

কী করে করোনা মহামারি সামলালো ভিয়েতনাম? এটা ঠিকই ভিয়েতনাম চিনের সীমান্ত দেশ। ভিয়েতনামের অর্থনীতি অন্তত ১৭ শতাংশ নির্ভরশীল চীনের ওপর। দুই দেশের মধ্যে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ, যাওয়া-আসা। ফলে আন্তর্জাতিক মহল প্রকাশ্যেই ভিয়েতনামের সম্ভাব্য বিপর্যয় নিয়ে আতঙ্কিত ছিল। কিন্তু ভিয়েতনাম প্রমাণ করে দিয়েছে, আন্তর্জাতিক কুটনীতিকরা ভিয়েতনামকে বুঝতেই পারেনি। চীন থেকে করোনা ভাইরাসে প্রথম মৃত্যুর খবর যখন সারা পৃথিবী জানল, তখনও ভিয়েতনামে একটিও সংক্রমণের ঘটনা ঘটেনি।

কিন্তু কোনও সংক্রমণের খবর না থাকলেও তখনই ভিয়েতনাম চীনের সঙ্গে তাদের ১৪০০ কিলোমিটার সীমান্ত সিলগালা করে দেয়।আর খুব জরুরি কারণ ছাড়া চীনের সঙ্গে সব রকম ব্যবসা-জনিত বা অন্যান্য যাতায়াত বন্ধ করে দেয়। সম্ভাব্য এলাকায় কোয়ারিন্টিন সেন্টার চালু করা হয়।বিভিন্ন চেকপয়েন্টে কঠোর নজরদারি যেমন শুরু হয়, তেমনি করোনা প্রতিরোধের মেডিক্যাল সামগ্রীর উৎপাদন বাড়িয়ে দেওয়া হয়। নিয়ম চালু করা হয় দু’জনের বেশি একসঙ্গে যাতায়াত করা যাবে না।

সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে লালারসের নমুনা নিয়ে ‘ম্যাস টেস্টিং’। এই সব সতর্কতা চালু হওয়ার সময় ভিয়েতনামে দৈনিক ৩৬০০ কিট তৈরি হত। কয়েক দিনের মধ্যেই সেই পরিমাণ বাড়িয়ে করা দশ হাজার কিট তৈরি করা হয়। মোট এক লক্ষ আশি হাজার ৬৭ জনের লালারস পরীক্ষা করা হয় ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত। তার মধ্যে ২৭০ জনের কনফার্মড কোভিড-১৯ ধরা পড়ে।

অর্থাৎ প্রতি এক জন কোভিড-১৯ রোগীকে খুঁজে বের করতে ৬৭২ জনের লালারস পরীক্ষা করা হয়েছে। এটা সারা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ রেকর্ড। এর সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যে খবর বা গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করলেই ধরে ধরে তাদের জরিমানা করা শুরু হয়। ভিয়েতনাম বড়লোক দেশ নয়। কিন্তু দ্রুত এই সাবধানতা নেওয়ার ফলে কখনই রোগীর সংখ্যা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত যে ২৭০ জনের শরীরে কোভিড-১৯ ধরা পড়েছে তাদের মধ্যে ২২৫ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।এখনও একজনেরও মৃত্যুর খবর নেই ভিয়েতনামে।

এবার আসি কমিউনিস্ট কিউবায়।যাদের পিষে মারার জন্য আমেরিকা অর্থনৈতিক অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে বহু বছর ধরে।সেই ছোট্ট দেশের সাফল্যের কথা আজ সবারই জানা। কিউবার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বরাবরই খুব উন্নত। সে দেশে মানুষের চিকিৎসার সমস্ত দায় সরকারের। দেশটায় জনসংখ্যার তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা যথেষ্ট বেশি।আমেরিকায় প্রতি হাজার জনসংখ্যার জন্য রয়েছে ৩ জন ডাক্তার। আর কিউবাতে প্রতি হাজার জনসংখ্যা পিছু ডাক্তারের সংখ্য প্রায় ৭ জন। পৃথিবীর মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ।

করোনার এই দুর্দিনেই কিউবার ডাক্তাররা নিজেদের দেশ ছেড়ে বিভিন্ন দেশে গিয়ে রোগীদের চিকিৎসা করছেন। কিউবা কিন্তু মোটেই বড়লোক দেশ নয়। তবে যেহেতু সম্পদের ভাগ কোনও গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত নয়, ফলে ভালোটুকুও যেমন সকলের মধ্যে ভাগ হয়, সমস্যাও ভাগ হয় সকলের মধ্যে।

কিউবার পর্যটন খাত থেকে প্রচুর আয় হতে পারে। আমেরিকার নানা বিধি নিষেধের ফলে পর্যটন ব্যবসাও যথাযথ ভাবে প্রসারিত হতে পারে না। গত জানুয়ারি মাসেই কিউবা একটা বড় কাজ করে ফেলে। দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ধরা পড়লে কী কী করতে হবে, আগাম তার ‘প্রিভেনশন অ্যান্ড কনট্রোল প্ল্যান’ তৈরি করে নিজেরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যায়। ঝড় এলে কী ভাবে সামাল দেওয়া দেওয়া হবে তার জন্য অনেক আগে থেকেই কিউবা প্রস্তুত ছিল।

গত মার্চের ১১ তারিখ প্রথম কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ধরা পড়ে কিউবায়। এক সঙ্গে ৩ জনের কনফার্মড কেস। সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের লকডাউন ঘোষণা করা হয় আর মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের নামানো হয় দেশ জুড়ে টেস্টের জন্য। ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত কিউবায় মোট সংক্রমণ ১১৮৯, মৃত্যু ৫২ জনের। বিশেষজ্ঞদের মতে আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে করোনা মহামারি প্রতিরোধে কিউবার সাফল্য যথেষ্ট ভালো।

এবার আসি পাশের দেশ ভারতের কমিউনিস্ট পরিচালিত রাজ্য কেরলের দিকে। শিক্ষার হারে ভারতের সবচেয়ে ভাল রাজ্য কেরল। এবার তারা প্রমাণ দিল স্বাস্থ্যেও কেরল ভারতের মধ্যে প্রথম। বিদেশী গণমাধ্যম গুলোতে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে কেরলের বামপন্থী সরকারের বিরাট সাফল্যের কথা লেখা হচ্ছে। মার্চের প্রথমে যখন সারা ভারতে মোট কোভিড-১৯ কেসের সংখ্যা ছিল ছয়টি, তার তিনটি ছিল কেরলের।

কেরলের সরকার দু’লক্ষ স্বেচ্ছাসেবক নামিয়েছে লকডাউন পর্বে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ফান্ড তৈরি করে নেমেছে করোনা মোকাবিলায়। আগামী ৫ মাস রাজ্যের সব কর্মীদের মাইনে থেকে ছ’দিনের বেতন সরকার কেটে নেবে করোনা বিধ্বস্ত মানুষের ত্রাণে খরচ করার জন্য।৩০ এপ্রিল পর্যন্ত কেরলে মোট করোনা পজিটিভের সংখ্যা ৪৯৭। মৃত্যুর সংখ্যা চার জন।যা দিল্লি,মহারাষ্ট্র,গুজরাটের চেয়ে অনেক ভাল অবস্থানে।তাই সারা পৃথিবীতেই এখন ‘কেরল মডেল’ কথাটি পরিচিত হয়ে উঠেছে।

একটা সময় ছিল যখন বলা হত কার্ল মার্কস ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের লেখা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো সারা পৃথিবীতে সব থেকে বেশি বিক্রি হওয়া বই। স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ফরাসি বিপ্লব, সেখান থেকে রুশ বিপ্লব সবটাই ছিল বঞ্চিত মানুষের স্বপ্নের জয়যাত্রা। কিন্তু ক্ষমতা পেয়ে কমিউনিস্টরা অনেক ক্ষেত্রেই সেই শান্তি এবং সাম্যের দূতের ভূমিকা থেকে সরে দাঁড়ায়। সব ধরনের বিরোধী মতকে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। তাদের নিজেদের এইসব ভুল-ত্রুটি, অন্যায় কাজ, শত শত বছরের জনতার আন্দোলন, আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জন করা গণতন্ত্র থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা, এই সব নানা কারণে কমিউনিস্টদের জনপ্রিয়তা তলানিতে চলে গিয়েছিল।

করোনার মতো একটি মহামারী বিপর্যয়ের মধ্যে কমিউনিস্টরা শত দোষ ত্রুটির অভিযোগ সত্ত্বেও মানবতার মুক্তির জন্য তারাই সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।মানুষের দুর্দিনে দেখা গেল তারাই প্রথম এবং প্রধান বন্ধু।

এখন দেখার বিষয় কমিউনিস্টরা করোনার মাধ্যমে তাদের পুরোনো জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করতে পারে কি না। চরম দক্ষিণি পন্থার বিরুদ্ধে বামপন্থার পুনরুত্থান সম্ভব কি না, আগামীর করোনা-মুক্ত পৃথিবীই সেকথা বলে দেবে।

লেখক: শিক্ষার্থী আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস আ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সিলেট


সর্বশেষ সংবাদ