খেজুর রসের গন্ধে শীতকালে পর্যটনকেন্দ্রে রূপ নেয় ফেনীর যে গ্রাম
- এমএ আরাফাত ভূঞা, ফেনী প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:৫০ AM , আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:৫০ AM

শীত এলেই ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার চরদরবেশ ইউনিয়নের আদর্শ গ্রাম এক ভিন্ন রূপে সেজে ওঠে। খেজুর গাছের রসের টানে দূরদূরান্ত থেকে মানুষের ভিড় জমে যায় এই ছোট্ট গ্রামে। ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগেই গ্রামের পথে দেখা যায় উৎসুক মানুষের ব্যস্ততা। কেউ আসছেন মোটরসাইকেলে, কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে প্রাইভেট কারে, আবার অনেকেই দল বেঁধে পায়ে হেঁটে। গ্রামটি যেন তখন এক উৎসবমুখর মিলনমেলায় পরিণত হয়।
প্রকৃতির নির্মল ছোঁয়া, খেজুর গাছের ছায়াময় পরিবেশ আর গাছিদের দক্ষ হাতে রস সংগ্রহের দৃশ্য মানুষের মনে জাগিয়ে তোলে গ্রামীণ জীবনের এক অমলিন আনন্দ। খেজুরের রসের ঘ্রাণ আর স্বাদ পর্যটকদের মনে এনে দেয় এক অন্যরকম অনুভূতি। গ্রামের এই মধুর সকাল শুধু খেজুর রসের জন্য নয়, বরং মানুষের পারস্পরিক আনন্দ ভাগাভাগি আর নতুন জায়গা ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতাকে স্মরণীয় করে তোলে। এখানে আসা মানুষজন শুধু খেজুর রস সংগ্রহ করেই সন্তুষ্ট থাকেন না, গ্রামের চিরায়ত সৌন্দর্য, মাটি-গাছপালার স্নিগ্ধতা এবং গ্রামীণ ঐতিহ্যের শৈল্পিক পরিবেশও উপভোগ করেন। শীতের এই সময় আদর্শ গ্রাম প্রকৃতি, ঐতিহ্য আর মানুষের আনন্দের এক অসাধারণ উদাহরণ হয়ে ওঠে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামের পথে শুরু হয় এক অন্যরকম ব্যস্ততা। মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা দলবদ্ধ হয়ে মানুষ ছুটে আসে খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য। প্রত্যেকের হাতে থাকে বোতল, আর মন ভরে থাকে তাজা রসের প্রত্যাশায়। গাছিরা দক্ষ হাতে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছে, আর সেই দৃশ্য যেন গ্রামের প্রকৃতিকে এক নতুন রূপ দেয়। রস সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে হাসি-আনন্দে ভরা কেনা-বেচা। ভোর বেলার এই ছোট্ট গ্রামটি তখন রূপ নেয় উৎসবমুখর এক চিত্রে যেন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এক নিবিড় বন্ধন।
জানা যায়, ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলা বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় চরাঞ্চলে আবহাওয়া প্রতিকূল হওয়ার কারণে এখানে চোখে পড়বে সারি সারি খেজুর গাছের উপস্থিতি। এই উপজেলার চরদরবেশ, চরচান্দিয়া ও আমিরাবাদ ইউনিয়নে এই দৃশ্য সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। এক সময় এসব খেজুর গাছ শুধুমাত্র ছায়ার জন্য ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে সেগুলোর রস সংগ্রহ করে তা বিক্রি করা হচ্ছে। খেজুরের রসের প্রতি ভোক্তাদের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন এটি স্থানীয় মানুষের আয়ের অন্যতম উৎসে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আদর্শ গ্রামসহ উপজেলার ৩০ হাজারের বেশি খেজুর গাছ রয়েছে। তার মধ্যে রসের জন্য কাটা হয়েছে ১৮ হাজারের মতো। একটি গাছ থেকে প্রতিদিন গড়ে ৫ লিটার রস পাওয়া যাচ্ছে। এক লিটার রস বিক্রি করে গাছিরা গড়ে দাম পাচ্ছেন ৫০ থেকে ৬০ টাকা। সেই হিসাবে পুরো উপজেলার ১৮ হাজারের মতো গাছ থেকে প্রতিদিন গড়ে রস সংগ্রহ হচ্ছে ৭০ হাজার লিটারের মতো। যার মূল্য প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা।
রস ব্যবসায়ীরা জানান, আদর্শ গ্রামে ২ থেকে ৩ হাজারের অধিক খেজুর গাছ থেকে প্রতিদিন সংগ্রহ হয় ১৫০০ লিটার রস। এ গ্রামের ৫০ থেকে ৬০ জন যুবক রস ব্যবসার সাথে জড়িত। আদর্শ গ্রাম ছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামে গাছ কিনে মৌসুমি ব্যবসা করছেন তারা। এতে উপজেলা পাশাপাশি জেলার বাসিন্দারাও রস নিতে পারছেন সহজে। এছাড়াও এ গ্রামের রস বিশেষ প্রক্রিয়ায় পৌঁছে যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে দেশের অন্যান্য জেলাতেও।
রফিক উদ্দিন এক মৌসুমি রস ব্যবসায়ী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার নিজের ৩০টি গাছ রয়েছে এবং আমি আরো ৭০টি গাছ কিনেছি। প্রতিদিন এসব গাছ থেকে সংগ্রহ করা রস আদর্শ গ্রাম বাজারের পাশাপাশি ফেনী ও আশপাশের জেলাগুলোতে সরবরাহ করা হয়। তিনি আরও বলেন, শীত এলেই সবার একটা লক্ষ্য থাকে। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য সারা বছর প্রস্তুতি নিই এবং শীতকালে ব্যবসা করি।
আদর্শ রসের হাঁড়ির মালিক দেলোয়ার হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শীত আসলেই আদর্শ গ্রামটি যেন এক পর্যটন কেন্দ্রে রূপ নেয়। গ্রামটি তার বিখ্যাত রসের জন্য পরিচিত যা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এই গ্রামের প্রধান আকর্ষণ হল ২ হাজারেরও বেশি খেজুর গাছ যেগুলো থেকে প্রতিদিন ১৫০০ থেকে ২০০০ লিটার রস সংগ্রহ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, রসের মৌসুমে এলাকার তরুণরা উদ্যোক্তা হয়ে রস বিক্রির মাধ্যমে ভালো আয়ের সুযোগ পায়। রস সংগ্রহ ও পরিবেশনায় পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়। গাছের মুখ ঢেকে রাখা হয়, যাতে পোকামাকড় না পড়ে এবং নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। স্বচ্ছ ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে রস প্রক্রিয়াজাত ও পরিবেশন করা হয়, যা গ্রামটির খ্যাতি আরও বাড়িয়ে দেয়।
স্থানীয় মৌসুমি রস ব্যবসায়ী নুর হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শীতকাল আমাদের জন্য বিশেষ একটি মৌসুম। এই সময় খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বিক্রির মাধ্যমে আমরা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আয়ের একটি ভালো সুযোগ পাই। শীতের সকালগুলোতে খেজুর রসের চাহিদা থাকে অনেক বেশি, যা আমাদের ব্যবসাকে আরও চাঙা করে তোলে। এই আয়ের ওপর নির্ভর করে আমাদের অনেকের পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হয়।
গ্রামের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য ও খেজুর রসের টানে প্রতিদিনই ভিড় জমাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। শীতের এই বিশেষ আকর্ষণ উপভোগ করতে কেউ আসছেন মোটরসাইকেল নিয়ে, আবার কেউ পরিবার-পরিজনসহ।
শাখাওয়াত হোসেন নামে এক পর্যটক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আদর্শ গ্রামের কথা অনেক শুনেছি। আজ ভোরে বন্ধুদের সঙ্গে মোটরসাইকেলে এখানে এসেছি। গ্রামটির সৌন্দর্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। অনেক দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এখানে আসে। তাজা খেজুর রস পান করার পাশাপাশি নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়াও সত্যিই আনন্দদায়ক।
আশরাফ উদ্দিন নামের আরেক পর্যটক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহ করা রস এক কথায় অসাধারণ। এটি শুধু স্বাদেই অতুলনীয় নয়, বরং প্রাকৃতিক উপায়ে সংগ্রহ করার কারণে একে নিরাপদও বলা যায়। শহরের কৃত্রিম খাবারের ভিড়ে এই খেজুর রস যেন এক অন্যরকম স্বাদ এনে দেয়। পর্যটক হিসেবে এখানে এসে এই রসের স্বাদ নেওয়া সত্যিই দারুণ অভিজ্ঞতা।
গ্রামের খেজুর রস স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই রস দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করে এখানকার মানুষ জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা এনে দিচ্ছে। শীতের মৌসুমে আদর্শ গ্রামের এই প্রাণচাঞ্চল্য যেন প্রকৃতি, ঐতিহ্য এবং মানুষের আন্তরিকতার এক অসাধারণ মেলবন্ধন।