সরকারি কলেজগুলোতে আইসিটি শিক্ষক সংকট চরমে

বিষয় থাকলেও ৭ বছর ধরে আইসিটি শিক্ষক নেই সরকারি কলেজে
বিষয় থাকলেও ৭ বছর ধরে আইসিটি শিক্ষক নেই সরকারি কলেজে  © ফাইল ফটো

আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী শিক্ষাকে ডিজিটালাইজড করতে ২০১৩ সালে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে আইসিটি বিষয় চালু করা হয়। তবে সরকারি কলেজগুলোতে এ বিষয়ে সাত বছরে আইসিটি সম্পর্কিত শিক্ষক নিয়োগে সুপারিশ পেয়েছেন মাত্র ১৭০ জন। অন্য বিষয়ের শিক্ষক কোনোমতে প্রশিক্ষণ সার্টিফিকেটের জোরে নিচ্ছেন আইসিটির ক্লাস। ফলে হাতে-কলমে শেখার পরিবর্তে মুখস্ত করেই বছরের পর বছর আইসিটি শিক্ষা গ্রহণ করছেন এসব শিক্ষার্থীরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের পদ দ্বিতীয় শ্রেণির হওয়ায় নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে। ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি সরকারি কলেজে আইসিটি বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল পিএসসি। তবে সেখান থেকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে প্রভাষক পদে ১৭০ জন নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছিলেন। আর বেসরকারি কলেজগুলোতে আইসিটি বিষয়ের পদ তৈরি হয় ২০১৮ সালে। বেসরকারিত স্কুল-কলেজে নিয়োগ হয় এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার শতাধিক আইসিটি বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ দিলেও সরকারি কলেজগুলোতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষক সংকট থেকেই গেছে।

যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, সরকারি কলেজগুলোতে আইসিটি বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষে দেড় শতাধিকের বেশি শিক্ষক যোগদানও করেছেন। এছাড়া নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হলে দ্রুতই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, বর্তমানে সিএসই কিংবা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করা গ্রাজুয়েটরা সরকারি কলেজে আসতে চান না বলেই সংকট পিছু ছাড়ছে না।

তবে আইসিটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক উত্তীর্ণদের দাবি, পিএসসির মাধ্যমে সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণেই মূলত তারা এই পেশায় আসতে চান না। এছাড়া যথা সময়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পদ সৃষ্টি না হওয়াও চাকরি না করার অন্যতম কারণ।

আইসিটি বিষয়ে পড়ালেখা করা শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পদ সৃষ্টি না হওয়ার যে অভিযোগ করেছেন; তার সত্যতা মিলেছে পিএসসি’র বিগত কয়েকটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেই। প্রথমবারের মতো ৩৮তম বিসিএসে ২৫৫টি আইসিটি পদের বিপরীতে শিক্ষক নিয়োগ দিতে ২০১৬ সালে সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি। সেটিই প্রথম এবং সেটিই শেষ। এরপর আর কোনো বিসিএসেই আলাদাভাবে আইসিটি বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগের কথা বলা হয়নি।

পিএসসি সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৩৮তম বিসিএসের পর এখন পর্যন্ত ৫টি বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯ এবং ৪২তম বিসিএস চিকিৎসকদের জন্য। বাকি তিনটি বিসিএসের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ৪০তম বিসিএসে বিভিন্ন বিষয়ে  ৮৭০ জন শিক্ষক নিয়োগের কথা উল্লেখ থাকলেও নেই আইসিটি বিষয়ের নাম। ২০১৯ সালে ৪১তম বিসিএসে শিক্ষকের পদ ছিল ৯০৫টি, এগুলোতেও আইসিটি শিক্ষকের কথা উল্লেখ নেই। সবশেষ ৪৩তম বিসিএসের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলেও আলাদাভাবে আইসিটি বিষয়ের কথা বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ নেই।

তথ্যমতে, সারাদেশে সাড়ে ৬ শতাধিক সরকারি কলেজ এবং প্রায় ৬ হাজার ৭০০ বেসরকারি কলেজ রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি কলেজ মিলে উচ্চমাধ্যমিকে প্রায় ২৬ লাখ ছাত্রছাত্রী পড়ালেখা করছেন। তাদের প্রত্যেকেরই আইসিটি বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হয়। বেসরকারি কলেজগুলোতে ২০১৯ সালে আইসিটি বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। তবে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ায় চরম সংকটে পড়েছে সরকারি কলেজগুলো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি কলেজগুলো আইসটি বিষয়ের ক্লাস নিচ্ছেন বাংলা, ইংরেজি, দর্শন এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির শিক্ষকেরা। কিছু কলেজে আবার অর্থনীতি, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা, রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান বা গণিতের শিক্ষকেরা আইসিটি বিষয়ে পড়াচ্ছেন। এই শিক্ষকেরা কয়েক মাসের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তবে সেটি শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট নয়। 

প্রতিষ্ঠান প্রধানরা বলছেন, বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে আইসিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি ব্যবহারিক বিষয় হলেও যথাযথ শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা মুখস্ত করেই প্রোগ্রামিংয়ের মতো বিষয়গুলো খাতায় লিখছেন। ফলে যে উদ্দেশ্যে সরকার আইসিটি বিষয় চালু করেছে সেটি সফলতার মুখ দেখছে না। আইসিটি বিষয়ের শিক্ষক ঘাটতি দূর করতে হলে দ্রুত বিশেষ ব্যবস্থায় শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বগুড়ার একটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা অনুমোদন নিয়ে আইসটি বিষয়ে খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারি। তবে যোগদান করার কিছুদিন পর তিনি অন্য কোথাও চলে যান। তখন অন্য বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে আইসিটি বিষয়ের ক্লাস নিতে হয়।

সরকার যে উদ্দেশ্যে এই কোর্স চালু করেছে সেটি বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারি কলেজগুলোতে আইসিটি বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগের বিকল্প নেই জানিয়ে ওই অধ্যক্ষ আরও জানান, করোনার সময় চিকিৎসক সংকট মেটাতে যেমন বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তেমনি সরকারি কলেজগুলোতে আইসিটি শিক্ষকের সংকট কাটাতে বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে আইসিটি বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এতে করে শিক্ষক সংকট দূর হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও শিখন ঘাটতিও দূর হবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, মুজিব শতবর্ষে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকের ঘাটতি থাকবে না। এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে বেসরকারি স্কুল-কলেজ বিপুল সংখ্যক আইসিটি বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, পিএসসি’র মাধ্যমে আইসিটি বিষয়ের নতুন শিক্ষক নিয়োগের বিষিয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে আইসিটি বিষয়ের শিক্ষক সংকট দূর করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে জানানো হবে।


সর্বশেষ সংবাদ