প্রশাসন চাইলে দ্রুত সময়েই ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করতে পারে

রাগীব নাঈম
রাগীব নাঈম  © টিডিসি ফটো

দেশের প্রাচীনতম ছাত্র সংগঠনগুলোর একটি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। ১৯৫২ সালের ২৬শে এপ্রিল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই  বৈষম্যহীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল ধারার শিক্ষানীতির জন্য আন্দোলন করছে সংগঠনটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও ছাত্র ইউনিয়নের ছিল নিজস্ব গেরিলা বাহিনী। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের বেশ প্রভাবও দৃষ্টিগোচরে ছিলো। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দলে বিভাজন সহ বিভিন্ন কারণে বর্তমানে সংগঠনটির কার্যক্রম কিছুটা স্তিমিত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্রসমাজের সমস্যা, প্রত্যাশা, ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্রদের জন্য ভূমিকা, দলের বিভাজন, ডাকসু নির্বাচনের গুরুত্ব সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে কথা বলেছেন ছাত্র ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রাগীব নাঈম । সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাবি প্রতিনিধি খালিদ হাসান—

 

ডেইলি ক্যাম্পাস: একসময় ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র ইউনিয়ন বেশ শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী ছিলো, দিনদিন কি সেই প্রভাব কমে যাচ্ছে? 
রাগীব নাঈম: ছাত্র ইউনিয়ন কখনো ক্যাম্পাসে প্রভাব খাটায়নি। আমাদের কাজ হচ্ছে ছাত্রদের অধিকার আদায় করা। একদম মৌলিক অধিকার আদায় করা। খাদ্য সংকট, আবাসন সংকট শিক্ষার মান নিয়ে আমরা কাজ করতাম। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে বর্তমানে নৈশ কোর্সের প্রচলন ঘটেছে। আমরা মনে করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম বিশেষায়িত কোর্স থাকা উচিৎ না। একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে জনসাধারণের পড়ার অধিকার আছে। বিশেষায়িত কোর্স দিয়ে আমরা তাদের আলাদা করে ফেলছি। আমরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, আমরা চাই এই নৈশ কোর্সের নামে বাণিজ্য বন্ধ হোক।

ডেইলি ক্যাম্পাস: ছাত্র ইউনিয়নের মূল লক্ষ্য কি? 
রাগীব নাঈম: ছাত্র ইউনিয়ন হচ্ছে একটা ছাত্র গণ সংগঠন। যা সবসময়ই সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায়, অন্যায়ের প্রতিবাদ প্রতিরোধ সহ যেসব কর্মসূচি নেয়া প্রয়োজন ছাত্র ইউনিয়ন সেটা নিয়ে থাকে। ছাত্র ইউনিয়ন চায় ক্যাম্পাসগুলোতে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশের পাশাপাশি শিক্ষার মূল ধারাটা অটুট থাকে।

ডেইলি ক্যাম্পাস: বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে কিভাবে দেখছে ছাত্র ইউনিয়ন? এটি কি শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ঘটাবে নাকি শিক্ষার মানকে আরো দুর্বল করবে? 
রাগীব নাঈম: ছাত্র ইউনিয়ন মনে করে একটা দেশে নানা ধারায় প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা চলতে পারে না। দেশে বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যম, কারিগরি শিক্ষা প্রচলিত আছে। এভাবে শিক্ষার্থীদের আলাদা শিক্ষায় ধাবিত করলে বিভাজন সৃষ্টি হবে। তিনজন শিক্ষার্থী তিন রকম শিক্ষা পাবে। এখানে আমরা নানান ধরনের ধারার বদলে একমুখী বিজ্ঞানসম্মত এবং বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে চাই। অন্য ধাঁচের বা ধর্মীয় শিক্ষা ধর্মগ্রন্থ ভিত্তিক আলাদা ভাবে কেউ চাইলে পড়বে, কিন্তু মূল শিক্ষাটা হবে ইউনিক এবং অভিন্ন। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা ভালো হবে সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে ভালো শিক্ষকদের উপরে। শিক্ষকগণ ভালো করে পড়াতে পারলে, বা কারিকুলাম ঠিক করতে পারলে নিঃসন্দেহে ভালো একটি শিক্ষাব্যবস্থা হবে এটি। 

ডেইলি ক্যাম্পাস: এই একমুখী ধারাতে কি ধর্মীয় শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে, নাকি শুধুই বিজ্ঞান সম্মত শিক্ষা থাকবে যেখানে কোন ধর্মীয় শিক্ষা থাকবে না? 
রাগীব নাঈম: ধর্ম আসলে মানার জিনিস, পালন করার জিনিস।  যে যার ধর্মকে পালন করবে অন্যের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে। এখানে তো কোনো সমস্যা নাই।  বাংলাদেশে অনেক ধর্মের মানুষ আছে, তাদের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মগ্রন্থভিত্তিক পাঠ্যপুস্তকও আছে। বর্তমানে নৈতিক শিক্ষার বই প্রকাশ করা হচ্ছে। এটাও একটা ভালো উপায়। কিন্তু মূল হচ্ছে সবগুলো ধারাকে এক করে সমন্বিত শিক্ষার প্রচলন করা। 

ডেইলি ক্যাম্পাস: বর্তমানে নির্দিষ্ট একটি শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাদ দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। অনেকের ধারণা এতে শিক্ষার্থীদের চাপ কমে যাবে। ফলে অনেকেই পড়াশোনা করবে না এবং মৌলিক শিক্ষা অর্জিত হবে না। এ ব্যাপারে ছাত্র ইউনিয়ন কি মনে করে?
রাগীব নাঈম: আমরা আগে দেখেছি একটি বাচ্চা প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হতেও পরীক্ষায় বসতে বাধ্য হতো। সে কোচিং করতো ভালো স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পাওয়ার জন্য। এতে অনেক কোচিং বাণিজ্য বেড়ে গিয়েছিলো। ছোট বাচ্চাদের মনেও পরীক্ষা নামক ভীতির সৃষ্টি হয়েছিলো। এই নতুন শিক্ষা নীতির ফলে এই সমস্যাটা দূর হবে। আবার নিয়মিত এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, ক্লাসে উপস্থিতির উপর নাম্বার, ক্লাসে ভালো পারফর্মেন্সের জন্য নাম্বারের ব্যবস্থা থাকলে কেউ ফাঁকি দিতে পারবে না এবং গুণগত মৌলিক শিক্ষা অর্জন করতে পারবে বলে ছাত্র ইউনিয়ন মনে করে।

ডেইলি ক্যাম্পাস: ছাত্র ইউনিয়নের কাউন্সিলে পরবর্তী নেতৃত্বের জন্য কোন কোন বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দেওয়া হবে? 
রাগীব নাঈম: সারাদেশ থেকে আগত কাউন্সিলরদের আগমন ঘটবে। আমাদের প্রথম খেয়াল থাকবে কোনো ছাত্রকে নেতৃত্বে দেওয়া। ছাত্র নয় বা অনেক আগেই পড়াশোনা শেষ এমন কাউকে নেতৃত্ব দেয়া হবে না এটা আমাদের কাম্য। অবশ্যই যারা দায়িত্ব পাবে, তারা সবাই ছাত্র হবে।  এছাড়াও আমরা তরুণ নেতৃত্বকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হবে। তবে কাউন্সিল কি সিদ্ধান্ত নিবে তারাই ভালো জানেন, আমাদের এখানে তেমন কিছু বলার নেই।

ডেইলি ক্যাম্পাস: ঐক্যবদ্ধ কাউন্সিলের মাধ্যমে কি আপনাদের বিভাজন কমে যাবে বা পুরোপুরি দূর হয়ে যাবে? 
রাগীব নাঈম: আমাদের ৪০ তম কাউন্সিলের বিভিন্ন অসঙ্গতির কারণে ২/৩ অংশ সদস্য রিকুইজিশন কাউন্সিল চায়। তাদের দাবি খারিজ করে দেওয়ার ফলে একটা বিভাজন পরিলক্ষিত হয়। বিভাজন স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরের দুই বছরে বিবাদমান দুই পক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঐক্যবদ্ধ কাউন্সিলের। আশা করি এটার মাধ্যমে বিভাজন দূরীভূত হবে। ইতোমধ্যে বিভাজন দূর করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দুই পক্ষ ঐক্যবদ্ধ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

ডেইলি ক্যাম্পাস:  ছাত্র ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? 
রাগীব নাঈম: আমাদের ভবিষ্যৎ উদ্দেশ্য ছাত্রবান্ধব দাবিগুলোর পক্ষে সরব থাকা। ছাত্রসমাজ সঠিক নেতৃত্বের অভাবে তাদের দাবী সমূহ সামনে প্রকাশ করতে না পারায় তারা অধিকার বঞ্চিত হয়। আমরা এর সমাধান করে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিগুলো প্রশাসন বরাবর উপস্থাপন করে এর সমাধানের চেষ্টা করে যাবো। আমরা খেয়াল রাখবো যেনো পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকতার বাহক হতে না পারে এবং শিক্ষা হয় একমুখী ও বিজ্ঞানসম্মত। 

ডেইলি ক্যাম্পাস:  ডাকসু নির্বাচন সম্পর্কে আপনাদের মতামত কি?
রাগীব নাঈম: দীর্ঘ ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন ২০১৯ সালে বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পার হয়ে সম্পন্ন হয়েছিলো, যেটাকে আমরা বয়কট করেছিলাম। কারণ আমাদের জাতীয় নির্বাচনের যে মডেল যেভাবে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করানো হয়, ম্যানুপুলেট করা হয়, একই মডেল অনুসরণ করা যায় ডাকসুর ক্ষেত্রে।  হলগুলোতে নানান ভাবে প্রভাব খাটানো হয়। কোনো হলে লাইন দীর্ঘ করা হয়, জ্যাম লাগানো হয়। শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক ভোট প্রদানে বাধ্য করা হয়। তাছাড়া অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা হলে এসে ভোট দিতে ভয় পায়। আমরা চেয়েছিলাম নির্বাচন ডিপার্টমেন্ট বা অনুষদভিত্তিক হোক, যেনো শিক্ষার্থীরা নিরাপদে নিজের ভোট যোগ্য নেতাকে দিতে পারে। কিন্তু এই ব্যবস্থা না করায় আমরা সেই ডাকসু নির্বাচন বয়কট করেছিলাম।

বিশেষত ডাকসু কমিটির সাংবিধানিক কথা হলো দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় পরবর্তী ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা। কিন্তু দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার সময়েও, কিংবা দায়িত্ব চলাকালীন সময়ে ডাকসুর সর্বশেষ কমিটি কোনো দায়িত্ব পালন করে নাই বা কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করে নাই।

আমরা মনে করছি, একটা নির্বাচন ২৮ বছর পর হলো, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন সেখানে ভিপি পদ পায়নি। তাই আরেকটা নির্বাচন অবশ্যই প্রশাসন বা সরকার দলীয় সংগঠন দিবে কি না, তা অবশ্যই তাদের স্বার্থ সমুন্নত রেখে, ডাকসু নির্বাচন কতটুকু নিজেদের পক্ষে যাবে সেটা নিশ্চিত করে বিবেচনা করবে। আবার প্রশাসন চাইলে খুব দ্রুত সময়েই আবারও একটি ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করতে পারে। কিন্তু কেন তারা আবার ডাকসু নির্বাচন দিচ্ছে না সেটা তারাই ভালো জানেন।

কিন্তু আমরা যারা শিক্ষার্থীদের পক্ষের ছাত্র সংগঠন আছি, আমরা মনে করি ২৮ বছর পরে আমরা যেভাবে ডাকসু নির্বাচন এনেছিলাম ঠিক তেমনই 'আন্দোলনের মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচন আবারও ফিরিয়ে আনতে হবে'। সেই নির্বাচনের ফলাফল কেমন হবে সেটা পরের বিষয় কিন্তু নির্বাচন হতে হবে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে যে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চা, যেটা অনুপস্থিত আছে সেটার প্রচলন হবে।  শুধু ডাকসু নয়, আমরা সকল প্রতিষ্ঠানেই একই প্রক্রিয়া প্রত্যাশা করি।

ডেইলি ক্যাম্পাস: ধন্যবাদ আপনাকে
রাগীব নাঈম: ধন্যবাদ ডেইলি ক্যাম্পাসকে।


সর্বশেষ সংবাদ