নিয়োগ নিয়ে সমালোচিত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বচ্ছতা ফেরাতে চবি প্রশাসনের নতুন উদ্যোগ
- সুমন বাইজিদ, চবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৫, ০১:১৩ PM , আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৫, ০১:৪৩ PM

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে আগে থেকেই অভিযোগ রয়েছে। এর আগের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সময়কালে বিভিন্ন নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। এবার নিয়োগে স্বচ্ছতা ফেরাতে লিখিত পরীক্ষা, কম্পিউটার দক্ষতা পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষার আয়োজন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে আগের উপাচার্যের সময় পরীক্ষা হতো না, হলেও নামমাত্র পরীক্ষার আয়োজন করা হতো বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) বিভিন্ন হল, বিভাগ ও দপ্তরের জন্য তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগের আবেদন চাওয়া হয়। এতে ৬টি পদে নিয়োগ পেতে আবেদন করেন ৭২৫ জন নিয়োগ প্রার্থী। এর মধ্যে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন প্রায় সাড়ে চারশো জন।
এই নিয়োগ প্রার্থীদের তিনটি ধাপে পরীক্ষা দিতে হবে। এতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাদেরকে বিভিন্ন হল, অফিস এবং দপ্তরে নিয়োগ করা হবে। এর জন্য গত ৭ মার্চ সমাজবিজ্ঞান অনুষদে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষার কয়েকঘণ্টা আগে প্রশ্ন ডিজাইন ও প্রিন্ট করে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ব্যবহারিক পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে কম্পিউটার দক্ষতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে জানা গেছে। সবশেষ ভাইভার মাধ্যমে চূড়ান্ত নিয়োগ পাবেন নিয়োগ প্রার্থীরা।
এর আগে নিয়োগ বিতর্কে উপাচার্য হিসেবে মেয়াদের ৪ বছরই আলোচনায় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। চবির প্রথম এ নারী উপাচার্যের মেয়াদকালে প্রায় সাড়ে ৫০০ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পেয়েছিলেন। অভিযোগ আছে, যার অধিকাংশই ছিল বাণিজ্য বা দলকেন্দ্রিক।
শিরীণ আখতারের সময়ে সিন্ডিকেটের অনুমোদনে ১৩০ জন শিক্ষক এবং ২৩৮ জন কর্মচারী নিয়োগে পেয়েছেন। অপরদিকে কোনো প্রকার বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ তিনি নিয়োগ দিয়েছেন ১১৫ জন এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ৫৭ জন। সর্বমোট ৫৪০ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে গেছেন অধ্যাপক শিরীণ আখতার।
গত বছরের ১৯ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য নিয়োগের মধ্য দিয়ে শেষ হয় অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার অধ্যায়। তবে নিজের শেষদিনে এসেও তিনি নিয়োগ দেওয়া বন্ধ রাখেননি। এদিন দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে, হল ও দপ্তরে অন্তত ৪৪ জনকে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাদের প্রত্যেককেই দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয় বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানান।
আরও পড়ুন: ঢাবির ব্যবসায় শিক্ষা ইউনিটের ফল প্রকাশ কবে, যা জানা যাচ্ছে
বর্তমানে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগে প্রশাসনের এমন উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে, এখন এটি কতটা স্বচ্ছ হয় সেটাই দেখার বিষয়।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব গ্রহণের পর চেষ্টা করছি প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, ডিপার্টমেন্ট অথবা অফিসের জন্য ১ জন করে 'কম্পিউটার অপারেটর' নিয়োগের জন্য গণমাধ্যম বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞাপন হওয়ার পরে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আবেদন সংগ্রহ করা হয়েছে। সবাইকে সাক্ষাৎকার কার্ড ইস্যু করার পরে যারা বাছাইকৃত প্রার্থী তাদের তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এই প্রক্রিয়ায় কর্মচারী নিয়োগ কখনো হয়েছে কিনা আমার জানা নাই। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কখনো চোখে পড়ে নাই। ভবিষ্যতের প্রশাসন এ রকম প্রক্রিয়া জারি রাখবে কিনা তাও জানি না। তবে, আমরা সকল ক্ষেত্রে এ ধরনের স্বচ্ছ কাজ করতে চাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী এক শিক্ষক বলেন, আগে অনেক সময় পরীক্ষা হতো না। এখন তো পরীক্ষা হচ্ছে। স্বচ্ছ নিয়োগ হবে আশা করা যায়। তবে, ভিতরে কি হয় না হয় এটা তো বলা মুশকিল। আগে কিছু পরীক্ষা হয়েছে কিন্তু সেগুলো নিয়ে বেশকিছু প্রশ্নও ছিল। আগে তো বিজ্ঞাপন ছাড়াই নিয়োগ দিয়ে ফেলত কিন্তু এখন পরীক্ষা হচ্ছে এটা অবশ্যই ভালো দিক। অধ্যাপক শিরীণ আখতারের শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগে খুবই খারাপ অবস্থা ছিল।
তিনি আরও বলেন, আমার যতটুকু অভিজ্ঞতা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে আসলে খুব কম নিয়োগই স্বচ্ছ হয়েছে। কোনো না কোনোভাবে প্ররোচিত হয়ে নিয়োগগুলো হয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খুব কমই ফেয়ার নিয়োগ হয়েছে। এখন এটা কি হবে বলা মুশকিল।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা যেটা দেখলাম, আমরা যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে গঠন করতে চাচ্ছি, যেভাবে কাজ করছি, প্রায় লম্বা সময় ধরে আমাদের যারা কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন যাদের অনেকেই আমাদের সাথে দৌড়াতে পারছেন না। এছাড়া তাদের যথেষ্ট দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে, কিন্তু দক্ষ খুবই কম। তৃতীয় শ্রেণীর নিয়োগগুলো হচ্ছে, আগের প্রশাসন এভাবে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ দেওয়ার সাহসও পায়নি। কারণ, এসব নিয়োগগুলো তারা গোপনে গোপনে টাকা ও ক্ষমতার মাধ্যমে বিক্রি করত। আমরা আসার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যোগ্য লোকদেরকে নিয়ে আসব।
তিনি আরও বলেন, কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক যে তৃতীয় শ্রেণীর পদ, তারা কিন্তু এক সময় অফিসার হয়। হায়ার অথরিটি সিদ্ধান্তগুলো তারাই টাইপ করে। তাদের মধ্যে দক্ষ লোকজন না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকমতো ফাংশন করে না। এজন্য আমরা পরীক্ষা নিয়েছি। পরীক্ষার কয়েকঘণ্টা আগে তাৎক্ষণিক টাইপ করে পরীক্ষা নিয়েছি। এসব খাতাগুলোও আমরা দেখছি। বাইরের কাউকে খাতা দেইনি। এসব দেখে ফলাফল তৈরি করব। এখান থেকে যারা তালিকাভুক্ত হবে, তাদের থেকে আমরা ব্যবহারিক পরীক্ষা নেব। কারণ, তাদের টাইপ স্পিড ঠিক আছে কিনা, চিঠিপত্র নির্ভুলভাবে করতে পারছে কিনা- এগুলো আমরা দেখবো। এসবকিছু দেখেই আমরা তাদের নিয়ে আসবো। এক্ষেত্রে কোনো তদবির বা অন্যকিছু আমরা প্রশ্রয় দেব না। এভাবেই আমাদের নিয়োগপ্রক্রিয়া চলবে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও নতুন নীতিমালা ইতোমধ্যে করা হয়েছে। আমরা সবক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেই কাজ করবো।