পিছিয়ে থাকা লোকরাই হিংসা করে

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের তরুণদের বৃহৎ একটা অংশ যখন চাকরি নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতির বই নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটায়। ঠিক সেসময় তরুণদের কেউ কেউ সাহিত্যচর্চা ও গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেছে। এমনই একজন তরুণ হলেন ইমরান মাহফুজ। ইমরান মাহফুজ একজন তরুণ কবি, লেখক ও গবেষক। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দীর্ঘস্থায়ী শোকাসভা’র জন্য তিনি বেশ পরিচিত লাভ করেছেন। তিনি পচিশ্চবঙ্গের যুগসাগ্নিক কাব্য সম্মাননা ও আবুল মুনসুর আহমেদ গবেষণা পুরস্কার পেয়েছেন। এম এম মুজাহিদ উদ্দীন তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন। সাক্ষাতকারে উঠে এসেছে তার লেখালেখি ভালোবাসা জীবন মৃত্যু প্রভৃতি নিয়ে তার চিন্তা চেতনা।

প্রশ্ন: আপনার লেখালেখির শুরুটা কীভাবে?
ইমরান মাহফুজ: প্রথমে ভগ্নিপতি সাইফুল ইসলাম মনিরকে দেখে উৎসাহিত হই। তিনি কবি ও কথাশিল্পী। কিন্তু তাঁর পূর্বেই মায়ের মুখে কবিতা পাঠ, কথায় কথায় শ্লোকবলা ও তার বিশ্লেষণ (বড় হয়ে জানলাম তা লোকজ সাহিত্য) আমায় ভাবাতো। বাবাকে দেখতাম পুঁথিপাঠ ও দিনলিপি লেখার অভ্যাস আজ অব্দি। এটা ভালো লাগা কাজ করে ভীষণ। অন্যদিকে মায়ের কাপড় কেনা ও বাবার লুঙ্গি কেনার সাথে একগাদা পত্রিকা পেতাম তাতে ছোটদের পাতা, সাহিত্য পাতা ও সম্পাদকীয় পড়ার একটা দারুণ সুযোগ তৈরী হয়। পাঠ্যবইয়ের কবিতা ও গল্প পড়েই ২০০৫ সাল থেকে লেখার সাহস করি। তারপর স্থানীয় পত্রিকা সাপ্তাহিক চৌদ্দগ্রামে ‘ধূমপান’ শিরোনামে একটি ছড়া লিখি। ধীরে ধীরে দৈনিক ফেনীর সময়, স্বপ্তনীল, কবিস্বরের সাথে যুক্ত হই। যাতায়াত বেড়ে যায় ফেনীতে। দুই কবি বন্ধুর সাহসে ২০১০ সালে নিজ উদ্যাগে বের করি কালের ধ্বনি। এর সাঁকো বেড়ে কবিতা গবেষণা ও সম্পাদনা চলছে তো চলছে।

২০১২ ও ১৩ তে আদিবাসী সাহিত্য, কবিতা ও কবিতা ভাবনা সংখ্যা, ২০১৪ কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন ক্রোড়পত্র, ফেব্রুয়ারি ২০১৫-তে বেরিয়েছে ৫ম সংখ্যা। সমকাল এবং উত্তরকালে প্রাসঙ্গিক রাজনীতিক-সাহিত্যিক ও সমাজচিন্তক আবুল মনসুর আহমদকে ঘিরে বিপুলায়তন আয়োজন সত্যিই চমকপ্রদ ঘটনা- যা ভাবিনি কোনোদিন। আগে ৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হলেও বিষয়গুণে ও সম্পাদনা চাতুর্যে সংখ্যাটি বিশেষ ও অনন্য বলে জানিয়েছেন পাঠকমহল। পরেই আসে কবি ও নজরুল গবেষক আবদুল কাদির ও বাংলা বাঙালির কবি জসীম উদদীন সংখ্যা। এর মাঝে বের হয় প্রথম কাব্যগ্রস্থ ‘দীর্ঘস্থায়ী শোকসভা’ (ঐতিহ্য)। এটি বর্তমানে তৃতীয় মুদ্রণ ও দ্বিতীয় সংস্করণ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।

প্রশ্ন: বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখকদের প্রচারণাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ইমরান মাহফুজ: এক দশকের বেশী সময়ে যোগ হয়েছে ফেসবুক। এটি অবশ্যই ভালোভাবে দেখি এবং দেখতে হবেও। সময়ের জনপ্রিয় মাধ্যমে (পোস্ট ও কমেন্টে) রুচিশীলতার বর্হিপ্রকাশ ঘটে। তাতে উঠে আসে নানান শ্রেণী পেশার গল্প। আর মানুষ গল্প বলতে ও শুনতে ভালোবাসে। আর জীবনের গল্পে সময় হাওয়ায় ওড়ে। তা সহজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পেলে ত কথাই নেই। তবে সৃজনশীলরা যে কোনো তথ্য ও তত্ত্ব খেয়াল করে রুচিশীলভাবে প্রকাশ করাটাই কাম্য।

প্রশ্ন: লেখালেখি করতে গিয়ে নিশ্চয় অনেকের সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। সে বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখেন?
ইমরান মাহফুজ: বৃত্ত ভাঙতে হলে বৃত্তের বাইরে যেতে হয়। বিদ্রোহী হতে হয়। নজরুল যদি বৃটিশদের সাথে বিদ্রোহীতা না করতেন তাহলে ‘বিদ্রোহী’ পেতাম কিনা সন্দেহ। প্রতিটি বৃত্তই কিন্তু একটা বিদ্রোহ দাবি করে। আমার জন্ম ৯০’র দশকে। বাবার জন্ম আমার জন্মের অনেক আগে। ফলে স্বাভাবিকভাবে বাবার এবং আমার চিন্তা ফারাক অনেক। এবং স্বাভাবিক ভাবে সংঘাত বা অভিমান পরিবার ও সমাজের সাথে। আর গতানুগতিক ভাবনার বাইরে আমি আমি হয়ে উঠতে চাইছি- কবিতা গল্পে কালের কন্ঠস্বর। এই মিছিলে যারা এগিয়ে যাবে, আন্তরিকভাবে কাজ করবে, পিছিয়ে থাকা লোকরাই হিংসা করে, করবে তাদের। এক জীবনে বাঁধা আসলে টপকাতে হবে কায়দা করে। আর কায়দা করে বেঁচে থাকার নামই জীবন।

প্রশ্ন: ভালোবাসা বলতে আপনি কী বোঝেন?
ইমরান মাহফুজ: যেকোন ভালোবাসা একটা শক্তিঘর। আর আমি ভালোবাসায় হাঁটতে চাই কুয়াশাভেজা পথ! তাছাড়া প্রকৃত কবি স্বভাবতই নিঃসঙ্গ ও অসহায়। কিন্তু অবিনশ্বর শক্তিতে একজন কবি জীবনান্দ ধরে রাখে সর্বক্ষণ। তাই মৌলানার মন হৃদয় পোড়ে খ্যাতির মোহে নয়- মনানন্দে লিখি এবং ভালোবেসে ঘর সংসারের স্বপ্ন দেখি।

প্রশ্ন: আপনার কাছে জীবনের মানে কী?
ইমরান মাহফুজ: মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে জিজ্ঞাসা- কেমন জীবনের রঙ? কী তার জবাব, আজও তা অধরা। কোরআনে পাই- ‘আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি নাপাক বস্তু থেকে’। অথচ ফ্রঁসেস্কো রেডি এবং লুই পাস্তুর বলেন- জীবন থেকে জীবনের সৃষ্টি। তারপর প্রাচীন ভারতের বেদে- পৃথিবীতে প্রথম পানির উদ্ভব ঘটে এবং এই পানির মধ্যেই সর্বপ্রথম জীবনের সৃষ্টি হয়। অন্য একটি গ্রন্থে জেনোফেনের তথ্য- মহাসমুদ্রের পানিতে সর্বপ্রথম জীবনের সূত্রপাত ঘটে। কিন্তু ভাবনার দেয়াল টপকে দেখি- বোধের আঙ্গিনায় জীবনের বৈচিত্র্য রঙ। আর নানান খেলায় জীবন। রঙ মেখে সাঁজে সময়ের ডানা। প্রকৃতির মতো বহু রঙে টুকটুক হাঁটে কালের শুদ্ধ শরীল! জলের উপর দেখে আপন পৃথিবী। নিজ আলোয় নড়ে আর চড়ে। কখনো কখনো চুপিচুপি কথা বলে রঙ মেখে নানান ঢঙে। তবে সবার জীবনই শুরু হয় শিশিরভেজা দূর্বাঘাসের মতো। বাবুই পাখির মতো খোলা আকাশে বিচরণের ইচ্ছা। তবে পিপিলিকার মতো পরিশ্রমের মানসিকতা নিয়েই আমার যাপিত জীবন।

প্রশ্ন: মৃত্যুকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ইমরান মাহফুজ: মৃত্যু মানুষের নিঃশ্বাসের মতো নিত্য সঙ্গী। সবাই তা মনে রাখে না। কিন্তু সৃজন মানুষ ভিন্ন! আমি তা নিজের ভিতরের অনভব করে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই জন্মস্বাক্ষর। প্রতিটি লেখকেই চান, তার পদচিহ্ন পৃথিবীতে থাকুক।


সর্বশেষ সংবাদ