একটা বিছানা, একটি আশা : হার্ট ফেইলিউর ওয়ার্ডে প্রতিদিনের লড়াই

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের  কয়েকজন ভর্তি রোগী
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের কয়েকজন ভর্তি রোগী  © টিডিসি ফটো

হার্ট ফেইলিউর ওয়ার্ড— এখানে সময় যেন ধীরে চলে। প্রতিটি নিশ্বাস, প্রতিটি অপেক্ষা— একেকটি জীবনকে ধরে রাখার যেন শেষ চেষ্টা। কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই বোঝা যায়, প্রতিটি বিছানার পাশে আছে একেকটা জীবনের সংগ্রাম, অপেক্ষা আর নিঃশব্দ প্রার্থনা।

সেই ওয়ার্ডের এক কোণে বসে আছেন ডেমরা থেকে আসা রোজি হোসেন (৩৯)। তিনি তার হৃদরোগে আক্রান্ত স্বামী আবুল হাশেমকে (৫০) নিয়ে এখন হাসপাতালের শয্যাসঙ্গী।

বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) সরেজমিনে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ পরিদর্শনে গেলে এমন চিত্র দেখা যায়।

রোজির চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ, আতঙ্কের ছায়া—তবু ভেতরে এক অদম্য শক্তি। বললেন, ‘গত বছর উনি (স্বামী আবুল হাশেম) মেজর হার্ট অ্যাটাক করছিলেন। এবার ফেব্রুয়ারিতে আবার স্ট্রোক করেন। কক্সবাজার সদর, তারপর ঢাকার ল্যাবএইড—সব জায়গায় ঘুরে এসে এখন এখানে আছে। ওনার হার্টে তিনটা ব্লক ধরা পড়েছে। হার্টের পাম্পিং ক্ষমতাও খুব কম।’

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে রোজি বলেন, ‘ডাক্তার বলছে, এই অবস্থায় বাইপাস বা রিং বসালেও লাভ হবে না। উনি এখন হার্ট ফেইলিউরে আছেন। চিকিৎসা চলছে, যতটুকু সম্ভব তারা করছে। ওষুধ কিছু এখান থেকে দেয় আর কিছু কিনে আনতে হয়। ফ্রিতে কিছু দেয় কি না জানি না, বিল উঠলে বুঝব। কিন্তু যেটুকু মেডিসিন দরকার, আমি কিনে দিচ্ছি।’

হাসপাতালের খাবারের মান নিয়ে তিনি বলেন, ‘হার্টের রোগীদের জন্য ব্রয়লার মুরগি কি উপযুক্ত? রোগী তো সুস্থ হতে এসেছে। তাই খাবারের দিকটা একটু চিন্তা করা উচিত। এটা আমার ছোট্ট একটা অনুরোধ।’

টয়লেট প্রসঙ্গে বললেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মন্দ না কিন্তু টয়লেটের সংখ্যা কম। অসুস্থ মানুষদের জন্য তার সংখ্যা বাড়ানো দরকার।’

লক্ষ্মীপুর থেকে মুহাম্মদ শরীফ (৩৫) তার হৃদরোগে আক্রান্ত বাবা আব্দুর রহিমকে (৬০) নিয়ে আসেন চিকিৎসার জন্য। আট দিন ধরে এই হাসপাতালে অবস্থান করছেন।

শরীফ জানান, তার বাবার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়েছে এবং চিকিৎসকরা রিং পরানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তবে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে প্রায় তিন লাখ টাকার প্রয়োজন, যা তাদের পক্ষে এই মুহূর্তে সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। এ কারণে তারা আপাতত ওষুধ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার চিন্তা করছেন এবং দুই মাসের মধ্যে টাকা জোগাড় করে পুনরায় চিকিৎসা করার পরিকল্পনা করছেন। তবে হাসপাতালে কোনো আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই।

হাসপাতালের খাবার সম্পর্কে শরীফ বলেন, এখানে স্যুপ, জাউ ভাত, ব্রয়লার মুরগি ও মাছ দেওয়া হয়। তবে খাবারে রুচি না হওয়ায় তিনি সেগুলো খান না। টয়লেট ব্যবস্থার বিষয়ে তিনি অভিযোগ করে বলেন, তাদের ব্লকে কোনো টয়লেট নেই। যেটি রয়েছে, সেটি দ্বিতীয় তলায়। প্রয়োজন হলে সেখানে গিয়ে সিরিয়াল ধরতে হয়। তার মতে, পুরো হাসপাতালে রোগীদের জন্য প্রতিটা তলায় পর্যাপ্ত টয়লেটের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

তবে হাসপাতাল প্রশাসনের দাবি, প্রতিটি তলায় পর্যাপ্ত সংখ্যক টয়লেট রয়েছে। রোগীদের স্বজনরা হয়তো বিষয়টি জানেন না। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের রোগীদের টয়লেট ব্যবহারে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলেও উল্লেখ করে প্রশাসন।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইউনিটের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অধ্যাপক মো. ইনুসুর রহমান জানিয়েছেন, দেশের হৃদরোগ চিকিৎসায় একটি নির্ভরযোগ্য কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল।

তিনি বলেন, আমাদের এখানে চিকিৎসাসেবা অত্যন্ত মানসম্মত। মূলত দেশের প্রান্তিক অঞ্চল থেকে বিভিন্ন রোগী এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। তুলনামূলকভাবে কম খরচে উন্নত মানের চিকিৎসা দিতে পারছি বলেই সাধারণ মানুষের মাঝে আমাদের প্রতি আস্থা তৈরি হয়েছে।

বিদেশি পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, বিদেশের হৃদরোগ বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে অপারেশনের ক্ষেত্রে গড়ে প্রতি ১০০ জনে দুই জন রোগী মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু আমাদের এখানে মৃত্যু তেমন হয় না, যা আমাদের দক্ষ চিকিৎসক দল ও পরিকাঠামোর প্রমাণ।

হাসপাতালের জনবল সম্পর্কে তিনি জানান, এখানে বর্তমানে মোট ১ হাজার ৭২২ জন কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে ২৫৩ জন ডাক্তার, ৭০১ জন নার্স, ১৫০ জন হেলথ অফিসার এবং অন্যান্য বিভাগে রয়েছেন ৬১৮ জন কর্মী।

পরিচালকের সরবরাহ করা তথ্যে দেখা গেছে, আউট পেশেন্ট ডিপার্টমেন্টে ১৯৯৯ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণকারী রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ১৯৯৯ সালের প্রথমার্ধে যেখানে রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২০ হাজার, ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজারে—যা প্রায় সাত গুণ বৃদ্ধি নির্দেশ করে।

এই ২৬ বছরের ব্যবধানে হাসপাতালটিতে মোট চিকিৎসা গ্রহণকারী রোগীর সংখ্যা হয়েছে ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ১২। এই ডাটা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের সেবার পরিধি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসচেতনতা ও চিকিৎসা গ্রহণের হার।

অপরদিকে ১৯৯৯ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ১৯৯৯ সালের প্রথমার্ধে যেখানে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ হাজার, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫ হাজারে। এই ২৬ বছরে মোট ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা হয়েছে ৪ লাখ ৩৮ হাজার ৪৫৬ জন—যা চিকিৎসাসেবার পরিধি ও মানুষের আস্থার প্রতিফলন।

একই সময়সীমায় ক্যাথ ল্যাবের রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ১৯৯৯ সালে যেখানে এই ল্যাবে রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ হাজার, ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। দীর্ঘ ২৬ বছরে ক্যাথ ল্যাবের মাধ্যমে মোট ২ লাখ ৭৮ হাজার ৫৮ জন রোগীকে সেবা দেওয়া হয়েছে। এটি হাসপাতালের কার্ডিয়াক নির্ণয় ও ইন্টারভেনশন সক্ষমতার ধারাবাহিক উন্নতির প্রমাণ।

সেই সঙ্গে হার্টের অপারেশনের ক্ষেত্রেও উন্নতির চিত্র স্পষ্ট। ১৯৯৯ সালে যেখানে অপারেশনকৃত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৫০০ জন, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ জনে। এই সময়ে মোট হার্টের অপারেশন হয়েছে ৪৫ হাজার ৫৬টি যার মধ্যে রয়েছে সিএবিজি (করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফট) অপারেশনও।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এই প্রতিষ্ঠানে ওপেন-হার্ট সার্জারি, বাল্ব প্রতিস্থাপন এবং ধমনী ও শিরা সংক্রান্ত (ভাস্কুলার) অপারেশন নিয়মিত করা হয়। পাশাপাশি বাইপাস সার্জারির সুযোগও রয়েছে। শুধু ভর্তি হওয়া রোগীরা নয়, বহির্বিভাগেও প্রতিদিন অসংখ্য রোগী চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে থাকে।

ফাউন্ডেশনটির বিভিন্ন বিভাগে রয়েছে বিশেষায়িত চিকিৎসা সুবিধা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিভাগগুলো হলো—কার্ডিওলজি, কার্ডিওভাসকুলার সার্জারি, অ্যানেসথেসিওলজি, কার্ডিওভাসকুলার রেডিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, প্যাথোলজি, হিমাটোলজি, ব্লাড ট্রান্সফিউশন, এপিডেমিওলজি ও প্রতিষেধক ওষুধ এবং পুনর্বাসন বিভাগ।

কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য হলো হৃদরোগ প্রতিরোধ। এ লক্ষ্যে তারা নানা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষকে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, ধূমপান এবং মানসিক চাপ—এই চারটি প্রধান ঝুঁকির বিষয়ে সচেতন করা হয়।


সর্বশেষ সংবাদ