উচ্চশিক্ষায় সনদনির্ভরতা কাটিয়ে গবেষণায় জোর দিতে হবে

অধ্যাপক ড. আশিক মোসাদ্দিক
অধ্যাপক ড. আশিক মোসাদ্দিক  © টিডিসি ফটো

অধ্যাপক ড. আশিক মোসাদ্দিক। সম্প্রতি দেশের স্থায়ী সনদপ্রাপ্ত অন্যতম বেসরকারি উচ্চশিক্ষালয় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের এই অধ্যাপক। বিজ্ঞানপ্রিয় পুরোদস্তুর এ গবেষক এর আগে দায়িত্ব পালন করেছেন বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান এবং সৌদি আরবের দাম্মাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি বিভাগে রিসার্চ প্রফেসর হিসেবেও। ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পরপর চারবার বিশ্বখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং এলসিভার সায়েন্স জরিপ অনুসারে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ২ শতাংশ বিজ্ঞানীর একজন হিসেবে স্বীকৃত তিনি। 

‘ইয়াং সায়েন্টিস্ট গোল্ড মেডেল’ অ্যাওয়ার্ডের পাশাপাশি তিনটি বই এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে রয়েছে তাঁর ১৫০টিরও বেশি গবেষণা প্রবন্ধ। দেশের উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, বিজ্ঞানচিন্তা এবং ইস্ট ওয়েস্টকে নিয়ে তার স্বপ্ন-ভাবনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার মুখোমুখি হয়েছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। পাঠকদের জন্য সে গল্প-আলাপের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব তুলে ধরেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক খাঁন মুহাম্মদ মামুন-

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার দেশ এবং দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ এবং প্রদানের অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রেক্ষিত বিবেচনায় বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী থাকবে?
ড. আশিক মোসাদ্দিক: পৃথিবীর প্রায় ৮টি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। আমি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং সেখানে আমার শিক্ষকতা করারও সুযোগ হয়েছে। এর বাইরে আমি বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছি। বাংলাদেশে আমাদের উচ্চশিক্ষার প্রত্যাশা অনেকটা সনদনির্ভর। এখানে সনদ পাওয়ার জন্যই সব চেষ্টা। দেশের বাইরে এমনটি না করে হাতে-কলমে শেখা ও শেখানোর সংষ্কৃতি চালু রয়েছে। শিক্ষার বড় জায়গায় হচ্ছে, শেখার আগ্রহ তৈরি করা, অনুসন্ধিচ্ছু করে তোলা। উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে একটি সনদ প্রাপ্তির মানসিকতা পরিবর্তন করা দরকার।

আরও পড়ুন: ইস্ট ওয়েস্টের নতুন প্রো-ভিসি হিসেবে যোগদান করলেন অধ্যাপক আশিক

আমরা কোনো সনদনির্ভর উচ্চশিক্ষা চাই না। সেজন্য শেখার প্রতি আমাদের জোর দিতে হবে। এছাড়া সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলোয়ও আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে আমরা এরিস্টটলের কথা বলতে পারি। তিনি একই সাথে দার্শনিক ছিলেন, আবার জীববিজ্ঞানের জনকও ছিলেন। অর্থাৎ তিনি তার চিন্তাকে কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি। বিপরীতে আমরা সামাজিক মাধ্যমে দেখেছি, শিক্ষার্থীরা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সহজে সনদ পাওয়া যায়—এমন বিষয় জানতে চাইছেন। এমন ধারণার পরিবর্তন করতে হবে। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিশ্বব্যাপী এখন বেশকিছু র‌্যাঙ্কিং করা হচ্ছে; ইউজিসি এখন একটি জাতীয় র‌্যাঙ্কিং করার কথা বলছে। এটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া উচিত?
ড. আশিক মোসাদ্দিক: পৃথিবীতে এখন পাঁচটি র‌্যাঙ্কিং করা হচ্ছে এবং এটি গুরুত্বপূর্ণ। এখন ইউজিসি যে জাতীয় র‌্যাঙ্কিং করার কথা বলছে—সেটি হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি সমতা বিধান হবে। পাবলিক-প্রাইভেট বলে কোনো বিভাজন থাকবে না। এখন বৈশ্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান কোনোভাবেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় কম নয়—কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশিও।

এক্ষেত্রে শিক্ষক, পঠন-পাঠন পদ্ধতিতে আমরা এখন ওবিই বেইজড কারিকুলামে রূপান্তরিত হয়েছি। সেমিস্টার পদ্ধতি, শিক্ষকদের দক্ষতা এবং গবেষণা, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী, গবেষণা, পাবলিকেশন এবং সাইটেশন, সহশিক্ষার সুযোগসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিচ্ছি। 

বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে—জ্ঞান সৃষ্টি, বিতরণ ও বিকাশের জায়গা। এর বাস্তবায়ন করতে পারলেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো র‌্যাঙ্কিং করতে পারে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট এবং সাবেক শিক্ষার্থীদের গুণগত কর্মসংস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। দেশে একটি জাতীয় পর্যায়ের র‌্যাঙ্কিং করা হলে এটি সবার জন্যই ভালো হবে এবং আমরা তা নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী, এটি আমাদের উচ্চশিক্ষার মান বাড়াবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ইউজিসি সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একই অবস্থানে আনার চেষ্টা করছে এবং সেজন্য বেশকিছু পদক্ষেপও নিচ্ছে। এক দশক পর এর প্রভাব কেমন হবে বলে মনে করছেন?
ড. আশিক মোসাদ্দিক: দীর্ঘদিন ধরে আমার দেশে এবং দেশের বাইরের উচ্চশিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সে অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, ইউজিসির এ উদ্যোগ অবশ্যই ভালো। এখন সরকারি-বেসরকারি না বলে অ্যাক্রেডিটেড এবং নন-অ্যাক্রেডিটেড বলা হবে।

ফলে একজন গ্র‌্যাজুয়েটকে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি বিবেচনা করবে—তিনি অ্যাক্রেডিটেড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন কিনা? আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাক্রেডিটেশনের ক্ষেত্রে তার অবকাঠামো, গবেষণা, শিক্ষকদের দক্ষতাসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচিত হবে। এখন আমাদের অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল রয়েছে—তারা এটি করবে।

উচ্চশিক্ষার একটি অন্যতম প্রধান অংশই হচ্ছে গবেষণা। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারির বাইরে গিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের পর্যাপ্ত জনবল, ল্যাব, লাইব্রেরি, প্রকাশনা এবং সংশ্লিষ্ট সকল সুযোগ-সুবিধাগুলো দেখতে হবে। শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি হওয়ার কারণে পিএইচডি অফার করতে পারবে এবং বেসরকারি হওয়ার কারণে তার সকল সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও পারবে না—এটি হওয়া উচিত নয়।

অ্যাক্রেডিটেড হওয়ার জন্য এখন প্রায় ৬৩টি নীতি রয়েছে। আগামীদিনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিবেচিত হবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্রেডিটেড নাকি নন-অ্যাক্রেডিটেড। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে অ্যাক্রেডিটেড হওয়ার জন্য আবেদন করেছে এবং আমরা আশা করছি, খুব দ্রুতই আমরা তা পাব। সুতরাং আগামীদিনে অ্যাক্রেডিটেশনের একটি বড় বিবেচনার বিষয় হিসেবে দেখা দেবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একই অবস্থানে দেখতে চান। এখন দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারিতেও পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে—সেক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া উচিত?
ড. আশিক মোসাদ্দিক: উচ্চশিক্ষা একটি অন্যতম প্রধান অংশই হচ্ছে গবেষণা। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারির বাইরে গিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের পর্যাপ্ত জনবল, ল্যাব, লাইব্রেরি, প্রকাশনা এবং সংশ্লিষ্ট সকল সুযোগ-সুবিধাগুলো দেখতে হবে। শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি হওয়ার কারণে পিএইচডি অফার করতে পারবে এবং বেসরকারি হওয়ার কারণে তার সকল সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও পারবে না—এটি হওয়া উচিত নয়। 

আমি দায়িত্ব নিয়েই বলতে পারবো—আমাদের অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যার স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি দেওয়ার মতোও যোগ্যতা নেই। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অ্যাক্রেডিটেড হলে তখন পাবলিক-প্রাইভেটের বাইরে গিয়ে অ্যাক্রেডিটেড প্রতিষ্ঠানগুলোই পিএইচডি ডিগ্রি দিতে পারবে। এখন আমাদের বিজ্ঞানী তৈরি হচ্ছে না; আমাদের অনেক জনসংখ্যা—কিন্তু পেটেন্টের সংখ্যা বাড়ছে না।

আরও পড়ুন: বিশ্বসেরা গবেষকদের তালিকায় বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭ শিক্ষক, শীর্ষে ড. আশিক মোসাদ্দিক

বাংলাদেশ নেদারল্যান্ডের মতোই একটি নদীমাতৃক দেশ। সেখানে যিনি ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে পড়েন, তিনিও বিজ্ঞান পড়েন, বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করেন। তাদের নাগরিকদের অনেক পেটেন্ট রয়েছে। এখন আমাদের পেটেন্টের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সবার একসাথে কাজ করা উচিত।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি সম্প্রতি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এখানে আপনি কী কী চ্যালেঞ্জ দেখছেন এবং এ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী? 
ড. আশিক মোসাদ্দিক: আমি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি পরিবারে অষ্টম উপ-উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেছি। এখানে নিয়ম-শৃঙ্খলাগুলো খুবই প্রতিষ্ঠিত। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাইকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। আমাদের শিক্ষকরা অনেক মেধাবী, তাদের অনেক গবেষণা রয়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীরাও মেধাবী ও ভদ্র।

এখানে শিক্ষার পাশাপাশি সহশিক্ষারও নানা সুযোগ রয়েছে। আমরা সবাইকে নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও সমৃদ্ধ করতে চাই এবং গবেষণা, ইন্ড্রাস্ট্রি অ্যাকাডেমিয়ার কোলাবরেশন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং অংশীজনদের সাথে সহযোগিতা বাড়াতে চাই। এর বাইরে ক্যাম্পাস বর্ধিতকরণ, নতুন বিভাগ খোলার উদ্যোগ এবং সার্ভিস বাড়ানোর চেষ্টা করবো।


সর্বশেষ সংবাদ