শহীদ ওয়াসিমকে ছাড়া পরিবারের প্রথম ঈদ, যেমন আছেন বাবা-মা

শহীদ ওয়াসিমের ছবি হাতে বাবা-মা
শহীদ ওয়াসিমের ছবি হাতে বাবা-মা   © সংগ্রহ

২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরব চট্টগ্রাম। শহরের মুরাদপুর এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে সংঘর্ষে শহীদ হন ছাত্রদল নেতা ও চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ওয়াসিম। তাঁর বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাঘগুজারার বাজারপাড়া এলাকায়।

শহীদ মোহাম্মদ ওয়াসিমকে ছাড়া এবার ঈদ করবেন তাঁর বাবা-মা। কেমন আছেন তারা?

আনোয়ারা-বাঁশখালী-চকরিয়া (এবিসি) আঞ্চলিক মহাসড়কের পেকুয়া সদর ইউনিয়নের বাঘগুজারা সেতুর পাশ ঘেঁষে পূর্ব দিকে ইট বিছানো সড়কে ৮০০ মিটার গেলে মোহাম্মদ ওয়াসিমের বাড়ি।

শনিবার (২৯ মার্চ) দুপুর ১২টায় গেলে দেখা যায়, মা জোসনা বেগম ছাদে মরিচ শুকানোর কাজ করছেন। আর বাবা শফিউল আলম বসতঘরে যাওয়ার রাস্তা মেরামত নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ওয়াসিমের বোন সাবরিনা ইয়াসমিন মায়ের সঙ্গেই ছিলেন। কাজে সহায়তা করছিলেন মাকে। খবর পেয়ে জোসনা বেগম ও শফিউল আলম দোতলা ভবনের নিচতলার গেস্টরুমে আসেন। ছেলের কথা তুলতেই চোখ ভিজে ওঠে জোসনা বেগমের। বলেন, ‘বাবাজি আঁর পোয়ার হতা ফুচার গরইলে হাঁন্দানি রাহিত নপারি।’ (বাবা আমার ছেলের কথা জিজ্ঞেস করলে কান্না চেপে রাখতে পারি না।)

ওয়াসিমকে হারানোর পর এবারই প্রথম ঈদ জোসনা বেগমের। প্রতিবছর ওয়াসিম মায়ের জন্য শাড়ি, বোনের জন্য থ্রি–পিস ও ছোট দুই ভাগনে-ভাগনির জন্য রঙিন কাপড় কিনতেন চট্টগ্রাম শহর থেকে। এটি করতেন টিউশনির টাকা জমিয়ে। এসব কথা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা জোসনা বেগম। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর আমার জন্য শাড়ি আনত ওয়াসিম। বাহানা ধরত তার দেওয়া শাড়িটিই ঈদের দিন পরতে হবে। পুরো ঘর মাতিয়ে রাখত সে। শহর থেকে এলে কমপক্ষে ১০-১২ দিন গ্রামে থাকত। সহজে আমাদের ছেড়ে শহরে যেতে চাইত না।’

জোসনা বেগম বলেন, ‘ঈদের এক বা দুই দিন আগে শহর থেকে বাড়ি আসত ওয়াসিম। গাড়িতে উঠে ফোন দিয়ে বলত, মা আসছি, হালিম করো। এখন আমার ওয়াসিম নেই। হালিম করার কথা আর কোনো দিন বলবে না। আমারও আর কখনো হালিম রান্না করা হবে না।’

জোসনা বেগম আরও বলেন, ‘ওয়াসিম মিষ্টিজাতীয় খাবার খেতে চাইত না। ঝালজাতীয় খাবারই তার পছন্দ। ঈদের কয়েক দিন আগে আমি বাজার থেকে হালিম ও নুডলস কিনে আনাতাম। সে এলে রান্না করতাম। ওয়াসিম বলত, মা শহরে দামি রেস্তোরাঁয় যে হালিম পাওয়া যায়, তা খেয়ে মন ভরে না। তোমার রান্নার মতো মজা পাই না।’ এ কথা বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি।

পাশে বসা শফিউল আলম জোসনার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘আসলে ওয়াসিম আমাদের মাঝে এত স্মৃতি রেখে গেছে যে কোনটি ফেলে কোনটি বলব। সে ছিল বাড়ির প্রাণভোমরা।’

শফিউল আলম ১৮-২০ বছর ধরে প্রবাসে ছিলেন। মাঝেমধ্যে কয়েক মাসের জন্য আসতেন। ওয়াসিমের মৃত্যুর পর একেবারে দেশে ফিরে এসেছেন তিনি। শফিউল আলম বলেন, পরিবারের সুখের জন্য বড় একটা সময় প্রবাসে কাটিয়েছি। বাচ্চাদের সবকিছু দেখত ওদের মা-ই। এ কারণে প্রতিটি কাজে, প্রতিটি কথায় ছেলেকে খুঁজে বেড়ান তিনি (জোসনা)। দিনের বেশির ভাগ কাজকর্মে ওয়াসিমের কথা মনে করেন। এরপর আর কোনো কাজ করতে পারেন না। কয়েক ঘণ্টা পর স্বাভাবিক হলে আবার কাজ শুরু করেন জোসনা।

জোসনা বেগম বলেন, ‘এবার ওয়াসিম আমার কাছ থেকে অনেক দূরে। তবে ওয়াসিমের বন্ধু, দলীয় সহকর্মী অনেকে ইফতারি পাঠিয়েছেন, আমাদের জন্য নতুন কাপড় পাঠিয়েছেন। এসবের মাঝে আমার ছেলেকে খুঁজে ফিরি।’


সর্বশেষ সংবাদ