ড্যাবের লোগো ও ডা. একেএম আহসান হাবিব নাফি © সংগৃহীত ও সম্পাদিত
জামায়াত নেতা ও ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থী ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম আরমানের সমালোচনা করায় এক বিএনপিপন্থী চিকিৎসককে চাকরিচ্যুতির অভিযোগ উঠেছে ইবনে সিনা হাসপাতালের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। একই সঙ্গে যথাযথ তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত ভুক্তভোগী চিকিৎসকের পুনর্বহালের দাবিও জানিয়েছে সংগঠনটি।
আজ শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) ড্যাবের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আল রশীদ ও মহাসচিব ডা. মো. জহিরুল ইসলাম শাকিল এক যৌথ বিবৃতিতে এই দাবি জানান। সংগঠনটির দপ্তর সম্পাদক ডা. এরফান আহমেদ সোহেল বিবৃতিটি গণমাধ্যমে পাঠিয়েছেন। ভুক্তভোগী চিকিৎসক ইবনে সিনা হাসপাতাল ধানমন্ডি ইউনিটের মেডিকেল অফিসার ছিলেন। তিনি এনাম মেডিকেল শাখা ড্যাবের সদস্য।
বিবৃতিতে ড্যাব নেতারা বলেন, ডা. একেএম আহসান হাবিব নাফিকে চাকরি থেকে অপসারণের পূর্বে যথাযথ তদন্ত না করে এবং ডা. নাফিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চাকরি বিধিমালার ব্যতয় ঘটানো হয়েছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। ড্যাবের পক্ষ থেকে ডা. নাফিকে আত্মপক্ষ সমর্থন এবং যথাযথ তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত চাকরিতে পুনরায় বহাল করার জন্য দাবি জানাচ্ছি।
আরও পড়ুন: বিএনপিপন্থি ৮ চিকিৎসককে সুখবর দিল ড্যাব
এর আগে গত বুধবার (১০ ডিসেম্বর) রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ভেরিফায়েড আইডি থেকে দেওয়া এক পোস্টে নিজের চাকরিচ্যুতির অভিযোগ তোলেন ডা. নাফি। ওই পোস্টে চাকরিচ্যুতিপত্র এবং পূর্বের দেওয়া একটি পোস্টের স্ক্রিনশট যুক্ত করেন তিনি। স্ক্রিনশটে দেখা যায়, ‘বাবা স্বাধীনতার বিরোধী ছিলেন, তবে যুদ্ধাপরাধী নন: ব্যারিস্টার আরমান’ শিরোনামে চ্যানেল আইয়ে ঢাকা-১৪ আসনের জামায়াতের প্রার্থী ও গুমের শিকার ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম আরমানের একটি সাক্ষাৎকার শেয়ার দেন নাফি। ক্যাপশনে খোঁচা দিয়ে তিনি লেখেন, ‘মান্না আর ডিপজলের ডায়ালগ মনে পড়ে গেল।’
এদিকে তার চাকরিচ্যুতি করে দেওয়া ইবনে সিনা ট্রাস্টের সদস্য প্রশাসন ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া স্বাক্ষরিত পত্রে বলা হয়েছে, ‘আপনাকে ইবনে সিনা হাসপাতাল ধানমন্ডি ইউনিটে আর প্রয়োজন না থাকায় ইবনে সিনা ট্রাস্ট চাকরি চুক্তির শর্ত মোতাবেক নোটিশে পিরিয়ড বেনিফিট প্রদান করে ১১ ডিসেম্বর থেকে চাকরি অবসানের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এতে আপনার শেষ কর্মদিবস হবে ১০ ডিসেম্বর। পত্র প্রাপ্তির এক মাস পর আপনার লেনদেনের হিসাব নিষ্পত্তির জন্য যে কোনো দিন ইবনে সিনা হাসপাতাল ধানমন্ডি ইউনিটের হিসাব বিভাগের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।’
বিষয়টি উল্লেখ করে ডা. নাফি বিশদ অভিযোগ দিয়ে লিখেছেন, ‘আমি ডা. একেএম আহসান হাবীব নাফি। একজন চিকিৎসক হিসেবে ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করে ইবনে সিনা হাসপাতালে পেশাগত জীবন শুরু করি। একই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) আদর্শে বিশ্বাসী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এনাম মেডিকেল কলেজ শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। স্কুল জীবন থেকেই আমি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছি। মত প্রকাশের এই ধারাবাহিকতায় বহুবার নানারকন অজানা চাপ ও ঝামেলার মুখোমুখি হয়েছি। তবু অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখালেখি কখনো থামাইনি। বড় কোনো শারীরিক বা আইনি বিপর্যয়ে না পড়লেও এসব অভিজ্ঞতা আমাকে আরও সচেতন ও দৃঢ় করেছে।’
তিনি লিখেছেন, ‘২০১৮ ও ২০২৪ সালের গণআন্দোলনে সরাসরি যুক্ত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বিশেষ করে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দেশে নানান মতাদর্শ ও রাজনৈতিক চিন্তার উত্থান আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এই প্রেক্ষাপটে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ১৯৭১ এবং ২০২৪ আমাদের জাতির ইতিহাসে আত্মিকভাবে সংযুক্ত। একটিকে অস্বীকার করে অন্যটিকে ধারণ করা মানে জাতিকে এক পায়ে পঙ্গু করে রাখা।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘পেশাগত জীবনে আমি সর্বদা নীতি ও দায়িত্বকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু কর্মস্থলে আমি কখনোই তার প্রভাব ফেলতে দেইনি। চিকিৎসক হিসেবে রোগীর প্রতি দায়িত্ব পালনে আমার জ্ঞান, সততা ও পেশাদারিত্বের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করেছি। অথচ আজ হঠাৎ করেই আমাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই। কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র থেকে জানতে পেরেছি, জামায়াত-শিবির বিরোধী লেখালেখি এবং ব্যারিস্টার আরমানের একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে প্রদত্ত মতামতের বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণেই আমাকে এই সিদ্ধান্তের শিকার হতে হয়েছে যার প্রমাণ আমার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।’
ডা. নাফি লেখেন, ‘নিঃসন্দেহে এটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং তারা তাদের আইন অনুসারে চাইলে আমাকে অব্যাহতি দিতে পারে। কিন্তু কোনো কারণ না দেখিয়ে, মতাদর্শগত ভিন্নতাকে অজুহাত বানিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া নৈতিকতা ও গণতান্ত্রিক চর্চার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ৫ আগস্টের পর যখন মানুষ নতুন করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে, ঠিক তখনই একটি অদৃশ্য শক্তি সেই স্বাধীনতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পুরনো ফ্যাসিবাদী কায়দায় দমন-পীড়ন চালাতে চাইছে। তারই একটি নগ্ন উদাহরণ আজ আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা। দুঃখজনক হলেও সত্য আজ আমাকে জামায়াত-নিয়ন্ত্রিত ইবনে সিনা হাসপাতাল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। যখন বাংলাদেশের গণমানুষের দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান নিজে তাঁর বিরুদ্ধে মিম, ব্যঙ্গ ও সমালোচনাকে উদার গণতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করেন, তখন একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা করা যাবে না এমন দাবি কোন ধরনের রাজনৈতিক দেউলিয়ত্বের পরিচয় বহন করে? এই দেউলিয়ত্ব নিয়েই যদি তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বপ্ন দেখে, তবে ক্ষমতায় গেলে কী ধরনের কালো আইন, বাকরোধী শাসন ও মতাদর্শিক নিপীড়ন চালু হবে তা বোঝার জন্য খুব বেশি দূর তাকাতে হয় না।’
আরও পড়ুন: ৪ তলা বাড়িয়ে হয়েছে সাত, ‘অতি ঝুঁকি’ নিয়েই মেডিকেল শিক্ষার্থীদের বাস এই ভবনে
পোস্টে তিনি আরও বলেন, ‘আমি আমার কলম থামাব না। বিগত ফ্যাসিস্ট সময়েও আমার কলম থামেনি, এখনও থামবে না। আমি সত্য বলব, কিন্তু আমি আমার মোরাল এথিক্স বিক্রি করব না। আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াব আজ, আগামীকাল এবং যতদিন প্রয়োজন। ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে বাংলাদেশে এর বিচার জনগণ করবে।’