৩৪তম বিসিএসে ৬৭২ প্রার্থীকে নিয়োগ বঞ্চিত করেছিল আওয়ামী সরকার 

সরকারি লোগো ও পাবলি সার্ভিস কমিশনের কার্যালয়
সরকারি লোগো ও পাবলি সার্ভিস কমিশনের কার্যালয়  © টিডিসি ফটো

সম্প্রতি ৪৩তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েও চূড়ান্ত গেজেট থেকে বাদ পড়েছেন ২২৭ জন চাকরিপ্রার্থী। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে নেটিজেনদের মধ্যে। তবে জানা গেছে, একটি বিসিএস থেকে বাদ পড়ার সংখ্যা এটিই সর্বোচ্চ নয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৩৪তম বিসিএসে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েও ৬৭২ জনকে নিয়োগ বঞ্চিত করা হয়েছিল। যদিও সে সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) জানিয়েছিল, কোটার কারণে ৬৭২টি পদ সংরক্ষণ করা হয়েছিল।

তবে মন্ত্রণালয় এবং পিএসসির এমন দাবি ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছেন নিয়োগ বঞ্চিতরা। তাদের দাবি, ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফলাফলে মুক্তিযোদ্ধা, নারীসহ ৫৬ শতাংশ কোটার প্রয়োগ করা হয়েছিল। বিসিএসের কোনো পরীক্ষার প্রিলিতে এর আগে কোটার প্রয়োগ করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে চাকরিপ্রার্থীরা তীব্র আন্দোলন করলে কোটা বাতিল করে পুনরায় প্রিলির ফল প্রকাশ করা হয়। পরবর্তী লিখিত পরীক্ষার প্রথম দফার ফলাফল সংশোধিত করে দ্বিতীয়বার ফল প্রকাশ করা হয়েছিল। চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের কারণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘নিয়োগ না দিতে মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন’। মূলত এ কারণেই কোটার নামে পদগুলো ফাঁকা রাখা হয়েছিল। যদিও ৩৫তম বিসিএস থেকে ওই পদগুলোতে মেধাতালিকা থেকে নিয়োগ সুপারিশ করেছিল পিএসসি।

জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ৩৪তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হয় ২০১৫ সালের ২৯ আগস্ট। এতে ৮ হাজার ৭৬৩ জন চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন। তাদের মধ্যে ২ হাজার ১৫৯ জনকে বিভিন্ন ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশ করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। যদিও ৩৪তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে পদ ছিল এক হাজার ৫৯২টি। টেকনিক্যাল এবং প্রফেশনাল ক্যাডারের চাহিদা অনুযায়ী পদ পূরণ না করে পুলিশসহ জেনারেল ক্যাডারের চাহিদার চেয়ে দ্বিগুণ পদে নিয়োগ সুপারিশ করা হয়। এর ফলে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েও প্রফেশনাল এবং টেকনিক্যাল ক্যাডারের প্রার্থীরা নিয়োগ বঞ্চিত হন।

‘৬৭২টি পদ শূন্য রেখে নিয়োগ সুপারিশ করার বিষয়টি সম্পর্কে অন্তর্বর্তী সরকার অবগত। তবে এটি সমাধান করতে জনগণের ম্যান্ডেট রয়েছে এমন সরকার অর্থাৎ নির্বাচিত সরকার দরকার। অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে না। যে কারণে বিষয়টি এখনো ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে।’যুগ্ম সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়

৩৪তম বিসিএসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত শূন্যপদ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিজ্ঞপ্তিতে শূন্যপদ ছিল ১ হাজার ৫৯২টি। চূড়ান্ত ফলে নিয়োগের জন্য টেকনিক্যাল ও প্রফেশনাল ক্যাডারে সুপারিশ করা হয় ১ হাজার ১৫৮ জনকে। সে হিসেবে এই দুই ক্যাডারে পদ শূন্য রাখা হয় ৪৩৪টি। কিন্তু পরে কোটা সংরক্ষণ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া প্রজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, শূন্যপদের সংখ্যা ৬৭২। এর মধ্যে, প্রফেশনাল/টেকনিক্যাল ক্যাডার পদে ১১১টি (সহকারী সার্জন ৭৪, সহকারী ডেন্টাল সার্জন ১৩, ভেটেরিনারি সার্জন ১৪টি), সাধারণ শিক্ষা (প্রভাষক, বিভিন্ন বিষয়ে) ক্যাডারে ২৮৮টিসহ ৩৫টি ক্যাডার পদে ৬৭২টি পদ শূন্য রাখা হয়।

২০১৩ সালের ১০ জুলাই ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় বাদপড়া শিক্ষার্থীরা শাহবাগে মানববন্ধ করেন 

চাকরি বঞ্চিতদের অভিযোগ, ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারির ওই প্রজ্ঞাপনে ৩৪তম বিসিএসের ৬৭২টি শূন্যপদ ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে পূরণ করা হবে বলে জানানো হয়। কোটার কথা বলে পদগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছিল। যদিও এর আগে ৩৩তম এবং পরবর্তী ৩৫, ৩৬ ও ৩৭তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফলে কোনো ধরনের কোটা সংরক্ষণ করা হয়নি। এমন কি যে কোটার কথা বলে ৬৭২টি পদ সংরক্ষণ করা হয়েছিল, সেই পদগুলো ৩৫তম বিসিএসের মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হয়। ভালো ফলাফল করেও কেবলমাত্র শেখ হাসিনার কোটা নীতির কারণে নিয়োগ বঞ্চিত হন ৬৭২ জন।

এ বিষয়ে ৩৪তম বিসিএসে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েও নিয়োগ বঞ্চিত মো. আশরাফুল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন,  ‘৩৪তম বিসিএস পিএসসির ইতিহাসে অন্যতম ন্যাক্কারজনক ও কলঙ্কজনক এক অধ্যায়। এটিই ছিল ইতিহাসের প্রথম বিসিএস যেখানে প্রিলিমিনারিতেই কোটা প্রয়োগ করা হয়। কোটার বিরুদ্ধচারণ করে আজকের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূচনাকাল ছিল বলতে গেলে ৩৪তম বিসিএস। কারণ ওই বিসিএসের প্রিলির ফল প্রকাশের আগে কেউ বুঝতে পারেনি যে শুরুতেই কোটা প্রয়োগ করা হয়েছে। এটা বুঝতে পারার সাথে সাথেই শুরু হয় আন্দোলন। এরপর প্রিলির ফলাফল স্থগিত করে আবার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। শুরুতেই কোটা প্রয়োগ করায় এবং ফলাফল পরিবর্তন হওয়ায় একটা জগাখিচুড়ি অবস্থার সৃষ্টি হয় যেটার প্রভাব পড়ে চূড়ান্ত ফলাফলে।’

‘বিষয়টি আমরা অবগত। তবে এটি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। আদালতে বিচারাধীন কোনো বিষয়ে বক্তব্য দেওয়া সমীচীন নয়।’ অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেম, চেয়ার‌ম্যান, পিএসসি

৩৪ বিসিএস ক্যাডার বঞ্চিত ফোরামের সদস্য সচিব জাহিদুল ইসলাম জনি বলেন, ‘আমরা সরাসরি কোটা বৈষম্যের শিকার। ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও আমরা ক্যাডার পদ পাইনি। অন্যান্য বিসিএসে কোটা সংরক্ষণ করা হয়নি। কিন্তু ৩৪তম বিসিএসে কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছে। ৩৪তম বিসিএস কলঙ্কজনক অধ্যায়। কোটা সংরক্ষণের নামে এই বিসিএসে ৬৭২টি পদ খালি রাখে তৎকালীন স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা হাল ছেড়ে দেইনি। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং সফল না হওয়া পর্যন্ত আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো। ২০১৩ সালে আমাদের জার্নি শুরু হয়েছিল, এখনও চলমান।’

৩৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফলের সময় পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন ইকরাম আহমেদ। ৩৪তম বিসিএসে কোটা সংরক্ষণ এবং ৬৭২ জনকে নিয়োগ বঞ্চিত করার বিষয়ে জানতে পিএসসির তৎকালীন চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদের ব্যবহৃত নাম্বারে কল দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপে কল করলে অপরপ্রান্তে তার স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বলা হয়, ‘ইকরাম এখন বাসায় নেই। আপনি দুই ঘণ্টা পর কল করুন।’ তবে এরপর একাধিকবার কল এবং মেসেজ পাঠানো হলেও কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

২০১৩ সালে কোটা বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন চাকরিপ্রার্থীদের বিক্ষোভ

জানতে চাইলে পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বিষয়টি আমরা অবগত। তবে এটি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। আদালতে বিচারাধীন কোনো বিষয়ে বক্তব্য দেওয়া সমীচীন নয়।’

 এ বিষয়ে জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো: মোখলেস উর রহমানকে ফোন দিলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে ফোন কেটে দেন। পরবর্তীতে একাধিকবার কল এবং মেসেজ দেওয়া হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘৬৭২টি পদ শূন্য রেখে নিয়োগ সুপারিশ করার বিষয়টি সম্পর্কে অন্তর্বর্তী সরকার অবগত। তবে এটি সমাধান করতে জনগণের ম্যান্ডেট রয়েছে এমন সরকার অর্থাৎ নির্বাচিত সরকার দরকার। অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে না। যে কারণে বিষয়টি এখনো ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে।’


সর্বশেষ সংবাদ