বছরে একশ কোটি টাকা আয়ের সান্ধ্যকোর্স বন্ধ হচ্ছে আজ!
- ফরহাদ কাদের
- প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১১:৪৮ AM , আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১২:২৩ PM
২০০১ সালে ইভিনিং মাস্টার অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইএমবিএ) কোর্স চালুর অনুমোদন পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের চারটি বিভাগ। মূলত এর মধ্য দিয়ে ইভিনিং প্রোগ্রাম বা সান্ধ্য কোর্সের যাত্রা। ছোট পরিসরে শুরু হলেও খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এসব সান্ধ্য কোর্স। ভর্তিচ্ছুদের ব্যাপক চাহিদা ও মোটা অংকের সম্মানীর সুযোগ থাকায় শিক্ষকরাও বেশ সাড়া দেন এতে। বাণিজ্য অনুষদের দেখাদেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগ ও ইনস্টিটিউটেও একে একে চালু হতে থাকে সান্ধ্য কোর্স। এক পর্যায়ে বাণিজ্যিক কোর্সে রূপ নেয় এসব প্রোগ্রাম। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬টি বিভাগ ও নয়টি ইনস্টিটিউটে ৬৯টি সান্ধ্য প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। এসব প্রোগ্রাম থেকে প্রতি বছর একশ কোটি টাকার বেশি আয় করে বিভাগ ও ইনস্টিটিউটগুলো। যদিও এসব কোর্স বন্ধ করতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আজ বিকালে একাডেমিক কাউন্সিলের বিশেষ সভা ডাকা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৩টি অনুষদের অধীন বিভাগ রয়েছে ৮৪টি। আর ইনস্টিটিউট রয়েছে ১৩টি। সবমিলে বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যার দাঁড়ায় ৯৭টি। এর মধ্যে নিয়মিত প্রোগ্রামের বাইরে সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রাম চালু রয়েছে ৩৫টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে। এ হিসাবে সান্ধ্য কোর্স থাকা বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের তুলনায় না থাকা বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যা অনেক বেশি। সান্ধ্য কোর্স না থাকা বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের বেশির ভাগই সান্ধ্য কোর্স বন্ধের পক্ষে। এছাড়া যৌক্তিকতা যাছাইয়ে গঠিত ডিন পর্যায়ের কমিটির প্রতিবেদনেও সান্ধ্য কোর্স সাময়িকভাবে বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া ডাকসুসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন সান্ধ্য কোর্স বন্ধ না করলে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। সবমিলে সংশ্লিষ্টদের মতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের একাডেমিক কাউন্সিল থেকে সান্ধ্য কোর্স বন্ধের ঘোষণা আসবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডীন নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, “যেসব বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে সান্ধ্য কোর্স রয়েছে, এর বেশির ভাগই শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একটি অংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও খোলা হয়েছে। অনেকদিন ধরেই এসব কোর্স বন্ধের দাবি উঠছে। স্বয়ং রাষ্ট্রপতিও এসব কোর্স বন্ধের কথা বলেছেন। ইউজিসিও নির্দেশনা দিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন। তাহলে সান্ধ্য কোর্স রাখা হবে কার স্বার্থে? আজেকের সভাতেই এ কোর্স বন্ধের ঘোষণা আসছে।”
সান্ধ্য কোর্স থেকে সবচেয়ে বেশি আয় হয় ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের। প্রতি বছর এ অনুষদের ৯টি বিভাগের ৪৫টি ব্যাচে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এসব শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি বছর শুধু কোর্স ফি বাবদই আদায় করা হয় ৭৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
এরমধ্যে ম্যানেজমেন্ট বিভাগে দু’টি সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। এর কোর্স ফি ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এ শাখায় বছরে তিন ব্যাচে ১৮০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। সে হিসেবে বছরে কোর্স ফি বাবদ বিভাগ পায় ৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। অপর একটি কোর্স হলো মাস্টার্স অব হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট। এর কোর্স ফি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ শাখায় বছরে দুই ব্যাচে ১২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। সে হিসেবে কোর্স ফি বাবদ আদায় করা হয় ৩ কোটি টাকা।
একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগে তিনটি সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনেস্ট্রশন। এর কোর্স ফি ৩ লাখ ৮ হাজার ৫শ টাকা। এ শাখায় বছরে তিন ব্যাচে ১৯৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। সে হিসেবে কোর্স ফি বাবদ আদায় করা হয় ৬ কোটি ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫শ টাকা। মাস্টার্স অব প্রফেশনাল ইন একাউন্টিংয়ের কোর্স ফি ২ লাখ ৬০ হাজার ৩০০ টাকা। দুই ব্যাচে ১৩০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। সে হিসেবে ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৩৯ হাজার টাকা আদায় করা হয়। অন্যটি হলো মাস্টার্স অব প্রফেশনাল একাউন্টিং ইন ট্যাক্সেশন। এর কোর্স ফি ৩ লাখ ৬২ হাজার ৮শ টাকা। এ শাখা বছরে দুই ব্যাচে ১২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। সে হিসেবে কোর্স ফি বাবদ আদায় করা হয় ৪ কোটি ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।
মার্কেটিং বিভাগে দু’টি সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু রয়েছে। মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনেস্ট্রশনের কোর্স ফি ২ লাখ ৫১ হাজার টাকা। এ শাখা বছরে তিন ব্যাচে ২২৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করে। ফলে কোর্স ফি বাবদ ৫ কোটি ৬৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা আদায় করা হয়। মাস্টার্স অব প্রফেশনাল মার্কেটিংয়ের কোর্স ফি ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। এ শাখায় বছরে দুই ব্যাচে ১২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। ফলে কোর্স ফি ২ কোটি ৯২ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
ফিন্যান্স বিভাগে দু’টি সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু রয়েছে। মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনেস্ট্রশন এর কোর্স ফি ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এ শাখা বছরে তিন ব্যাচে ২১০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করে। ফলে কোর্স ফি বাবদ ৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা আদায় করা হয়। মাস্টার্স অব প্রফেশনাল ফিন্যান্সের কোর্স ফি ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এ শাখায় বছরে দুই ব্যাচে ১২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। ফলে কোর্স ফি বাবদ ৩ কোটি ১২ লাখ টাকা আদায় করা হয়।
ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগে সর্বোচ্চ চারটি সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। এর কোর্স ফি ২ লাখ ৫১ হাজার টাকা। এ শাখায় বছরে তিন ব্যাচে ২১০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। সে হিসেবে কোর্স ফি বাবদ আদায় করা হয় ৫ কোটি ২৭ লাখ ১০ হাজার টাকা।
মাস্টার্স অব ইন্স্যুরেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্টের কোর্স ফি ২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। দুই ব্যাচে ১২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। সে হিসেবে ৩ কোটি ৪০ লাখ ৮০ হাজার টাকা। মাস্টার্স অব প্রফেশনাল ব্যাংকিংয়ের কোর্স ফি ২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এ শাখায় বছরে দুই ব্যাচে ১২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। সে হিসেবে কোর্স ফি বাবদ আদায় করা হয় ৩ কোটি ৪০ লাখ ৮০ হাজার টাকা। মাস্টার্স অব ট্যাক্স ম্যানেজমেন্টের কোর্স ফি ২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এ শাখায় বছরে দুই ব্যাচে ১২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। সে হিসেবে কোর্স ফি বাবদ আদায় করা হয় ৩ কোটি ৪০ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগে একটি সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু রয়েছে। তা হলো মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। এর কোর্স ফি ১ লাখ ২০ হাজার ৫০০ টাকা। এ শাখায় বছরে তিন ব্যাচে ১৯৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। সে হিসেবে বছরে কোর্স ফি বাবদ বিভাগ পায় ২ কোটি ৩৪ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ টাকা।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগে দু’টি সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। এর কোর্স ফি ২ লাখ ৬১ হাজার টাকা। এ শাখায় বছরে তিন ব্যাচে ১৯৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। সে হিসেবে বছরে কোর্স ফি বাবদ বিভাগ পায় ৫ কোটি ৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। অপর একটি কোর্স হলো মাস্টার্স অব ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড বিজনেস। এর কোর্স ফি ২ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এ শাখায় বছরে দুই ব্যাচে ১২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। সে হিসেবে কোর্স ফি বাবদ আদায় করা হয় ২ কোটি ৮৩ লাখ ২০ হাজার টাকা।
ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে একটি সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু রয়েছে। প্রতি বছরে তিন ব্যাচে ২২৫ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। আনুমানিক কোর্স ফি আড়াই লাখ টাকা ধরলে এর কোর্স ফি হয় ৫ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্গানেইজেশন স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগে তিন ব্যাচে ২১০ জন শিক্ষার্থী নেওয়া হলে কোর্স ফি দাঁড়ায় ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
সান্ধ্য কোর্স থেকে আয়ের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ। এ অনুষদে বছরে ১৮টি ব্যাচ ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আয় বছরে ৪৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৮৭ লাখ, সমাজবিজ্ঞানের ৭৫ লাখ, লোক প্রশাসন বিভাগের ৫৪ লাখ ৪০ হাজার, পপুলেশন সায়েন্সসের ৮৭ লাখ ২৫ হাজার, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের ৫৮ লাখ ৭৫ হাজার, টিভি, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি ১৩ লাখ ৬৫ হাজার, ক্রিমিনোলোজি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের ২৫ লাখ, প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স ৩৮ লাখ ৩১ হাজার, জাপানিজ স্টাডিজ ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা আয় হয়।
অন্য বিভাগগুলোর মধ্যে ইসলামিক স্টাডিজ ৭৮ লাখ ১২ হাজার, তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ ১ কোটি, পরিসংখ্যান ৪ লাখ, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ ৪২ লাখ, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল ৬০ লাখ টাকা আয় করে সান্ধ্য কোর্স থেকে।
আর ইনস্টিটিউটের মধ্যে আইইআর ৭০ লাখ, পরিসংখ্যান ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট ২১ লাখ, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট ৩৮ লাখ ১৬ হাজার, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট ৮৫ লাখ, তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট ৬৪ লাখ ৮০ হাজার, শক্তি ইনস্টিটিউট ৭৩ লাখ ৯ হাজার, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভলনারেবিলিটি ১ কোটি ৪ লাখ ও সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউট ২ কোটি ৩১ লাখ টাকা আয় করে।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, আমাদের কাছে আয়-ব্যয়ের চেয়ে মূখ্য বিষয়ে হলো শিক্ষার গুণগত মান ও চাকরির বাজারে এর চাহিদা। এ বিষয়ে কিছু সুপারিশ এসেছে। সে সুপারিশ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেই আজকের একাডেমিক কাউন্সিল।