তামীরুল মিল্লাতের স্মৃতিমাখা সেই ডাকবাক্সটি আজও রয়ে গেছে

টিনশেডের সাথে ঝুলে আছে ডাকবাক্স
টিনশেডের সাথে ঝুলে আছে ডাকবাক্স  © টিডিসি ফটো

প্রধান তোরণ সংলগ্ন পুরোনো মরিচাধরা টিনশেড ঘরগুলো কর্মচারীদের আবাস হিসেবে ব্যবহার হতো, পরে বসবাস অযোগ্য হওয়ায় স্টোররুম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। আর সেই ঘরের সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা কাঠবাদাম গাছের নিচে টিনশেডের সাথে একটি ডাকবাক্স ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। লোহার শিক দিয়ে লম্বা করে ঝুলিয়ে রাখা ডাকবাক্সটির বয়স প্রায় সাতাশ বছর। আর পুরোনো টিনশেডের বয়সও  একই।

বর্ণনা দিচ্ছিলাম গাজীপুর মহানগরী টঙ্গীর তামীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাকালীন যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত ডাক বাক্সটির কথা। যেটির চল এখন নেই বললেই চলে, তবে স্মৃতিমাখা ডাকবাক্সটি এখনো রেখে দেয়া হয়েছে।

সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখ বিশ্ব চিঠি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। যোগাযোগের অতীত ঘাটলে জানা যায়— সভ্যতার শুরুতে যোগাযোগের জন্য মানুষ বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করতো। চাণক্যের অর্থশাস্ত্রেও দূত মারফত রাজস্বের সংবাদ আদান প্রদানের নিদর্শন পাওয়া যায়। সেই সময় কবুতরের মাধ্যমে রাজকীয় পত্র পাঠানো হতো। জমিদাররা বাহকের মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদান করতো। তবে কাগজ আবিষ্কারের পর চিঠির গুরুত্ব বেড়েছিল।

যত্ন করে নিজ হাতে চিঠি লেখা, তারপর সেই লিখিত চিঠি হলুদ রঙের খামে ভরে ডাকঘরে যাওয়া এবং তারপর সেই চিঠি ডাকবাক্সে ফেলা। তবে বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার ফলে মানুষের অনেক উপকার হয়েছে। তাছাড়া আজকাল মানুষের কর্মব্যস্ততাও বেড়েছে। এত সময় নিয়ে, এত ধৈর্য নিয়ে চিঠি লেখা এবং সেটা ডাকবাক্সে ফেলার মতো সময়ও হয়ত মানুষের নেই।

তৎকালীন সময়ে যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল হাতে লেখা চিঠি। হাতে লেখা চিঠির জায়গায় আজ মোবাইলের ম্যাসেজ, ম্যাসেঞ্জার, ই-মেইল, টেলিগ্রাম বা কুরিয়ার স্থান দখল করে নিয়েছে। স্থান পরিবর্তনই প্রকৃতির নিয়ম।

একটি চিঠি কেবল আবেগের বিষয়ই ছিল না। একটি চিঠিতে শেখার মতো অনেক কিছুও ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ব্যক্তির হাতের লেখা এবং শব্দ ও ভাষার প্রয়োগ। ছেলে যদি বাবার কাছে চিঠি লিখতো তাহলেও চিঠির যথাযথ নিয়ম মেনেই লিখতো। এতে তার যোগাযোগের সাথে সাথে লেখাপড়ার কাজটিও অনায়াসেই হতো। আজ যেমন মোবাইলে ফোন করে অনায়াসেই বলে দেয়া যায় তখন তা চিঠির মাধ্যমে জানাতে হতো।

যোগাযোগ মাধ্যমে ডিজিটালের ছোঁয়া লাগায় লিখিত চিঠি বর্তমান যুগে বিলুপ্তপ্রায়। ডাকবাক্সে চিঠি ফেলে দিয়ে কবে তার আপনজন সেই চিঠি পাবেন সেই অপেক্ষা এখন আর কেউ করেন না। এই বাস্তবতা শুধু তামীরুল মিল্লাতের সেই ডাকবাক্সেই নয় দেশের প্রায় প্রতিটি ডাকঘরের ডাকবাক্সের একই চিত্র।

মাদ্রাসার পুকুরপাড়ে ডাকবাক্স নিয়ে ফটকের পাহারাদার নিজাম উদ্দিন ও বিল্লাল হোসেনের সাথে কথা হয়েছিল বেশ কয়েকদিন আগে। তারা জানিয়েছিল, এই মাদ্রাসা ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। তখন এই অঞ্চলের পুরোটা জুড়ে জঙ্গলে ভরপুর ছিল। এরপর আস্তে আস্তে জনবসতি গড়ে উঠতে থাকায় মানুষের আনাগোনা বৃদ্ধি পায়। তখন এই অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল ডাকবাক্স।

মাদ্রাসাটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ডাইনিংয়ের বাবুর্চি হিসেবে কাজ করেন আব্দুল আজিজ। বয়স পঁয়ষট্টি থেকে সত্তরের মধ্যে। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে আসতো। তখন যোগাযোগের একমাত্র পদ্ধতি ছিল হস্তলিখিত চিঠি। ছাত্রাবাসের ছাত্ররা চিঠি লিখে বক্সে ফেলে যেতো। সপ্তাহে দুই দিন ডাকপিয়ন আসতো, নতুন চিঠি নিয়ে যেতো আর অপরপক্ষ থেকে প্রেরণ করা চিঠি দিয়ে যেত।

ঢাকা জেলার সাভারের পাথালিয়া ইউনিয়নের ডাকঘর ছিল সেনওয়ালিয়া এলাকায়। দশ থেকে বারো বছর আগে সেখানের ডাকপিয়ন মুরুব্বি খোরশেদ আলমকে দেখেছি। তিনি সাইকেলের বেল বাজিয়ে টুংটাং শব্দ করে হরহামেশাই বিভিন্ন চিঠি দিতে আসতো ইউনিয়নের পাড়ায় পাড়ায়। প্রায় প্রতিদিনই কারও না কারও চিঠি বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ছুটতো সেগুলো বিলি করার জন্য। আজ আর তেমন চোখে পড়ে না।


সর্বশেষ সংবাদ