সিআইডি কর্মকর্তাকে আটকে রেখে দেড় কোটি টাকা আদায় ডিবির

আকসাদুদ জামান এবং কায়সার রিজভী
আকসাদুদ জামান এবং কায়সার রিজভী  © ফাইল ছবি

সিআইডির এসআই আকসাদুদকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের সত্যতা পেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনে এ ঘটনায় ডিবির ডিসি কায়সার রিজভী কোরায়েশিসহ সাত জনের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রথম আলোর এক বিশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ফৌজিয়া খানের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি গত ২৬ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ে এ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর সিআইডির এসআই আকসাদুদ জামানকে মালিবাগ থেকে উঠিয়ে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে নির্যাতন এবং জোরপূর্বক মুক্তিপণ বাবদ ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা আদায় করার সত্যতা পাওয়া গেছে। 

এডিসি কায়সার রিজভী কোরায়েশি ছাড়া অভিযুক্ত অন্যরা হলেন ডিবির পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান, এসআই মাসুদুল ইসলাম, এএসআই প্রকাশ চন্দ্র গুহ ও জুলহাস এবং কনস্টেবল মাসুদ রানা।

এর আগে, আকসাদুদ জামানের স্ত্রী তাহমিনা ইয়াসমিন এবং ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কায়সার রিজভী কোরায়েশির একটি ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফোনালাপে তাহমিনা ইয়াসমিন রিজভী কোরায়েশিকে বলেন, ১ কোটি ২৮ লাখ তো নিছেন আপনারা সবাই। আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে ১৪ লাখ দিছি না? 

পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের কবলে পড়েন দুবাইপ্রবাসী রোমান মিয়া। ডিবি পরিচয় দিয়ে রোমান মিয়াকে মাইক্রোবাসে তুলে নেন দুর্বৃত্তরা। তাঁর হাতে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ বেঁধে নির্যাতন করে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার ও দুই হাজার দিরহাম (সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুদ্রা) ছিনিয়ে নিয়ে রামপুরা এলাকায় ফেলে যাওয়া হয়।

পরদিন এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন রোমান। ওই মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিবি। মামলার তদন্ত–তদারক কর্মকর্তা ছিলেন এডিসি কায়সার রিজভী কোরায়েশি। মামালায় আকসাদুদ জামানসহ নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর সকালে আকসাদুদ সিআইডি কার্যালয়ে যাওয়ার পথে মালিবাগ মোড়ে পৌঁছালে তাঁকে কায়সার রিজভীসহ তাঁর দলের সদস্যরা আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে তাঁকে বলা হয়, কাওলায় প্রবাসী রোমান মিয়ার অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আরও পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। তাঁরা এ ঘটনায় আকসাদুদের নাম বলেছেন। 

একপর্যায়ে অভিযোগ থেকে তাঁদের রেহাই দেওয়া হবে জানিয়ে কায়সার রিজভী কোরায়েশি দুই কোটি টাকা চান এবং আটক ব্যক্তিদের সবাইকে মুঠোফোনে তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়। কথামতো সবাই আকসাদুদের বাসায় টাকা রেখে যান। আকসাদুদ দিয়েছিলেন ৩৩ লাখ টাকা, আর বাকি ৫ জন দেন ৯৫ লাখ টাকা। ওই দিন সন্ধ্যার পর আকসাদুদকে সঙ্গে নিয়ে খিলগাঁও ঝিলপাড় এলাকায় তাঁর বাসায় গিয়ে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা নিয়ে আসেন কায়সার রিজভীসহ তাঁর টিমের সদস্যরা। তখন আকসাদুদকে আবার ডিবি অফিসে আনা হয়। পরে তাঁর স্ত্রী কায়সার রিজভীকে আরও ১৪ লাখ টাকা দেন। এরপর ২৮ নভেম্বর আকসাদুদ ছাড়া পান।

তবে মামলা চলতে থাকে। ওই মামলায় গ্রেপ্তার থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হাসান রাজা। তিনি পরবর্তী সময়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাতে রোমান মিয়াকে তুলে নিয়ে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আকসাদুদও জড়িত বলে উল্লেখ রয়েছে। এর প্রেক্ষিতে তাঁকে প্রথমে সময়িকভাবে এবং পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়।

এছাড়া, মামলা হওয়ার দীর্ঘ ১১ মাস পর ২০২১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আকসাদুদকে রংপুর থেকে গ্রেপ্তার ও মামলায় ডাকাতিতে ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাস জব্দ দেখানো হয়। এই মামলায় আটক করা মাইক্রোবাসের চালক হারুন অর রশীদ ওরফে সজীবের লগবই যাচাই ও তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিয়ে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে। এ জন্য ডিবির সংশ্লিষ্ট সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এ ছাড়া ডাকাতির মামলায় আকসাদুদ জামানের সম্পৃক্ততা কী, তা অধিকতর তদন্ত করে যাচাই–বাছাই করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

আকসাদুদ জামান বলেন, বিকাশ প্রতারণার একটি মামলা তদন্ত করতে গিয়ে তিনি মাদারীপুর–শরীয়তপুরভিত্তিক একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সন্ধান পান এবং রোমান মিয়ার বিষয়ে জানতে পারেন। আকসাদুদের অভিযোগ, রোমান মিয়ার সঙ্গে কায়সার রিজভীর পূর্বপরিচয় থাকায় মামলাটি তদন্তের ভার ডিবিতে নিয়ে আসেন তিনি। কায়সার রিজভী তখন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) উত্তরা বিভাগের বিমানবন্দর জোনাল টিমে ছিলেন।

সিআইডি কর্মকর্তাদের মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় ৩১ আগস্ট কায়সার রিজভী কোরায়েশিসহ ডিবির ওই সাত সদস্যের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন আকসাদুদ। তার এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। পুলিশ সদর দপ্তরও এ ঘটনা তদন্তে ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মোহাম্মদ আতাউল কিবরিয়ার নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। পুলিশের তদন্ত কমিটি প্রায় চার মাস আগে ওই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বলে জানা গেছে।

তবে দুটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর কয়েক মাস পার হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন ও পরিচালন) কামরুল আহসান বলেন, অপরাধের ধরন অনুযায়ী কায়সার রিজভীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া, পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. মনজুর রহমান জানান, প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে কাজ চলছে।


সর্বশেষ সংবাদ