‘রাজনৈতিক প্রভাবে’ ডুবছে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল: টিআইবি

হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ
হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ  © ফাইল ছবি

নানা সমস্যায় জর্জরিত রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স নিয়মিত নবায়ন করা হচ্ছে না। সর্বশেষ ২০২১ সালে তিন বছরের বকেয়া নবায়ন একত্রে করা হয়েছিল। হাসপাতালের পরিচালকের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান। পরিচালক পরিবর্তন হলে হাসপাতালের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে—এমন অজুহাতে ঘন ঘন পরিচালক পরিবর্তন করা হয়। এছাড়া রাজনৈতিকভাবে প্রশাসনিক কাজে প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

রবিবার (২৫ জুন) ‘হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (গবেষণা ও পলিসি) মুহাম্মদ বদিউজ্জামান ও মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন টিআইবির কনসালটেন্ট তাসলিমা আক্তার ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (গবেষণা ও পলিসি গবেষণা) মো. মাহ্ফুজুল হক।

প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ক্রয় আইন, তথ্য অধিকার আইন ও মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল সংক্রান্ত আইন অমান্য করলেও হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে  জবাবদিহি নিশ্চিত হয়নি। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও অসম চুক্তিসহ বিবিধ দুর্নীতির কারণে চিকিৎসা সেবার মান নিম্নগামী হয়েছে। সুনাম নষ্ট হয়েছে, রোগীর পরিমাণ ও হাসপাতালের আয় হ্রাস পেয়েছে। ফলে ব্যর্থ হয়ে ক্রমেই একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

হাসপাতালের জন্য পৃথক জনবল কাঠামো না থাকায় অপরিকল্পিত নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতিসহ  মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে কোনও জবাবদিহি নেই জানিয়ে টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি মানবিক সহায়তা সংস্থা এবং রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের অংশ হলেও হাসপাতালটি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকার কর্তৃক অনুদান এবং আয় ও ব্যয়ের হিসাব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে নথিভুক্ত করেনি, যা অংশীজনদের আস্থার সংকট তৈরি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়নি। ফলে হাসপাতালের কার্যক্রমে অস্বচ্ছতা ও অব্যবস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।

আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও সুবিধার ঘাটতি:

হাসপাতালটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রূপান্তরিত হলেও প্রয়োজনীয় সব রোগের চিকিৎসা যেমন- লিভার, গলব্লাডার, পিত্তনালী ও অগ্ন্যাশয়ের অবস্থা নির্ণয়, পাথর অপসারণে ইআরসিপি যন্ত্র, এমআরআই যন্ত্র, চক্ষু ও ডেন্টাল ইউনিটে যন্ত্রপাতি, স্কিনের চিকিৎসায় লেজার যন্ত্র, মেমোগ্রাফি, বায়োপসি, টিবি পরীক্ষার যন্ত্র, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট রোগীকে শক দেওয়ার জন্য ডিফিব্রিলেটর যন্ত্র নেই। বাইপাস সার্জারি, এনজিওগ্রামসহ জটিল রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাও  নেই। এন্ডোসকপি ও কোলোনোস্কোপি যন্ত্রটি পুরনো হওয়ায় সেবা কার্যক্রম ব্যা  হত হয়। ওটিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে।

হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি:

টিআইবি জানায়, হাসপাতালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি রয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে কেবিনে গুমোট গন্ধ, স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল, ফ্যান ও জানালা নিয়মিত পরিষ্কার না করা এবং রাস্তায় রাখা বর্জ্য থেকে কেবিনে দুর্গন্ধ আসাসহ বিবিধ অভিযোগ রয়েছে। কেবিনের রোগীর শয্যার চাদর প্রতিদিন বদলানো হয় না। রোগীর পক্ষ থেকে বলা হলেও পরিবর্তন করা হয় না, এমনকি ভর্তির পর ৪-১৫ দিনের মধ্যে মাত্র একদিন বিছানার চাদর পরিবর্তন করার অভিযোগ রয়েছে।

ভুল চিকিৎসা ও সেবা নিশ্চিতে উপযুক্ত পরিবেশের ঘাটতি:

চিকিৎসা সেবা কাজে ডাক্তার ও নার্সদের গাফিলতি সম্পর্কে অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। যেমন- রোগীর ফাইল চেক না করে সুন্নতে খতনার রোগীর গলার টনসিল অপারেশন, কর্তব্যরত নার্স কর্তৃক নির্ধারিত ওষুধ না দিয়ে অন্য ওষুধ দেওয়ায় রোগীর অবস্থার অবনতি ও আইসিইউতে ভর্তি করানো, ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যু এবং হাসপাতালে বিশৃঙ্খলা ঘটনার অভিযোগ রয়েছে। সেবা কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটানো, চিকিৎসক ও কর্মীদের বেতন অনিয়মিত হওয়া, দীর্ঘদিন গ্র্যাচুয়িটির অর্থ বকেয়ার ঘটনায় কর্মীদের প্রতিবাদ সমাবেশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অবরুদ্ধ করে রাখা, কখনও  রোগীর সঙ্গে নার্সদের খারাপ আচরণ ও জরুরি প্রয়োজনে নার্সকে ডেকে না পাওয়া, রোগী থেকে বখশিশ আদায় ধরনের ঘটনায় রোগীদের মনে উদ্বেগ ও হাসপাতাল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়।

অতিরিক্ত প্রশাসনিক জনবল নিয়োগ:

৫২৮ শয্যার হাসপাতালটিতে ৬৫২ জনের বেশি জনবল রয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ জনের বেশি প্রশাসনিক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগের ফলে প্রশাসনিক কাজে প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

আবার হাসপাতালের প্রাত্যহিক চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনায় চিকিৎসক, নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবলের ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে, নিজস্ব পরিচ্ছন্নতাকর্মীর স্বল্পতা রয়েছে। কর্মরত মোট ৫৫ জনের মধ্যে নিজস্ব মাত্র ১৯ জন। অধ্যাপক ও জুনিয়র চিকিৎসকের স্বল্পতা, বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগের চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং সেবাগ্রহীতাদের অসন্তুষ্টি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সার্বক্ষণিক কনসালটেন্ট রয়েছে মাত্র তিন জন। সার্জারি, আইসিইউ, সিসিইউ, আলট্রাসনোগ্রাম ও রেডিওলোজিতে চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে। হাসপাতালে কর্মরত কর্মীদের ২০৮ জনের সুনির্দিষ্ট কোনও কাজ নেই, যারা অলস সময় ও ছুটি কাটায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

আর্থিক সামর্থ্যের ঘাটতি ও আর্থিক অব্যবস্থাপনা:

গবেষণা প্রতিবেদনে টিআইবি উল্লেখ করে, হাসপাতালের আর্থিক সামর্থ্যের ঘাটতি রয়েছে। একটানা পাঁচ থেকে সাত মাসের বেতন বকেয়া থাকার নজির রয়েছে। গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, ওষুধ কোম্পানির কাছে বকেয়া ওষুধের দামসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা বকেয়া রয়েছে। অবসর নেওয়া ২৩৬ জনের এককালীন গ্র্যাচুইটির অর্থ বকেয়া থাকা আছে। অবসরের পর গ্র্যাচুইটির টাকা এককালীন প্রদানের কথা থাকলেও টাকা না দেওয়ায় ডাক্তার, নার্স ও কর্মীরা আদালতে মামলা করেন।

২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের তথ্যানুযায়ী, বেতন বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি টাকা, প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকার ঘাটতি প্রায় ৮ কোটি টাকা, হাসপাতালের কাছে ওষুধ কোম্পানির বকেয়া প্রায় ৪ কোটি টাকা, অবসরপ্রাপ্তদের গ্র্যাচুয়িটির প্রায় ৩১ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাতে প্রায় ১৮ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে।

বাজেট স্বল্পতায় হাসপাতালের সেবা সম্পর্কিত প্রচারণা কার্যক্রমেও ঘাটতি রয়েছে। স্বল্প পরিসরে লিফলেট, সাইনবোর্ড, ব্যানার তৈরি করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এতে সাধারণ জনগণ হাসপাতালের সুনির্দিষ্ট সেবা সম্পর্কে অবগত হতে পারে না। হাসপাতালের আয়ের সবচেয়ে বড় খাত কেবিন ও সিট ভাড়া। কিন্তু রোগী কমে ৫২৮ শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ রোগী থাকায় হাসপাতালের আয় হ্রাস পেয়েছে।

অনিয়ম ও দুর্নীতি:

সরকারি ও বেসরকারি (বাণিজ্যিক) হাসপাতালের মতো হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেছে টিআইবি। হাসপাতালটির লাইসেন্স ২০২১ সালে তিন বছরের বকেয়া নবায়ন একত্রে করা হয়। লাইসেন্স পুনঃনবায়ন ছাড়াই বর্তমানে হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ২০২১-২০২২ সালের নবায়ন সম্পন্ন না করেই কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।

পরিচালকদের স্বাধীনভাবে কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা:

রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যবস্থাপনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচন করা হয়েছে। চেয়ারম্যানের কথামতো কাজ না করায় হাসপাতাল পরিচালকের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার অভিযোগ রয়েছে। পরিচালক পরিবর্তন হলে হাসপাতালের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে— এমন অজুহাতে ঘন ঘন পরিচালক পরিবর্তন করার ঘটনা ঘটেছে।

নিয়োগ-পদায়ন ও পদোন্নতি:

হাসপাতালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগেও দলীয় প্রভাব, স্বজনপ্রীতি ও পরিচিত বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। চিকিৎসক নিয়োগে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। চাকরিপ্রার্থীদের কাছে জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ চাওয়া হয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক ও সিনিয়র চিকিৎসকের সুপারিশে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে চিকিৎসক ও কর্মচারী নিয়োগেরও অভিযোগ রয়েছে। অদক্ষ কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া এবং নিয়োগকৃতদের সংশ্লিষ্ট বিভাগে কাজের শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার অভিযোগসহ কার্যক্রম পরিচালনায় নিয়োজিত কর্মীদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। পদোন্নতিতে দলীয় প্রভাবের অভিযোগ রয়েছে। কর্মীদের কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন ও পদোন্নতিতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সুশাসন নিশ্চিতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার অকেজো কর্তৃপক্ষকে সক্রিয় করতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি যা আছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে হবে।


সর্বশেষ সংবাদ