আউট বই কি আসলেই আউট?
- ইরফান হক
- প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০১৯, ০১:০০ AM , আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৯, ১০:২৬ AM
শিক্ষা জীবনের নানা স্তরে হরেক রকম বই আমরা পড়ি। পড়তে হয়। এর বাইরেও আগ্রহ ও অভ্যাসবশে বিভিন্ন বই কমবেশি সবাই পড়ে ফেলি। ফিকশন, নন-ফিকশন, কমিকস, উপন্যাস, গল্প, ভ্রমণ কাহিনী, শিকার কাহিনী, গোয়েন্দা উপন্যাস, হরর গল্প, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ—কত ধরণের বই না পড়া হয়। যাকে কেউ আদুরে গলায় কিংবা অভিযোগের সুরে ডাকেন ‘আউট বই’।
কিন্তু এই ‘আউট বই’ কি সত্যিই আউট বা বাইরের বই? নাকি জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়ায় নিবিড়তম অঙ্গ? সম্প্রতি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস বিষয়টি ভালোভাবে বোঝার জন্য কথা বলেছে বিভিন্ন শ্রেণীর, বয়সের ও পেশার মানুষের সঙ্গে। ব্যবসায়ী, তরুণ উদ্যোক্তা, প্রকৌশলী, ডাক্তার, ব্যাংকার, পুলিশ, সাংবাদিকসহ সরকারি-বেসরকারি খাতের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপে উঠে আসে- ক্লাসের পাঠ্যক্রমের বাইরের বই বাস্তবজীবনে কতটুকু সাহায্য করেছে তাদেরকে।
তারা বলছেন, ক্লাসের বইয়ের একটি উদ্দেশ্য আছে। সাধারণ একটি সাধ্য ও সীমা ধরে এ পাঠ্যক্রম সাজানো হয়। কিন্তু জীবনবোধের উন্নতি, নতুন নতুন জ্ঞান অর্জন এবং বাস্তবজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা লাভের পথটি উন্মুক্ত করে মূলত: ওই পাঠ্যক্রমের বাইরের বইগুলোই। মানুষের বিবেচনাবোধ ও আচরণগত বড় পার্থক্যও এনে দেয় ‘আউট বই’। সংকটকালে নির্দিষ্ট কোনো বইয়ে বর্ণিত ঘটনা বা বিষয় সমাধানের সূত্র পাইয়ে দেয়। আনন্দকালে তা উদযাপনের ধারা এবং মাত্রাজ্ঞানও দেয় ওই পাঠ্যবহির্ভূত বই।
শুধুই কি তাই? কঠিন বাস্তবতায়ও পথে দেথায় কিংবা চলার পথকে সহজ করে দেয় বই পড়া। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা, চাকরির পরীক্ষা, স্কলারশিপের জন্য প্রস্তুতি, বিদেশে শিক্ষা, ব্যবসায় নতুন ধারণা ও তার প্রয়োগসহ জীবন চলার নানা ধাপে এগিয়ে দেয় আউট বই। এমনকি পেশাগত জীবনে নিজেকে ভিন্ন উচ্চতায় নিতে হলেও অন্যতম বাহন হয় শ্রেণীকক্ষের বাইরে পড়া ওই কালো কালির জ্ঞান। তাই পড়তে হবে নিজের জন্য। আনন্দময় পড়া কর্মমুখর দিনেও সুখ নিয়ে আসতে পারে।
গবেষণার জন্য বইপড়া: পড়ার অভ্যাস ও লেখার দক্ষতা কাজে লাগে গবেষণাপত্র লেখার কাজেও। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা সংস্থার (আইএফপিআরপি) প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. নাজমুল আলম বলেন, ‘গবেষণাপত্র লিখতে গেলে কাজে লাগে লেখার দক্ষতা; যা বাড়াতে গেলে বিভিন্ন লেখকের বই পড়ার বিকল্প নেই। ভিন্ন ভিন্ন লেখকের ভিন্ন ভিন্ন লেখনী, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন পড়ার ফলে পাঠকের চিন্তাভাবনার বিস্তৃতি ঘটে। গবেষণাপত্র লেখাটাও অনেক চিন্তার ফসল, যা সরল রূপে একজন গবেষক সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। সুতরাং বিভিন্ন লেখকের লেখার ধরনের সঙ্গে পরিচিত থাকলে গবেষণাপত্রের লিটারেচার রিভিউ, গবেষণার ফলাফলের সারসংক্ষেপ লিখতে সুবিধা হয়। তবে ভালোভাবে গবেষণাপত্র লেখার জন্য প্রচুর পরিমাণে ভালো ভালো জার্নালের গবেষণাপত্র পড়াটাও জরুরি।’
ভর্তি পরীক্ষার জন্য: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে পড়াশোনা করছেন আবদুল্লাহ সাদমান। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার নেশা ছিল তাঁর। বই পড়া এবং ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়াকে কখনোই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। অনেকেই মনে করেন গল্প-উপন্যাস পড়া মানেই সময় নষ্ট। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে পাঠ্যক্রমের বাইরের পড়াশোনা আমাকে দারুণভাবে সাহায্য করেছে। অন্য অনেক ছাত্রছাত্রীর মতো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের খুঁটিনাটি আমাকে তোতাপাখির মতো মুখস্থ করতে হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিজের আগ্রহ থেকেই অনেক বই পড়েছিলাম আমি। আর এর ফলে অনেক প্রশ্নের উত্তরই সহজে করতে পেরেছিলাম। সাধারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে গাইড বইয়ের সীমিত তথ্য সব সময় কাজে আসে না। সে ক্ষেত্রে গাইড বইয়ের বাইরের জ্ঞানকে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।’
বিদেশে পড়তে গেলে: বিদেশি ভাষায় লেখা বই পড়লে সেই ভাষার ওপরে দক্ষতা অর্জন করা যায়। আর সেই দক্ষতা কাজে লাগে ভাষাসংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষায়ও। এ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকুয়ারি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সোমেশ্বরী পারমিতা বলেন, ‘আমি স্নাতক করেছি ভারতের ইউনিভার্সিটি অব মাইশোর থেকে। তখন হোস্টেলে একা একা থাকতাম। সারা দিন বই পড়তাম। এই পড়াটাই কাজে লেগেছে। নতুন নতুন শব্দ শিখেছি। লেখার স্টাইল শিখেছি। আইইএলটিএসের জন্য আলাদা করে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়নি।’ বলে রাখি, আইইএলটিএসে সোমেশ্বরীর স্কোর ছিল ৮। বৃত্তির জন্য আবেদন করতে হলে আজকাল বেশ কয়েকটি রচনা লিখতে হয়। আপনি যদি আপনার লেখার দক্ষতা দিয়ে কর্তৃপক্ষকে মুগ্ধ করতে পারেন, তাহলেই বৃত্তি পাওয়াটা অনেকখানি সহজ হয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায় নানা ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা থাকার পরও শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়েন শুধু লেখার দক্ষতা নেই বলে।
উদ্যোক্তাদের বইয়ের জগৎ: উদ্যোক্তা হতে হলে সবার আগে প্রয়োজন উদ্ভাবনী চিন্তা আর সৃজনশীলতা। বই পড়ার অভ্যাস আপনাকে এই দুটো গুণই রপ্ত করতে সাহায্য করবে। উদ্যোক্তাদের বইপ্রীতির কথা তো মোটামুটি সবারই জানা। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ভীষণ বইয়ের পোকা। নিয়মিত বই তো পড়েনই, তাঁর ব্লগেও (www.gatesnotes.com) প্রিয় বইগুলো নিয়ে লেখেন। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ নিয়ম করে প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে বই পড়েন। সফল উদ্যোক্তারা মনে করেন, উদ্যোগী মনোভাব তৈরি করতে হলে ভালো পাঠক আপনাকে হতেই হবে।
ভালো শিক্ষক হতে চাইলে: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা মনে করেন, একজন ভালো শিক্ষক হতে গেলে একজন ভালো মানুষ হওয়া দরকার, তাঁর জ্ঞান থাকা চাই সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যবস্থার সম্বন্ধে। আর সেই জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করে বই পড়া, তাঁর ভাষায়, ‘পড়ার বইয়ের বাইরের বই পড়ার আনন্দের সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হয় না। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সাইনবোর্ড, টিন-ক্যানের লেবেল, সংবাদপত্র—সবকিছু পড়লেই আসলে সমাজকে, দেশকে এমনকি বিশ্বকেও বোঝা যায়। যে টি–শার্টটি পরে আছি, সেটার লেবেলে কোন দেশের নাম, সেটি জানা গেলে যেমন ব্যক্তির সঙ্গে সমাজ-রাষ্ট্র-বিশ্বব্যবস্থার যোগাযোগ বোঝা যায়, তেমনি কবিতা-গল্প-উপন্যাস না পড়লে মানবতার অমূল্য সম্পদ আবেগ-অনুভূতি আর প্রেম ধরা–ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। মানুষ, প্রকৃতি আর জীবকুলের প্রতি প্রেম না থাকলে শিক্ষক কেন, মানুষই হওয়া যায় না। কাজেই বই না পড়লে কেমন করে হবে?’