ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার

দুই দশকে বই ইস্যু কমেছে ৯৬%, আগ্রহ বেড়েছে চাকরির পড়াশোনায়

ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার
ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার  © টিডিসি সম্পাদিত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে পড়তে যান আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী জাইমা হক (ছদ্মনাম)। সঙ্গে কখনও থাকে অ্যাকাডেমিক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য শিট, আবার কখনও চাকরির পড়াশোনার জন্য গাইড বই। তবে কখনও গ্রন্থাগার থেকে বই ইস্যু করেননি তিনি। শুধু জাইমা নয়, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে যাওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির প্রস্তুতির গাইড বই কিংবা অ্যাকাডেমিক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য শিট নিয়ে নিয়ে যান। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বই ইস্যু করেন না।

ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার বেশ ঐতিহ্যবাহী ও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানে রয়েছে লাখ লাখ বই-জার্নালের বিপুল সংগ্রহ। রয়েছে হাজার হাজার বিরল পাণ্ডুলিপিও। তবে ২০০৩ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে গ্রন্থাগার ব্যবহারকারীর প্রাপ্ত থেকে জানা গেছে, দুই দশকে এখান থেকে বই ইস্যু করার সংখ্যা ৯৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এই চিত্রটি উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

“কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে বিভিন্ন কারণে দিন দিন বই ইস্যু কমে যাচ্ছে। এজন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক কারণ দায়ী। আমাদের শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীরা এই গ্রন্থাগার ব্যবহার করে থাকেন। এরমধ্যে শিক্ষার্থীরা একটি বড় অংশ, কিন্তু তাদের একাডেমিক বই পড়ার অভ্যাস কমে গেছে। তাই বর্তমানে গ্রন্থাগারটি রিডিং রুমে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া স্মার্টফোন-ইন্টারনেটের সহজলভ্যতাও এটার কারণ হতে পারে।

কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে বই ইস্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর বেশকিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করে সংশ্লিষ্টরা। এরমধ্যে রয়েছে, প্রথম বর্ষ থেকে শিক্ষার্থীরা অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা বাদ দিয়ে চাকরিকেন্দ্রিক পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়া, ইন্টারনেটে সহজেই অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার ম্যাটেরিয়ালস খুঁজে পাওয়া এবং ক্লাসে শিক্ষকদের রেফারেন্স বইয়ের পরিবর্তে লেকচার শিট দেওয়ার প্রবণতা প্রভৃতি। এ ছাড়াও এখন এআই প্রযুক্তির সহায়তা অনেকেই বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক সমস্যার সমাধান সহজেই খুঁজে পান। 

গ্রন্থাগারের সার্কুলেশন ডেস্ক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষে গ্রন্থাগার থেকে ৭ লাখ ৫৭ হাজার ২০০ বার বই ইস্যু করা হয়েছিল, যা ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে এসে মাত্র ২৫ হাজার ১৪৯-এ নেমে এসেছে।

কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পড়ার জায়গা

গ্রন্থাগার ব্যবহার করা শিক্ষার্থীদের মতে, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে অ্যাকাডেমিক ও রেফারেন্স বইয়ের চাহিদা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। এর বিপরীতে গ্রন্থাগারে যারা আসেন, তাদের সবার হাতে বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির প্রস্তুতির বই দেখা যায়। কেউবা মুঠোফোনে নোট করছেন, কেউ আবার খাতায় লিখছেন।

তারা মনে করেন, প্রযুক্তির অগ্রগতি ও ডিজিটাল মাধ্যমের প্রসারের কারণে পাঠাভ্যাস পরিবর্তিত হয়েছে। তবে এটি একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা, যা ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

জানা যায়, অনেক রেফারেন্স বই এখন ডিজিটাল ভার্সনে পাওয়া যায়। যার ফলে বইয়ের হার্ড কপি নিতে অনীহা আছে শিক্ষার্থীদের। মোবাইল কিংবা ল্যাপটপে বসেই এখন ডাউনলোড করা যায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বই।

“বই নেওয়ার প্রবণতা কমেছে সেটা সত্য। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে, এখানে একটা টেকনোলজিক্যাল রেভুলোশন হয়ে গেছে। আমি গ্রন্থাগার ঘুরে দেখি মাঝেমধ্যে। আমি দেখতে পাই, শিক্ষার্থীরা এখন বই পড়ে মোবাইলে, ল্যাপটপে। তাছাড়াও আমাদের গ্রন্থাগার এখন বিশ্বের নামকরা কয়েকশো গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এক্সেস পায়। শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে ডাউনলোড করে পড়ে। সেজন্য বই নেওয়া কমেছে-অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল আলম, গ্রন্থাগারিক

কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই শতাব্দীর শুরুতে বই ইস্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ছিল। সময়ের সাথে সাথে এটি ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। বিশেষ করে, কোভিড-১৯ মহামারির পর বই ইস্যু করার সংখ্যা প্রায় শূন্যে নেমে আসে। ২০০৩ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে শিক্ষার্থীরা মোট ৭৬ লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ বার বই ইস্যু করেছিলেন, যেখানে প্রতি বছর গড়ে ৭ লাখ ৬৩ হাজার ৯৭০ বার বই ইস্যু করা হয়। এ সময় সর্বোচ্চ ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ৮ লাখ ১১ হাজার ৬১৩ বার বই ইস্যু হয়েছিল।

পরবর্তী ১০ বছরে (২০১৪-২০২৩) এই সংখ্যা তিনগুণ কমে গড়ে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৮৬৫-এ দাঁড়ায়। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে কোভিড-১৯-এর কারণে গ্রন্থাগার বন্ধ ছিল। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৮০ হাজার ৯০৬ বার বই ইস্যু নেওয়া হয়েছিল, আর ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে সর্বনিম্ন মাত্র ২৫ হাজার ১৪৯ বার বই ইস্যু করা হয়।

‘‘২০ শতকের শেষের দিকেও শিক্ষার্থীরা গ্রুপ করে পড়াশোনা করতো। তারা টেক্সট ধরে ধরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য, বাংলাদেশ বিষয়াবলি আলোচনা করতো। এখন চাকরির পড়া দূরের কথা, নিজ বিভাগের পড়াশোনাটাও হয় না। ইংরেজি সাহিত্যের একজন ছাত্র এখন বড় বড় সাহিত্যের বই না পড়ে নীলক্ষেত গিয়ে ছোট ছোট নোটবুক কিনে আনে পরীক্ষায় ভালো করার জন্য-নাজমুল হুদা, সাবেক শিক্ষার্থী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির সাবেক সভাপতি শেখ আরমান বলেন, ২০০২-০৩ সালের দিকে শিক্ষার্থীরা বিসিএস-কেন্দ্রিক ছিল না। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিসিএস-এর গ্লোরিফিকেশন হয়েছে অনেক। কারণ এখানে বৈধ পন্থার চাইতেও অবৈধ উপায়ে ভালো থাকার অবারিত সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেজন্য ডাক্তাররাও সাধারণ বিসিএস করতে চান, বুয়েট শিক্ষার্থীরাও সাধারণ বিসিএস করতে চান—কারণ অবৈধ সুযোগের হাতছানি। এজন্যই আমরা দেখি পত্রিকায় নিউজ হয় যে সবচাইতে বেশি টাকা পাচার করেছেন সরকারি চাকুরিজীবীরা, এরপর রাজনীতিবিদরা।

কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রধান ফটক

শিক্ষকরা এখন আর পড়াশোনার গুরুত্ব তুলে ধরতে পারছেন না বলেও উল্লেখ করেন শেখ আরমান। তিনি বলেন, ‘ক্লাসগুলো শিক্ষার্থী বান্ধব না। জ্ঞান সৃষ্টিতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করতে পারছেন না—সেজন্য শিক্ষার্থীরা নিজ বিভাগের বই পড়ায় অনীহা দেখাচ্ছেন। মূলত, উচ্চশিক্ষার যে ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে সেখান থেকে আমরা বহু দূরে চলে গেছি। পরিবেশ আমাদের দূরে নিয়ে গেছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী নাজমুল হুদা আজাদ বলেন, ‘আমাদের জীবনের সময় বরাদ্দে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের বড় একটা অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেটে যায়। এই মাধ্যমে জ্ঞানজগতের কিছু শর্টকার্ট এবং চটকদার কন্টেন্ট থাকে। সেগুলোই দেখে সবাই। টেক্সট পড়া সময়ের ব্যাপার। তাই মানুষ টেক্সট পড়তে অনাগ্রহ প্রকাশ করে।’

তিনি বলেন, ‘২০ শতকের শেষের দিকেও শিক্ষার্থীরা গ্রুপ করে পড়াশোনা করতেন। তারা টেক্সট ধরে ধরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য, বাংলাদেশ বিষয়াবলি আলোচনা করতেন। এখন চাকরির পড়া দূরের কথা, নিজ বিভাগের পড়াশোনাটাও হয় না। ইংরেজি সাহিত্যের একজন ছাত্র এখন বড় বড় সাহিত্যের বই না পড়ে নীলক্ষেত গিয়ে ছোট ছোট নোটবুক কিনে আনেন পরীক্ষায় ভালো করার জন্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগে বই পড়া ছিল অবসরযাপনের অন্যতম অনুষজ্ঞ। কিন্তু বই পড়ার অভ্যাস দখল করে নিয়েছে ফেসবুক। যার কারণে বই পড়ার প্রবণতা অনেকাংশে কমেছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল আলম বলেন, ‘বই নেওয়ার প্রবণতা কমেছে সেটা সত্য। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে, এখানে একটা প্রযুক্তিগত বিপ্লব হয়ে গেছে। আমি গ্রন্থাগার ঘুরে দেখি মাঝেমধ্যে। আমি দেখতে পাই, শিক্ষার্থীরা এখন বই পড়ে মোবাইলে, ল্যাপটপে। তাছাড়াও আমাদের গ্রন্থাগার এখন বিশ্বের নামকরা কয়েকশো গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এক্সেস পায়। শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে ডাউনলোড করে পড়ে। সেজন্য বই নেওয়া কমেছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের জ্যেষ্ঠ এক অধ্যাপক বলেন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে বিভিন্ন কারণে দিন দিন বই ইস্যু কমে যাচ্ছে। এজন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক কারণ দায়ী। আমাদের শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীরা এই গ্রন্থাগার ব্যবহার করে থাকেন। এরমধ্যে শিক্ষার্থীরা একটি বড় অংশ, কিন্তু তাদের অ্যাকাডেমিক বই পড়ার অভ্যাস কমে গেছে। তাই বর্তমানে গ্রন্থাগারটি একটি রিডিংরুমে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া স্মার্টফোন-ইন্টারনেটের সহজলভ্যতাও এটার কারণ হতে পারে।

বই ইস্যু কমার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও দায়ী উল্লেখ করে তিনি বলেন, গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠান সময় ১০ হাজার শিক্ষার্থী ছিল, কিন্তু এখন ৩৫-৪০ হাজার শিক্ষার্থী। ফলে গ্রন্থাগারের ইউজার বাড়লে সে অনুপাতে আয়তন-বাজেট কিংবা জনবল বাড়েনি। পাশাপাশি ইউজারদের সচেতনতা বাড়াতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সেটিও গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ নিচ্ছে না। অন্যদিকে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী সেখানে নেই বললে চলে।


সর্বশেষ সংবাদ