জাকসু নির্বাচন এখন সময়ের দাবি

জাবির শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতারা
জাবির শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতারা  © টিডিসি ফটো

দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে অচল হয়ে আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু)। সর্বশেষ ১৯৯২ সালে জাকসু নির্বাচন হয়েছিল। দীর্ঘ এই সময়ে জাকসু নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরবর্তীতে তা চাপা পড়ে যায়। স্বায়ত্তশাসিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের অনেকের মত, এখনকার প্রশাসনের মধ্যেও জাকসু নির্বাচন করতে নেই কোনো উদ্যোগ।

একের পর এক ভিসি পরিবর্তন হলেও জাকসু সচল করার ব্যাপারে তাদের কোন আগ্রহ দেখা যায়নি। ১৯৭৩ এর ১৯(২) এর ধারা অনুযায়ী ভিসি প্যানেল নির্বাচনে ছাত্র সংসদ বা জাকসু কর্তৃক নির্বাচিত ৫ জন প্রতিনিধির ভোটাধিকার প্রয়োগ করার অধিকার আছে। এদিকে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি বছর জাকসু নির্বাচন হবার কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরে জাকসু নির্বাচন হয়েছে মাত্র ৯ বার। ১৯৯২ সালে সর্বশেষ জাকসু নির্বাচনের পর এক ছাত্রের বহিষ্কারকে কেন্দ্র করে ১৯৯৩ সালের ২৯ জুলাই ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে তৎকালীন প্রশাসন জাকসু ও হল সংসদ বাতিল করে। ফলে পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে যায় জাকসু নির্বাচন।

২০১৩ সালে সাবেক ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের সময় জাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল; কিন্তু আনোয়ার হোসেন নানা প্রতিকূলতার কারণে জাকসু নির্বাচন শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ না থাকলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভর্তির সময় ১৫ টাকা করে ছাত্র সংসদ বাবদ ফি আদায় করা হচ্ছে।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জাকসু নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা ফলপ্রসু হয়নি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলোর দাবির মুখে বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাবার পর আবারো প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মাধ্যমে টালবাহানা চালিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন।

আবারও নতুন ভিসি পেয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিবারের ন্যায় এবারও জাকসু নির্বাচন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ভিসি। জাকসুর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশাগুলো তুলে ধরেছেন জাবির সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী ইমন ইসলাম—

জাকসু শিক্ষার্থীদের কথা বলে
বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনদের মধ্যে  শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে নিয়োগ, পদোন্নতি, ক্ষমতা, আর্থিক প্রণোদনা প্রভৃতি উপঢৌকন দিয়ে আজ্ঞাবহ করে রাখা সহজতর। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের আজ্ঞাবহ করে রাখা সবচেয়ে কঠিন। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া তো দূরের কথা, তাদেরকে কথা বলবার সুযোগই দেওয়া হয় না। দীর্ঘ বছর ধরে একই কারণে জাকসু নির্বাচন বন্ধ রেখে সিনেটে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া, মতামত প্রদানের পথ বন্ধ রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রাপ্য অধিকারটুকু না দিয়ে কেবলমাত্র সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনকে তুষ্ট রেখে লুটতরাজের রাজত্য কায়েম রাখতেই প্রশাসন আগ্রহী। ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরা সংগঠনগুলো থেকে নেতৃত্ব উঠে আসার বিপদটুকু তারা এড়িয়ে চলতে চান।  আমরা অচিরেই জাকসু নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি৷ উপাচার্য যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা কার্যকর করার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান না হলে আমরা আন্দোলনের মাধ্যমে জাকসু নির্বাচন আদায় করে নিবো। গণতান্ত্রিক চর্চার পথ বন্ধ করে রাখবার ফল ভালো হয় না বলেই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।

রাকিবুল রনি, সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন, জাবি সংসদ।

জাকসু নেই আজ ৩০ বছর
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ  (জাকসু)  নির্বাচন প্রায় ৩০ বছর থেকে বন্ধ রয়েছে। কর্তৃপক্ষ এই নির্বাচনের কোন পদক্ষেপ না নেওয়ায় প্রতিনিয়ত সাধারণ শিক্ষার্থী নিজেদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খুবেই দুঃখজনক। তাই বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি অতিদ্রুত জাকসু নির্বাচন কার্যকর করা। আমি মনে করি যে, আমাদের বর্তমান নবনির্বাচিত মাননীয় উপাচার্যের  এই বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব প্রধান করা উচিৎ। যাতে করে দ্রুত সময়ের মধ্যে জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

তাহিরা মেহজাবিন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

শিক্ষার্থীরা আজ বৈষম্যের শিকার
জাকসু নির্বাচন না হওয়ায় প্রশাসনের আলোচনাগুলোতে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় না। জবাবদিহিতা না থাকায় দাবির মুখে প্রশাসনের করা নানা প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপ দিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তেমন বিকার পরিলক্ষিত হয় না, সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো উপেক্ষিতই থেকে যায়। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয় অথচ ছাত্র প্রতিনিধি না থাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়েই আলোচনা হয় না। যা শিক্ষার্থীদের জন্য চরম বৈষম্যের সামিল।  উন্নয়ন হচ্ছে, নির্বাচন হচ্ছে শুধু জাকসু নির্বাচন ছাড়া।  তাই অবিলম্বে জাকসু চাই। 

ফরিদুর রেজা , ইংরেজি বিভাগ

জাকসু শিক্ষাবান্ধব ও মননশীল চর্চার কেন্দ্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে একজন শিক্ষার্থী হিসেবে যা প্রত্যাশা ছিলো তার অধিকাংশই আমরা এ বর্তমান বাস্তবতায় পাচ্ছি না। রয়েছে ক্লাসরুম সংকট, হলে সিট সংকটের যথোপযুক্ত ব্যবস্হাপনার অভাব।শিক্ষকদের বা প্রশাসনের জবাবদিহিতার জায়গাও নেই সেভাবে। যার জন্য প্রতিনিয়ত এসব সংকটে আমরা শিক্ষার্থীরা ভুগছি এবং ক্রমাগত আশাহত হচ্ছি এই ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে। একজন শিক্ষার্থী যেসব স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়,তার পুরোটাই ভেঙ্গে যাচ্ছে এসব সংকটের বাস্তবতায়।অধিকাংশ শিক্ষার্থীই হতাশ এসব অব্যবস্থাপনাজনিত সংকটের কারণে।পড়ালেখা বা ভবিষ্যৎ স্বপ্নের জায়গা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। আর এসব সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করণে সহায়ক ভূমিকা রাখছে জাকসুর অকার্যকারিতা। জাকসু কার্যকর হলেই কেবল শিক্ষার্থীরা এসব সংকটের জায়গা তুলে ধরে তার সমাধানের পথে ভূমিকা রাখতে পারে, ছাত্র প্রতিনিধিরা নাতে পারে দাবি দাওয়ার জায়গাগুলো যাতে ভবিষ্যতে এসব সংকটকে জয় করে বিশ্ববিদ্যালয়কে উপযুক্ত শিক্ষাবান্ধব ও মননশীল চর্চার কেন্দ্রে পরিণত করা যায়। এই সংকটের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমরা প্রতিনিয়ত বোধ করি জাকসুর প্রয়োজনীয়তা। আমরা বলতে চাই-জাকসু চাই।

ফাইজা মেহজাবিন প্রিয়ন্তী, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ

জাকসু শিক্ষার্থীদের কথা বলে
জাকসু একটি সার্বজনীন  গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এখানে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, স্বাধীন মত প্রকাশের চর্চা হবার কথা। এখান থেকেই জাতীয় রাজনীতির যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে ওঠার কথা। শুধু রাজনীতি নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের ধারায় জাকসু থাকার কথা সবসময় সক্রিয়। অথচ শিক্ষার্থী বান্ধব সেই সংগঠনই আজ বন্ধ। জাকসু চাওয়া না চাওয়ার বিষয় না, এটা শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার, যে অধিকার থেকে বছরের পর বছর শিক্ষার্থীদেরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।  জাকসু ভবন আছে অথচ জাকসুর কার্যক্রম নেই। তাই নতুন উপাচার্যের কাছে প্রত্যাশা থাকবে অনতিবিলম্বে জাকসু নির্বাচন দিয়ে শিক্ষার্থী বান্ধব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। 

জামিনুর রহমান শামীম, জার্নালিজম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ

অবিলম্বে জাকসু চাই
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং প্রশাসনের মধ্যে যোগাযোগের মূল মাধ্যমই হলো ছাত্র প্রতিনিধি। সিনেটে ছাত্রদের দাবি-দাওয়া, চাওয়া-পাওয়া ছাত্র প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই উত্থাপিত হওয়ার কথা। কিন্তু জাকসু না থাকায় বরাবরই এই বিষয়টি উপেক্ষিত হয়ে আসছে। সুতরাং দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ ছাত্র সংসদ দরকার, যার মাধ্যমে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীবান্ধব একটি পরিবেশ তৈরি হবে।

তারেক মাহমুদ ,পাবলিক হেলথ এন্ড  ইনফরমেটিক্স বিভাগ

প্রাণের দাবি একটাই জাকসু চাই
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের স্বার্থ দেখার জন্য অভিভাবক থাকলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ দেখার কেউ নেই৷ এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের আচরণে দেখা দিয়েছে স্বৈরাচারী মনোভাব। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশসহ গবেষণা খাতে বরাদ্দ নিয়েও চলে অনিয়ম-দুর্নীতি। এগুলো নিয়ে কথা বলার বা ভাবার যেন কেউ নেই৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান এবং সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা ফিরে পেতে জাকসুর প্রয়োজনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতি শিগগির শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি জাকসু গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফিরিয়ে আনা হোক।

তাজহারুল ইসলাম সজীব, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ


সর্বশেষ সংবাদ