আমার শৈশবের ঈদ স্মৃতি পানসে-বর্ণহীন

 জান্নাতুল ফেরদৌস
 জান্নাতুল ফেরদৌস  © টিডিসি ফটো

রোজার মাস ঈমানদারদের জন্য অসীম রহমত ও ফজিলতের মাস। এ মাসে ধনী-গরীব প্রায় সকলেই ঘরে ঘরে মিলাদ পড়ান এবং ইফতারের সময় আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানান, যেন তাঁদের অতীতের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। রোজার মাসের শেষের দিকে ঘরে ঘরে ঈদ আসে খুশির বার্তা নিয়ে। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব মিলে সবাই দুএক দিনের জন্য হলেও নির্মল আনন্দে মেতে ওঠে।

রোজার মাসের শেষের দিকে শুরু হতো গুঞ্জন, এবার রোজা একটি কম হবে নাকি ৩০টি হবে। এটাই ছিল আলোচনার শীর্ষ শিরোনাম। শেষ রোজার দিন মাগরিবের নামাজের পরে চাচাতো ভাইয়েরা মসজিদ থেকে সবাই বের হতো চাঁদ খুঁজতে। পশ্চিম-আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা অধীর আগ্রহে সবাই মিলে ঈদের এক ফালি বাঁকা চাঁদ খুজতো। জীবনে কখনো এরকম এক চিলতে চিকন চাঁদ খুঁজে দেখার সৌভাগ্য হয়নি সবার কাছে শুনতাম চাঁদ নাকি এই দেখা যায় তো এই দেখা যায় নেই!

মুহূর্তেই যেন মিলিয়ে যেত। ফের খুঁজে পেলে আঙুল ঘুরিয়ে চিৎকার করে অন্যদেরকে বলতো সে দেখতে পেয়েছে খুশিতে নাচতে নাচতে এক দৌড়ে চলে এসে বাড়িতে সবাইকে বলতো, ঈদ মোবারক।

স্মৃতিগুলো এখনও জীবন্ত, মনে হয় সে দিনের কথা। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। তার মধ্যে ঈদুল ফিতরে আনন্দ আর খুশির মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণ। কারণ দীর্ঘ এক মাসের সংযম,ত্যাগ আর সিয়াম সাধনার পর মুসলমানেরা এই দিনটি খুব আনন্দের সাথে উদযাপন করে। বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ এবং ঈদ উল ফিতর হলো একটি অন্যতম বৃহত্তম উৎসব।

তবুও জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষ ঈদের এই আনন্দে সামিল হয়।সবার মুখে আনন্দের হাসি। সকল দুঃখ-কষ্ট ভুলে অন্তত ঈদের দিনে যে যার সাধ্য মতো খুশিতে মেতে উঠে। তবে সবচেয়ে বেশী খুশি ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি শিশুর মুখে। এ যেন বাঁধ ভাঙা হাসির মেলা।

ছোটরা ঈদের দিন সকাল বেলা গোসল করে নতুন জামা-কাপড় পড়ে সকাল থেকে শুরু করে সারাটা দিন সকল শিশুরা একত্রিত হয়ে যেন মৌমাছির মতো ঘুরে বেড়ায়,দেখেই মনটা আনন্দে ভরে যায়।সবচেয়ে বেশি আনন্দের মুহূর্ত হলো,ঈদের নামাজ শেষে সবাই খুশি মনে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করার দৃশ্য। ধনী গরিব সকল ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করে।

তাই বলে বড়দের আনন্দ যে কম, সেটা ভাবা ঠিক নয়। সারাদিন টো টো করে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে তারা দিনটিকে আনন্দে মুখরিত করে তোলে। সারাদিন ঘুরে ক্লান্ত হয়ে যখন ঘরে ফিরে, তখনও ক্লান্তিহীন ভাবে টেলিভিশনে আনন্দ উপভোগ করে। ঈদ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন চ্যানেল বেশ কয়েকদিন ধরে প্রচার করে থাকে ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।

আমার শৈশবের ঈদ স্মৃতি খুবই সাধারণ, পানসে, বর্ণহীন। ঈদের আনন্দ উপভোগ করার মতো কোন ভাই-বোন ছিল না ছোট বেলায়। তাই অন্য সবার মতো আমার ঈদ আনন্দে কাটতো না। চাঁদ রাতে আম্মুর কাছ থেকে হাতে পায়ে মেহেদী পড়া হতো। ছোটবেলার ঈদ স্মৃতি বলতে, যে কথাটি সবার প্রথমে মনে আসে সেটি হলো, সকল মুসলমান বাড়ির মতো নিজের ঘরে খাবার-দাবারের আয়োজন।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখতাম, আম্মু পায়েস, সেমাই, নুডলস রান্না করে রেখেছে। আর দুপুরের জন্য চলছে পোলাও, জর্দা, বোরহানি, মাছ, মাংস, ডিম, বিরিয়ানির আয়োজন। ছোট বেলায় মনে হতো ঈদ মানে অনেক খাবারের সমাহার। ঈদের দিন সকালে বেলা আব্বু নাস্তা করে ঈদের নামাজ পড়তে চলে যেত।

নামাজ শেষে, বাবার তার ভাই, চাচা, চাচাত ভাইদের, ব্যবসায়ী বন্ধুদের বাসায় নিয়ে আসত। তাদেরকে পায়েস, সেমাই, নুডলস পরিবেশন করা হতো। ভাল লাগত দিনগুলো। ঈদের আমেজ ছড়িয়ে যেত আমাদের ঘরে। ঈদের দিন আম্মু-আব্বুর সাথে সময় কাটানো। বিকালে বাবার হাত ধরে ঘুরতে যাওয়া। রাতে বাসায় এসে আম্মুর সাথে গল্প করে ঈদের দিন পার করতাম।

আমার জীবনের সেরা ঈদ আসে আমার ছোট ভাইকে পাওয়ার পরে। ভাই হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সব ঈদই আনন্দদায়ক। তবে ২০১৯ সালের ঈদই ছিল আমার কাছে ব্যতিক্রম, স্মরণীয়। করোনা মহামারীর প্রকোপে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও এর প্রভাব কম নয়। চলমান সংকটে আতঙ্কিত সময়ের মধ্যে আমাদের সময় পার হচ্ছে।

পৃথিবীর চিত্র বলে দেয়, সব কিছু থমকে আছে। আজ বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার শিখরে আরোহন করেও মানুষের অসহায়ত্ব প্রকাশ পাচ্ছে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের কাছে। আমাদের এবারের ঈদটি স্মরণীয় হিসেবে উল্লেখ করতে চাই। এর মূল কারণ এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে ঈদ উদযাপন আগে কখনো হয়নি।

সুতরাং জীবনের এক কঠিন সময় নিশ্চয়ই অতিক্রম করছি। চলমান বৈশ্বিক মহামারীতে আমাদের আনন্দ, আমাদের খুশি বা ঈদের হাসি সবকিছু থমকে গেছে। চলছে করোনা মোকাবিলা করে টিকে থাকার যুদ্ধ। ঈদ বাড়তি এক অনুভূতি নিয়ে হাজির হয় আমাদের মাঝে। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে মেলবন্ধন তৈরি হয় ভ্রাতৃত্বের।

আমাদের দেশসহ পৃথিবীর কোন দেশই সে বছর ঈদের দিন ঈদগাহে ঈদের নামায আদায় করতে পারেনি। এমনকি নামায শেষে একে অন্যের সাথে কুশলাদি বিনিময়ও করতে পারেনি। আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, আড্ডা দেওয়া আমাদের চলমান সামাজিক প্রথার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

তবে প্রচলিত সহজাত এ চিত্র পাল্টে নতুনভাবে উদযাপন হয়েছিল করোনার ঈদ। ইতিহাসের পাতায় হয়তো সেবছরের পরিস্থিতিতে উদযাপিত ঈদ অমর হয়ে থাকবে। আমরা স্মৃতির পাতা হাতরে হয়তো বা চমকিত হবো সময়ের আবহে। সেবারের ঈদ সীমিত আকারে উদযাপিত ঈদ। সকালে আম্মুর হাতের রান্না মজাদার খাবারের পসরা মনে ধরলো না।

চলমান সংকটে আমাদের দুই-ভাইবোনের মনে আনন্দের পরিবর্তে শঙ্কা বেশি। কেমন যেন গুমোট নিস্তব্ধ পরিবেশ ছিল। কেউ কারো বাসায় যেত না, পরিবারের আপনজন অসুস্থ হলে তার আশেপাশে কেউ থাকতো না, সেবা করতো না। 

আমাদের জীবনে হয়তো এরকম পরিস্থিতি কখনো সৃষ্টি হয়নি মানুষ মারা গেলে জানাযা দেওয়ার মতো মানুষ পাওয়া যেত না। ঈদের দিন আব্বু, ছোট ভাই হালকা কিছু খাবার মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঈদের নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে। করোনা মহামারীর কারণে সেবারে ঈদগাহের পরিবর্তে আমাদের মহল্লার মসজিদে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বল্প পরিসরে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়েছিল।

যা ছিল আমার বাবার জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতা। নামাজ শেষে কোলাকুলি বা হাত মেলানোর প্রথা থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফিরে এসে পরিবারের সাথে সময় অতিবাহিত করতে হয়েছিল সবাই।সার্বিক পরিস্থিতি বলে দেয়, মানুষের মধ্যে চাপা আতঙ্ক অনুভূত হয়েছে।

আনন্দের উচ্ছ্বাস যেন জীবনের শঙ্কার কাছে পরাজিত হয়েছে। এ বিজয় হয়তো বা করোনাভাইরাসের। নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চার করে কাটিয়ে দিলাম ঈদের দিন। দিন শেষে প্রত্যাশা ছিল মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রকোপ থেকে মুক্ত হবে পৃথিবী।

ঈদের যে প্রকৃত দিক হাসি এবং খুশি, তার প্রাণবন্ত উদযাপনে আমাদের উৎসবমুখর সময় অতিবাহিত হবে।আমরা আবারও স্বরূপে উদযাপন করবো ঈদ। দিন শেষে আমার করেনা মহামারীর ঈদ উদযাপন স্মৃতির পাতায় অমর হয়ে আছে। সমৃদ্ধ হলো স্মৃতি, প্রত্যাশার ঝুলিতে কেটে যাক সংকট, মুক্ত পৃথিবীতে হোক মানুষের বিচরণ সেই প্রত্যাশা ছিল মনে।

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল।


সর্বশেষ সংবাদ