‘পাখির স্বর্গে’ কেন কমে যাচ্ছে অতিথি পাখি?
ঢাকার অদূরে প্রতিষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একদিকে বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের জন্য যেমন সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত, তেমনি পাখির অভয়ারণ্য হওয়ার কারণে ‘পাখির স্বর্গ’ নামেও পরিচিত প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের কাছে। তাই এখানে সবুজের নিবিড় ছোঁয়ায় অতিথি পাখির জলকেলি উপভোগ করতে ছুটে আসেন অনেকে। তবে এবার অতিথি পাখি দেখতে আসা পাখিপ্রেমিরা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাখির সংখ্যা দেখে প্রকাশ করেছেন একরাশ হতাশা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সাল থেকেই ২০২০ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যানে সবচেয়ে বেশি পাখি এসেছে ২০২০ সালে। ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে আসা মোট পাখির সংখ্যা যথাক্রমে ৬৭৮০, ৪৭৩১, ৪৯৭৫, ৪৭০৯ এবং ৮১২০। তবে ২০২০ সালে এখন অবধি সে সংখ্যা ৪ হাজারের মত হবে বলে জানিয়েছেন পাখি পর্যবেক্ষণ করেন এমন একাধিক সূত্র।
দীর্ঘদিন থেকে পাখি নিয়ে অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ করেন এমন ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার বেশকিছু কারণ জানা গেছে। এতে দেখা যায়, দর্শনার্থীদের গাড়ির হর্ণ বা ছবি তোলার মতই প্রভাব ফেলেছে শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের ছোঁড়া ঢিল, তালি দেওয়া এবং লেকের সামগ্রিক অব্যবস্থাপনা।
দর্শনার্থী, শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের উৎপাত পাখি কমে যাওয়ার বড় কারণ
পাখি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, হাওর অঞ্চল থেকে ফেরার সময় অতিথি পাখিগুলো এখানে আসে বিশ্রাম ও খাবারের জন্য। এসময় তারা খোঁজে নিরাপদ অবস্থান। কিন্তু রাস্তা সংলগ্ন লেকগুলোতে পাখিগুলো সবচেয়ে বেশি উপদ্রবের শিকার হন। পাথি দেখতে আসা এই দর্শনার্থীরা পাখির উড়াউড়ি দেখতে কেউ কেউ ঢিল মারেন, কেউ দেন হাততালি। অনেকেই উড়ন্ত অবস্থায় পাখির ভিডিও ধারণ করতে বা ফুটেজ নিতে একই কাজ করেন।
এবারে নভেম্বরের শুরুর দিকে পুরাতন পরিবহন চত্বর সংলগ্ন লেকে অনেক পাখি আসলেও এখন সে সংখ্যা নাই বললেই চলে। নভেম্বরের ৭ তারিখ থেকে শুরু হয় এ ভর্তি পরীক্ষা যা ২২ তারিখ পর্যন্ত চলে। এই সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাসে আসে বিপুল পরিমাণ লোক। আগে পরীক্ষা হত অক্টোবরের প্রথম দিকে যখন অতিথি পাখি তেমন আসতো না।
পাখিপ্রেমী ও গত কয়েক বছর থেকে পাখি পর্যবেক্ষণ করেন এমন একজন ব্যক্তি অরিত্র সাত্তার। বাবা-মা বিশ্ববিদবযালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে পুরাতন পরিবহন চত্বর সংলগ্ন লেকের পাশেই কোয়ার্টারে থাকেন তিনি। তার সাথে কথা বলে জানা যায় বাস্তব অবস্থা।
তিনি বলেন, গত কয়েকছর ধরে ট্রান্সপোর্টের এই জায়গায় আমি অনেক পাখি দেখেছি। কিন্তু এবার এ দৃশ্য দেখে মোটেও ভালো লাগছে না। এখন পাখি দেখা যাচ্ছে বোটানিক্যাল গার্ডেন সংলগ্ন লেকে এবং ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার সংলগ্ন লেকে। সেটা তুলনামূলক দূরে ও কর্তৃপক্ষের নজরদারির বাইরে হওয়ায় এখানে যারা পাখি দেখতে আসেন সংখ্যায় কম দেখলে তারা হাততালি দেন না হয় ঢিল ছোড়েন। এতে অনেক বেশি বিরক্ত হলে পাখিরা ওড়াউড়ি শুরু করে।
তিনি আরো বলেন, জামসিং ও জয়াপাড়া সংলগ্ন এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় ওই গ্রামের অনেক ছেলেরাও এসে ঢিল মারে, আনন্দ নেয়। কেউ কেউ আগুন ধরিয়ে দেয় লেকসংলগ্ন জঙ্গলে।
আরও পড়ুন: জাবিতে পাখি মেলা ৭ জানুয়ারি
ওই এলাকায় সরেজমিন গিয়ে এই তথ্যের সত্যতাও মিলেছে। পাওয়া গেছে বেশকিছু প্রমাণও। যারা ঢিল ছোড়েন কিংবা হাততালি দেন তাদের অনেকেই আছেন যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী।
পাখি বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, রাস্তাসংলগ্ন লেকগুলোতে অতিথি পাখি অনেক বেশি উৎপাতের শিকার হয়। অতিথি পাখির জন্য সবচেয়ে বড় থ্রেট উৎপাত। এজন্য পাখিগুলো তুলনামূলক নিরিবিলি রেকগুলোতে দেখা যাচ্ছে। সেখানেও উৎপাত হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নিরাপত্তা বেষ্টনীর ব্যাপারে কথা বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজকে মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
লেকের অব্যবস্থাপনা
বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসসূত্র বলছে, ছোট বড় প্রায় ২৬টি লেক আছে। এর চার পাঁচটি লেকে অতিথি পাখি আসে। এগ লেকগুলো লিজ দেওয়া হয় না। লোকগুলোতে পানির গভীরতা ও প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরী হওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
পাখি বেশী আসে এমন লেকগুলো ঘুরে দেখা যায়, ট্রাসপোর্ট সংলগ্ন লেক ও মেডিকেল সেন্টারের পেছনের লেক শুধু পরিষ্কার করা হয়েছে। এখানে প্রাকৃতিক খাদ্য বা পাখির অবস্থানের লেকগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণেও প্রভাবিত হচ্ছে অতিথি পাখির আনাগোনা। কচুরিপানা ও জলজ উদ্ভিদগুলো ঠিকমত পরিষ্কার না করা ও খনন না করার কারণে প্রতিবছর কমে যায় লেকের গভীরতা। তবে এরই মধ্যে প্রায় পুরোটাই ভরাট হয়ে গেছে নতুন প্রশাসনিক ভবনের পেছনের লেক ও বিপিএটিসি সংলগ্ন লেক। লেকের সামনে থাকা দোকানের আবর্জনায় দূষিত হচ্ছে লেকের পানি আর ক্রেতাদের কারণে বিরক্ত হচ্ছে পাখি।
আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ হলে বাসা বেঁধেছে ঘুঘু পাখি
এ নিয়ে জাবি অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, পরিহন চত্বরের নিকটের লেক পরিষ্কার করা হলেও বোটানিক্যাল গার্ডেন ও সুইমিংপুল সংলগ্ন লেকে কচুরিপানা বেড়ে গেছে। কচুরিপানা বেশি বড় হয়ে গেলে সেখানে পাখি বসতে চায় না। এগুলো পরিস্কারের জন্য এস্টেট অফিসকে বলা হবে।
দোকানের কারণে লেকের দূষণ ও বিরক্ত করার ব্যাপারে এ অধ্যাপক বলেন, দুটি দোকানের মধ্যবর্তী স্পেস দিয়ে অনেকেই পাখির কাছাকাছি চলে যান। যা অনেক বিরক্তিকর। সার্বিকভাবে ব্যবস্থা নিতে এস্টেট অফিসকে বলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসের প্রধান ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার আব্দুর রহমান জানান, ২০১০ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোতে আর খননকাজ করা হয় নি। এরপর বাজেট সংকটে আর খননকাজ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া লেকের কচুরিপানা পরিষ্কার করতেও অনেক বড় বাজেটের প্রয়োজন যা কর্তৃপক্ষ দেয় না।
তিনি আরো জানান, লেকের সামনের দোকান বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সময় লিজ দিয়েছে। তাদেরকে আমরা বলেছি। এর বাইরে আমরা কি করতে পারি?
আরেক পাখি বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, এই লেকগুলো দেখাশোনা করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটি। এই কমিটিতে একসময় প্রাণিবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা সদস্য হিসেবে ছিলেন। এখন এখানে কেউ নেই। বিশেষজ্ঞ ছাড়া সঠিক তদারক কিভাবে সম্ভব?, প্রশ্ন রাখেন তিনি।
এ নিয়ে, অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক রাশেদা আখতারের সাথে মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায় নি।
প্রয়োজন সচেতনতার ও সু-ব্যবস্থাপনার
অতিথি পাখির জন্য নির্বিঘ্ন পরিবেশ রাখতে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি বলে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন পাখি বিশেষজ্ঞরা। অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, আমাদের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি। না হলে পূর্বের পরিস্থিতি আনা সম্ভব না। এজন্য আমরা পাখি মেলা করছি। আমাদের জায়গা থেকে চেষ্টা করছি। তাছাড়া দর্শনার্থী প্রবেশের ব্যাপারে সুব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করেন বিশিষ্ট এই বিজ্ঞানী।
আরও পড়ুন: প্রতিকূল পরিবেশে জাবিতে অতিথি পাখি কমছে
অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ ও একই মত দেন। তিনি বলেন, অল্প কিছু মানুষ দিয়ে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। প্রয়োজন সচেতনতা ও সুব্যবস্থাপনা।
জাবিতে প্রথম অতিথি পাখি আসে ১৯৮৬ সালে। তখন প্রায় ৯৬ প্রজাতির পাখি শনাক্ত করা হয়। এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ২০৫ প্রজাতির পাখির খোঁজ পাওয়া গেছে যার মধ্যে ১২৬ প্রজাতির পাখি দেশি ও বাকিগুলো অতিথি পাখি হিসেবে পরিচিত। এদের সবগুলোই একসাথে অবস্থান করে না বরং বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে আসে এবং চলে যায়।