শিক্ষার মানদণ্ড ও আমাদের নৈতিকতা

হাবিবুল্লাহ আল মারুফ
হাবিবুল্লাহ আল মারুফ  © টিডিসি ফটো

মহাগুরু এরিস্টটল বলেছিলেন, ‌“সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা”।তারপর বহু যুগ অতিবাহিত হয়েছে। কালের বিবর্তনে শিক্ষার সংজ্ঞার্থও বদলেছে। শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিও গড়ে উঠেছে। এক সময় শিক্ষা বা বিদ্যার্জনের উদ্দেশ্যই ছিল তুলনামূলক জ্ঞানী হওয়া, সভ্য হওয়া।

শুরুর দিকে শিক্ষার কোন অর্থনৈতিক মানদন্ড ছিল না।শিক্ষা বা জ্ঞান আহরণের জন্য মানুষ ঘুরে বেড়াতো দেশ থেকে দেশান্তরে। তারা জ্ঞানকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তারপর শিল্পবিপ্লব হলো, বিজ্ঞানের আলোড়ন ঘটলো, আমলাতন্ত্রের প্রসার ব্যাপ্তি পেল।

আর অর্থনীতিতে শিক্ষার ভূমিকা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকলো। শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্র আবিষ্কার হলো। “শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড” কথাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল যখন নেপোলিয়ান বললেন,“তোমরা আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দেব”।

যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি ততো বেশি উন্নত। আমরা সেই শিক্ষার কথা মহাজনদের বাণীতে শুনেছি, যে শিক্ষা শুধু মাত্র জ্ঞানার্জন বা জীবিকার্জনের জন্য নয় বরং তার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে চরিত্র গঠন। আজ থেকে বহুবছর পূর্বে শিক্ষা ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। ধর্মীয় শিক্ষায় ছিল সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের বাণী আর ছিল চরিত্র গঠনের মূলমন্ত্র। শিক্ষার ক্ষেত্র বিস্তৃতি লাভ করার পর ধর্মের গন্ডি পেরিয়ে তা বৈষয়িক হতে থাকলো। আধুনিক শিক্ষার হাত ধরে আসলো আধুনিক সভ্যতা। শিক্ষায় শুরু হলো প্রযুক্তির ব্যবহার। আর সম্পূর্ণ অর্থনীতিই যেন ঝুঁকে পড়লো শিক্ষার দিকে। শুরু হলো শিক্ষা বাণিজ্য।

আর যোগ্যতার মাপকাঠি হয়ে গেল প্রাতিষ্ঠানিক সনদ। শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যই এখানে ব্যাহত হয়, যখন চারিত্রিক সনদ নেই।চরিত্রের সনদ দরকারও হয় না।কিন্তু শিক্ষা যখন শুধু মাত্র কর্মের উদ্দেশ্যেই হয় তখন সভ্য হওয়াটা গৌণই থেকে যায়।আমাদের শিক্ষার মাধ্যমে সকলক্ষেত্রে উন্নতি ঘটেছে,সাথে দুর্নীতিরও বিস্তার হয়েছে।কারণ যে শিক্ষা আমরা শুধুমাত্রই জীবিকার জন্য অর্জন করি সেখানে নৈতিকতার পরিমাণ অতি স্বল্প। প্রকৃত জ্ঞানীরা কখনও অনৈতিক হন না।

যুগের চাহিদা মতো শিক্ষার প্রসার, বিস্তারের পাশাপাশি এটাও খেয়াল রাখা উচিত যে,আমাদের নৈতিকতার অবক্ষয় যেন না ঘটে।শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবহার করতে হবে।বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলতে গেলে,উচ্চশিক্ষিতরাই দুর্নীতির শীর্ষে। আগেই বলা হয়েছে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। জাতির মেরুদণ্ডই যদি অসৎ হয় তাহলে জাতি ঘুরে দাঁড়াবে কীভাবে? বিশেষ করে আমলাতান্ত্রিক ক্ষেত্রগুলোতে শিক্ষার অপব্যবহার হচ্ছে। একজন কর্মকর্তা তার প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা দিয়ে কর্মে নিয়োগ পাচ্ছে, যদিও তার সততার বা নৈতিক যোগ্যতা নেই।

শিক্ষা বাণিজ্যে কিছু পাঠ গলাধকরণ করানো হয়,পরিশেষে মোটা কাগজের একটি সনদ প্রদান। কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পূর্বে নৈতিক শিক্ষা চর্চার অভাবেই ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি চলছে। আমরা বই পড়ি জ্ঞানার্জনের জন্য নয়, পরীক্ষায় পাস আর একটি ভালো চাকুরীর লোভে।

দেশের বড় বড় যত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড রয়েছে, সবগুলোতেই সম্পৃক্ত রয়েছে উচ্চশিক্ষিত একটি মহল।কাগজে-কলমে শিক্ষিত হলেই হবে না। শিক্ষার মাধ্যমে নিজের মধ্যে সততা, মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে। তাহলেই কেবল একটি সুস্থ শিক্ষিত সমাজ গড়ে উঠবে। পাঠ্য বইয়ের সীমানা অতিক্রম করে অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক বই পড়ায় মনোযোগ দিতে হবে।

লেখক: হাবিবুল্লাহ আল মারুফ
শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ