শিক্ষার মানে পরিবর্তন চাইলে জিপিএ তুলে দিতে হবে

  © টিডিসি ফটো

ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক। দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থা, করোনাকালে অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বাজেট পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস’র সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবদুর রহমান

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: করোনা সংক্রমণ দেশের অর্থনীতির সব হিসাব-নিকাশই পাল্টে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটটি কেমন হওয়া উচিত ছিল?
ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ: আমি আশা করেছিলাম প্রতিবারের ন্যায় এবারের বাজেট গতানুগতিক হবে না। করোনা সংকটের কারণে অর্থনীতি প্রচণ্ড চাপে আছে। এছাড়া বিশ্বমন্দার বিষয় তো আছেই। এই প্রেক্ষাপটে সংকট উত্তরণে আমরা একটা কর্মপরিকল্পনা বা অ্যাকশন প্ল্যান আশা করেছিলাম। সেটি পাইনি। সে ক্ষেত্রে বলব, আশাহতই হয়েছি।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের এবারের বাজেট ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। কিন্তু আমাদের এত বড় বাজেটের দরকার ছিল না। কারণ বড় বাজেট বেশি দেওয়া মানে সেখানে দুর্নীতি বেশি হওয়া। আর আমাদের দেশে হিসেবে তিন বা সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা হলেই এখন যেভাবে অর্থনীতি আছে ওইভাবেই চলবে। বড় বাজেট ভালো যদি আমাদের ইনকাম থাকে। যেহেতু এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতি মন্দা যাচ্ছে তাই বাজেট কম হলে ভালো হয়।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশ হিসেবে একদিকে সরকার অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করছে, অন্যদিকে ইন্টারনেটের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে আপনার অভিমত কি?
ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ: দেখুন সরকারকে কোন না কোন সেক্টর থেকে টাকা ইনকাম করতে হবে। আমরা সবাই অধিক হারে চাচ্ছি। এজন্য সরকার এই সেক্টরকে বেছে নিয়েছে। কারণ ভ্যাট বাড়ানো হলেও আমরা এর ব্যবহার কমাবো না। যদিও আমরা সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি না, কিন্তু সরকারের উপায় নেই।

এই পরিস্থিতিতে যদি খাদ্যের দাম বাড়ানো হয়, তাহলে তো মানুষ না খেয়ে মরবে! এক্ষেত্রে আমি শিক্ষার্থীদের বলবো, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় যেন ব্যবহার না করে। তবে সরকারের নজর দেওয়া উচিৎ হবে মানুষ যে পরিমাণ টাকা দিচ্ছে, যেন সে অনুযায়ী সঠিক সেবা পায়। তাহলে মানুষের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় ০.০১ শতাংশ বেশি। বিষয়টি সম্পর্কে আপনার ভাবনা কি?
ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ: আমাদের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাখাতকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কিন্তু প্রতি বছর শিক্ষা খাতে আমাদের যে বরাদ্দ, তার প্রায় পুরোটাই ব্যয় হয় বেতন-ভাতা ও অবকাঠামো উন্নয়নে। শিক্ষা উপকরণ, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের বিষয়টি উপেক্ষিত। আপনি দেখুন, দেশে ঝাঁকে ঝাঁকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে অথচ শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

দেশের বিভিন্ন স্নাতক পর্যায়ের কলেজগুলোয় দেখা যায়, ১ম বর্ষে ক্লাস হলেও ২য়, ৩য়, ৪র্থ বর্ষে প্রায় ক্লাস হয় না। আর হলেও শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে হয় বা কোচিং করতে হয়। এক্ষেত্রে কিন্তু সরকার যে পরিমাণ খরচ বহন করছে, তার চেয়েও একজন শিক্ষার্থী খরচ আরও বেশি হচ্ছে। কারণ শিক্ষকরা বেতন বোনাস নিচ্ছে অথচ ক্লাস করাচ্ছে না।

বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা একজন শিক্ষার্থী ইংরেজিতে দুমিনিট কথা বলতে পারে না। একটা দরখাস্ত লিখতেও হিমশিম খায়। এই জন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের পরিক্ষামুখী না করে পড়াশোনা মুখী করতে হবে। আর শিক্ষার মানের পরিবর্তন করতে হলে জিপিএ বা সিজিপিএ তুলে দিতে হবে। শুধু পাস আর ফেল পদ্ধতি চালু করতে হবে। একটা নিদিষ্ট নাম্বার দেওয়া হবে তা পেলে পাশ না হয় ফেল।

কারণ আমাদের শিক্ষার্থীদের কিন্তু চাকরির জন্য পরীক্ষা দিতে হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়। তাহলে জিপিএ পদ্ধতি সেখানে কোন কাজে আসছে না। মেধার প্রমাণ দিতে হচ্ছে। জিপিএ না পেয়ে অনেকে হতাশাগ্রস্ত হয়, আত্মহত্যা করে আবার অনেকে টাকার বিনিময়ে ও জিপিএ ক্রয় করে নিচ্ছে। তাই শিক্ষার্থীদের প্রতি নজর দিয়ে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হবে আমাদের।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: করোনাভাইরাস মহামারির কারণে স্বাস্থ্যখাতে এতদিন কতটা কম মনোযোগ দেয়া হয়েছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাই বিভিন্ন মহল থেকে এ খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়ার দাবি উঠেছিল। কিন্তু এবারের বাজেটে গত অর্থ বছরের তুলনায় তিন হাজার কোটি টাকার মতো বেশি। বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?
ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ: স্বাস্থ্যখাতের যে বাজেট সেটা, করোনা হোক আর করোনা ছাড়া হোক, সেটা নির্ধারণ করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যেহেতু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চাইতে পারেনি। সেক্ষেত্রে সরকার ২৯ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এছাড়াও, করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় যে কোনো জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্যে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

দেখুন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে প্রতি বছর যে বাজেট দেওয়া হয় তার ২৪-২৫% খরচ তারা করতে পারে না। আপনারা জানেন, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও, পরবর্তীতে তা সংশোধন করে ২৩ হাজার ৬৯২ কোটি টাকায় কমিয়ে আনা হয়েছে৷ শেষ পর্যন্ত সেই বরাদ্দের পুরোটাও খরচ করতে পারেনি মন্ত্রণালয়৷ অবশ্য এই না পারার জন্য অন্যান্য মন্ত্রণালয়ও সম্পৃক্ত আছে।

এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেটের যে সমস্যাটা সেইটা হচ্ছে যতদিন পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট চাওয়ার ক্ষমতা এবং সুষ্ঠুভাবে খরচ করার ক্ষমতা না হবে, ততদিন আমরা যতই বলি না কেন- বাজেট বাড়ানোর সুযোগ সরকারের নেই। সরকারের উচিৎ হবে কর্মকর্তদের কে আগে প্রশিক্ষিত করা। তাহলে তারা তাদের চাহিদা মেটাতে কেমন বাজেট লাগবে তা বলতে পারবে। কারণ স্বাস্থ্য বিভাগ অন্যান্য বিভাগ থেকে আলাদা। দক্ষ জনবল না হলে উন্নয়ন সম্ভব না।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এবারের সংকটে দেখা গেল কৃষিই অর্থনীতির ধাক্কাটা সামাল দিয়েছে। কিন্তু কৃষিতে সরকারের সহায়তা যথেষ্ট বলে মনে করেন কি?
ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ: কৃষি আমাদের একমাত্র ভরসা। আমাদের খাদ্যের যোগান দিয়ে থাকে। যদি ফসল ভালো হয় তাহলে কিন্তু দুর্ভিক্ষ হবে না। দেখা যায় প্রতিবার বাজেটে কৃষি খাত খুব বেশি মনোযোগ পায় না। আর কৃষকদের জন্য যে বাজেট দেওয়া হয় তা ও যদি কৃষকের পৌঁছাতে পারে তাহলে মোটামুটি কৃষকের কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে। আমরা কিন্তু কৃষিভিত্তিক শিল্প ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও আমরা কর্মসংস্থান বাড়াতে পারি। আর সরকারকে কৃষি উপকরণের দাম কমিয়ে দিতে হবে। তাহলে কৃষি খাত আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: করোনা সংকটের কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী শ্রমিকেরা ফেরত আসছেন। তাঁদের জন্য বাজেটে কিছু নেই?
ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ: প্রবাসী শ্রমিকেরা বিদেশ থেকে যে অর্থ পাঠায়, তা দিয়েই তাদের পরিবারের অর্থনীতির চাকা সচল থাকতো। প্রায় ১০ লাখের মতো শ্রমিক ফিরে আসতে পারেন। এরা দেশে ফিরে যেন আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন, সে জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ব্যাংক থেকে সরকারই বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণ নিলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা ঋণ পাবেন কী করে?
ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ: আমি মনে করি, ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের বেশি ঋণ নেওয়া ঠিক হবে না। আর সরকার কিন্তু শুধু ব্যাংক থেকে নিচ্ছে না। সাথে আমরা পোস্ট অফিসে যে সঞ্চয় জমা রাখি সেখান থেকেও নিচ্ছে। যদি সরকার পোস্ট অফিসে সঞ্চয় পদ্ধতি চালু না করতো তাহলে আমরা ব্যাংকে রাখতাম। এজন্য ব্যাংকের অর্থনৈতিক অবস্থা দু’ভাবে দুর্বল হচ্ছে। তাই সরকার আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সহজ কিস্তির ঋণ (সফট লোন) নিতে পারে। কিন্তু সাপ্লাই-ক্রেডিট ঋণ নেওয়া ঠিক হবে না।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় প্রতিবছর কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও কোনও লাভ হয়নি। সেক্ষেত্রে ২০২০-২১ অর্থবছরে কি এই সুযোগ সুফল বয়ে আনবে?
ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ: প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকাকে অর্থনীতির মূলধারায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্কে শিল্প স্থাপনে কালো টাকা বিনিয়োগ করা যাবে। এক্ষেত্রে মাত্র ১০ শতাংশ আয়কর দিলে অর্থের উৎস সম্পর্কে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কোনো প্রশ্ন করবে না। এখন কথা হচ্ছে, সুফল বয়ে আনতে হলে আমাদেরকে ভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রথমত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর হতে হবে। কারণ দুর্নীতি করে যে টাকা আয় করে তার ভ্যাট দিতে চায় না। তাই কালো টাকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাহলে আগে আমাদেরকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকেও ধন্যবাদ।