ঢাবির সিন্ডিকেট
আওয়ামীপন্থীদের বাদ দিতে চাপ শিক্ষার্থীদের, সিদ্ধান্ত যেভাবে
- তাওসিফুল ইসলাম
- প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩০ PM , আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৬ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে মোট সদস্য ১৮ জন। সিন্ডিকেটের সভায় বসে এসব সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত সব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পদাধিকারবলে ভিসি, দুই প্রো-ভিসি এবং নতুন ৬ সদস্য যুক্ত হওয়ার পরও আওয়ামী লীগপন্থী ৯ জন সদস্য থেকে যান সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী এই ফোরামে। তবে এরপর শিক্ষার্থী ও ছাত্রসংগঠনগুলোর ক্রমাগত চাপের মুখে সম্প্রতি পাঁচ সদস্যকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ল রিভিউ কমিটি’র পর্যালোচনা বলছে, বিদ্যমান বিধি মোতাবেক তারা আর সদস্য থাকার ‘যোগ্য’ নন। গত ৮ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. সাইফুদ্দীন আহমেদ এক সংবাদ সম্মেলনে কমিটির দেওয়া সুপারিশ তুলে ধরেন। বাদ দেওয়ার অংশ হিসেবে এই পাঁচ সদস্যকে সিন্ডিকেটের সভায় আর আমন্ত্রণ না জানানো কথা জানান তিনি।
এর আগে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ৯ শিক্ষক ও ব্যক্তিবর্গ সিন্ডিকেটে রাখা নিয়ে বিরোধিতা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এমনকি গতমাসে সিন্ডিকেটের সভা চলাকালে সভাস্থলের বাহিরে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে আওয়ামী সিন্ডিকেট সদস্যদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া হয়। সর্বশেষ গত ১৩ ডিসেম্বর রাতে ভিসি বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ করে অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে থাকা ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভুঁইয়াকে বাদ দেওয়ার দাবি জানায় শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের ১৮টি পদের মধ্যে ছয়টিতে (ডিন, প্রাধ্যক্ষ, অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক) শিক্ষকরা সরাসরি ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ওই ছয়টি ক্যাটাগরির সবকটিতে জিতেছেন আওয়ামী লীগপন্থীরা। ভিসি এবং দুই প্রো-ভিসি পদাধিকারবলে সিন্ডিকেট সদস্য মনোনীত হন। এছাড়া বাকি ৯ পদ রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট, অ্যাকাডেমিক পরিষদ, চ্যান্সেলর, সরকার কর্তৃক মনোনীত হয়ে থাকেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বলছে, যারা শিক্ষকদের ভোটে সরাসরি নির্বাচিত, তাদের নির্ধারিত মেয়াদ দুই বছর ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। তবে পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত তারা সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে থাকবেন। অন্যদিকে যারা মনোনীত হয়েছেন, তাদের চাইলে যেকোনো সময় পরিবর্তন করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরই অংশ হিসেবে গত নভেম্বরে নতুন ৬ সদস্য পরিবর্তন করা হয়েছিল।
এদিকে, সম্প্রতি নির্বাচিত ৫ সদস্যকে বাদ দেওয়ায় বর্তমান ও সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য এবং আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের কেউ কেউ এ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের পরিপন্থী। পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। ভবিষ্যতে এটি নজির হয়ে থাকবে।
তবে কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দেখিয়েছেন, নির্বাচনকালীন তারা যে পদের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন পদোন্নতির কারণে সে পদে না থাকায় আর সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে থাকছেন না।
উদাহরণস্বরূপ, কেউ প্রভাষক পদে সিন্ডিকেট সদস্য নির্বাচিত হলেন। কিন্তু পরবর্তী সিন্ডিকেট সদস্য নির্বাচন হওয়ার আগে তিনি প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। তাহলে সিন্ডিকেট থেকে তিনি বাদ পড়বেন। এটাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যুক্তি।
তাহলে পদোন্নতি কি সিন্ডিকেট সদস্য থাকার জন্য প্রতিবন্ধকতা?
একাধিক সাবেক সিন্ডিকেট সদস্যের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের মেয়াদ দুই বছর হলেও মেয়াদের পরেও এই ফোরাম কখনো 'ইনভ্যালিড' বা 'ডিজলভ' হয় না। কারণ সিন্ডিকেট ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারবে না। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বডি।
তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে দুই ধরনের সদস্য থাকেন। কিছু সদস্য নির্বাচিত। আর কিছু সদস্য মনোনীত।
নির্বাচিত সদস্যদের মেয়াদ দুই বছর। তবে দুই বছর মেয়াদ হলেও পরবর্তী সিন্ডিকেট সদস্য নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত তারা এই সিন্ডিকেটের বৈধ সদস্য হিসেবে থাকবেন। অন্যদিকে যারা মনোনীত তাদের মেয়াদ বাড়ানো যায় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নীলিমা আখতার বলেন, আপনি খোঁজ নিলে দেখতে পাবেন—বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এমন কোন সিন্ডিকেট ছিল না, যেখানে সদস্যদের পদোন্নতি হয়নি। প্রায় প্রত্যেক সিন্ডিকেটে এরকম দুই একজন থাকেন যাদের পরবর্তী নির্বাচনের আগেই পদোন্নতি হয়। কিন্তু পদোন্নতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কি আবার একটা পদের জন্য নির্বাচন দেবে?
সিন্ডিকেটে ১৮টি পদের মধ্যে ৬টি পদ নির্বাচিত সদস্যদের জন্য। পদগুলো হল—ডিন, প্রভোস্ট, অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক এবং প্রভাষক।
ড. নীলিমা বলেন, প্রায় সময় দেখা যায় অধ্যাপক ছাড়া বাকি ৫টি পদের প্রতিনিধিদের কারো না কারো পদোন্নতি হয়ে থাকে। এক সিন্ডিকেটে একাধিক নির্বাচিত সদস্যের পদোন্নতি হওয়ার উদাহরণও আছে। এখন পদোন্নতি হওয়া মাত্র ঐ পদে বারবার বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন দিবে? এরকম কোনো নজির বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই।
তিনি বলেন, সিন্ডিকেটে কয়েক রকমের পদ আছে। একটা হল নির্বাচিত সদস্য। তারাই মূলত সিন্ডিকেটের প্রাণ। এর বাইরে থাকেন মনোনীত। সেটা আচার্য নিয়োগ দেন। উনারা অনেক সময় লম্বা সময় ধরে সিন্ডিকেট সদস্য থাকেন। তাদের মেয়াদ অনেক সময় বৃদ্ধি করা হয়। প্রত্যেকের মেয়াদ দুই বছর। কিন্তু নির্বাচিত সদস্যদের মেয়াদ পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত।
তিনি যোগ করেন, আরেকটা ক্যাটাগরি আছে। তারা হলেন 'এক্স অফিসিও'। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেটে দুইটা কলেজের প্রিন্সিপাল সদস্য থাকেন। সেটা বিশ্ববিদ্যালয় মনোনয়ন দেন। যেমন ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল প্রায় সময় আমাদের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে থাকেন। এর বাইরে সরকারি কর্মকর্তা আছেন। ইউজুয়ালি, শিক্ষা সচিব মনোনয়ন পান। শিক্ষা সচিব হতে হবে তা না।
‘ট্রেডিশনালি শিক্ষা সচিবকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এই পদগুলোতে ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয় না। এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক পদ। এই পদে যিনি থাকবেন তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়। কিন্তু নির্বাচিতরা পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত সদস্য থাকবেন। এটা দশ বছরও হতে পারে। কোথাও বলা নেই যে, নির্বাচন দিতেই হবে। যদিও বলা আছে মেয়াদ দুই বছর। কিন্তু এটা যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, এটা কোন সময় ইনভ্যালিড থাকেনা। সেজন্য নির্বাচন ছাড়া এই কমিটি কেউ ভেঙেও দিতে পারবেন না।’—জানান ড. নীলিমা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে বলেন, ইতঃপূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এবারে প্রথম এটা দেখলাম আমি। এটা খুব বেশি ডিসেন্ট হয়নি। আইনানুগভাবেও এসব ব্যাপারে অ্যাকশন নিতে দেখিনি আগে। ধরেন, সরকারি অধ্যাপক পদে একজন নির্বাচিত হলো। নির্বাচনের পরে তার প্রমোশন হলো। আমি দেখেছি পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত তাকে সদস্য হিসেবে থাকতে। এটাই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্র্যাকটিস।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফোরামে সাদা দলের লোকজনও ছিল। কিন্তু কাউকে হুট করে এভাবে বাদ দিতে দেখিনি। টেনিউর পার হওয়ার পর বাদ দিতে দেখেছি। ন্যাচারাল প্রসেস হচ্ছে, পরবর্তী কমিটি না হওয়া পর্যন্ত তারাই কাজ করবে।
আছে পদোন্নতি পেয়েও সিন্ডিকেট সদস্য থাকার উদাহরণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একাধিক উদাহরণ রয়েছে যে নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি দুই বছরের বেশি সময় ধরে সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন।
২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যে সিন্ডিকেট ছিল তার প্রভাষক পদ থেকে সদস্য ছিল মার্কেটিং বিভাগের আফরিন চৌধুরী। তিনি বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সাদা দলের সদস্য ছিলেন। সিন্ডিকেট সদস্য থাকাকালীন আফরিন চৌধুরী প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। কিন্তু তারপরেও তার সদস্য পদ বাতিল হয়নি।
২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সহযোগী অধ্যাপক পদ থেকে সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন অধ্যাপক সাদেকা হালিম। দীর্ঘ পাঁচ বছর নির্বাচন না হওয়ায় তার সদস্য পদে কোন সমস্যা হয়নি। এই সময়ে তিনি সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েও সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে বহাল ছিলেন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি ২০০৪ সালে শিক্ষকদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হই। আমি সে সময় সহযোগী অধ্যাপক ছিলাম। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আইন বিভাগের ড. বোরহান উদ্দীন। নির্বাচনে আমি জিতে যাই। আমি ২০০৯ সাল পর্যন্ত সিন্ডিকেটে ছিলাম। ইতোমধ্যে আমি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে যাই। তার মানে এই না যে, আমি সহযোগী অধ্যাপক পদে যে সিন্ডিকেট সদস্য হয়েছিলাম সে পদ শূন্য হয়ে যাবে। কেননা এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডার ১৯৭৩ এ নাই।
তিনি বলেন, আমি প্রত্যাশা করছি যে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাকি যে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে - রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় - সে মোতাবেকেই প্রশাসনিক সুশাসন বজায় রাখার চেষ্টা করবেন। আচার্য মনোনীত কিংবা সিনেট মনোনীত সদস্যরা পরিবর্তন হয়।
এদিকে, 'ভুল ব্যাখ্যায়' সিন্ডিকেট সদস্য থেকে বাদ দেওয়া নিয়ে ফেসবুকে লেখেন সহযোগী অধ্যাপক নীলিমা আখতার।
তার ফেসবুক পোস্টে অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মিজানুর রহমান মন্তব্য করেন, নির্বাচিত সিন্ডিকেট সদস্যগণ পরবর্তীতে নির্বাচন হওয়ার আগ পর্যন্ত বৈধভাবেই সিন্ডিকেট সদস্য থাকবেন যদি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরিরত থাকেন। আমি নিজেও সহকারী অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত সদস্য হওয়ার পর পদোন্নতি পেয়ে সহযোগী অধ্যাপক হওয়ার পর দীর্ঘদিন সিন্ডিকেট সদস্য ছিলাম পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার আগ পর্যন্ত। আমি আশা করবো বর্তমান প্রশাসন এই আইনের ভুল ব্যাখ্যা গ্রহণ করবেন না।
ঢাবি অধ্যাদেশ ১৯৭৩ কী বলে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ২৩ (৩) অনুসারে, সিন্ডিকেটের সদস্যগণ দুই বছরের জন্য পদে বহাল থাকবেন, তবে ততদিন পর্যন্ত পদে বহাল থাকবেন, যতদিন না তাঁদের উত্তরাধিকারীগণ নির্বাচিত বা মনোনীত হয়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তবে শর্ত থাকে যে, কলেজের অধ্যক্ষগণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ, সিনেটের প্রতিনিধি এবং সরকারের মনোনীত সদস্যগণ যথাক্রমে অধ্যক্ষ, শিক্ষক, সিনেট সদস্য এবং সরকার কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তি হিসাবে তাঁদের পদে বহাল থাকার সময় পর্যন্ত সিন্ডিকেটের সদস্য পদে বহাল থাকবেন।
এই অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে ড. নীলিমা বলেছেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যে পদেই নির্বাচিত হোন না কেন, পদোন্নতি হলেও সিন্ডিকেট থেকে বাদ পড়বেন না যদি না তিনি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকেন।
আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, আগে প্র্যাক্টিস ছিল একেকরকম। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতি সে প্র্যাক্টিসটা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে কাউকে তাড়াহুড়ো করে বাদ দেওয়াটা ভালো প্র্যাক্টিস না। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভালো উদাহরণ না।
কারা বাদ পড়ছেন?
গত ৮ ডিসেম্বর নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ জানান, ১৮ জন সিন্ডিকেট সদস্যের মধ্যে ডিন, প্রভোস্ট, প্রভাষক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত সদস্যরা আর সেসব ক্যাটাগরির প্রতিনিধিত্ব করবেন না।
ওই পাঁচজন হলেন প্রভাষক ক্যাটাগরির মাহিন মোহিদ, সহকারী অধ্যাপক ক্যাটাগরির মোহাম্মদ শরিফ উল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক ক্যাটাগরির আবু হোসেন মুহাম্মদ আহসান, প্রভোস্ট ক্যাটাগরির ড. মো. মাসুদুর রহমান ও ডিন ক্যাটাগরির মো. আব্দুস ছামাদ।
প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা নিয়ে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এটি বিজ্ঞ আইনজীবীদের বডি ল রিভিউ কমিটির কাছে পাঠাই। এই কমিটির সদস্য ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. নাইম আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. ইমাম হোসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের চেয়ারম্যান আমাদেরকে দুটি পরামর্শ দিয়েছেন।’
"প্রথমত, ডিন এবং প্রভোস্ট ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত শিক্ষকরা তাদের প্রতিনিধিত্বকারী পদ ডিন কিংবা প্রভোস্ট পদে যদি আর বহাল না থাকেন, তাহলে তারা যে প্রতিনিধিত্বের কারণে নির্বাচিত হয়েছিলেন সেটি আর থাকছে না। ফলে তাদের পরবর্তী সভা থেকে আমন্ত্রণ না জানালেও আইনগত জটিলতায় পড়তে হবে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে নির্বাচিতদের অনেকের পদোন্নতি হয়েছে, প্রতিনিধিত্বের জায়গায় না থাকায় তাদেরকেও আমন্ত্রণ না জানানোতে কোনো জটিলতা থাকল না।"
সহযোগী অধ্যাপক ক্যাটাগরি থেকে বাদ পড়া আবু হোসেন মুহাম্মদ আহসান বলেন, ১৯৭৩ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট আছে। তখন থেকে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে যারা যারা নির্বাচিত হয়েছিল সবারই প্রমোশন হয়েছে। গত ৫১ বছরে সবাই প্রমোশন পাওয়ার পরেও সিন্ডিকেট সদস্য ছিল এরকম অহরহ নজির রয়েছে। কখনোই এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
লোক প্রশাসন বিভাগের বর্তমান এই অধ্যাপক বলেন, সিন্ডিকেটের ব্যাপারে ভিসি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তিনি বাস্তবায়ন করতে পারেন। ধরে নিলাম একটা আইনের ব্যাখ্যা উনারা বুঝতে পারছেন না। এখন উনারা আইনজ্ঞদের কাছে একটা ব্যাখ্যা চাইলেন। আইনজ্ঞ ব্যাখ্যা দিলেন যে, তাদেরকে রাখাও যেতে পারে, বাদও দেওয়া যেতে পারে। সে যে ব্যাখ্যা দিল তার সিদ্ধান্ত কিন্তু সিন্ডিকেটেই হবে। ভিসি চাইলেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। আমাদেরকে বাদ দিতে গেলে সিন্ডিকেট আমাদেরকে ডেকে আমাদের সামনে এই এজেন্ডা তুলে আমাদেরকে বাদ দিতে হবে। ভিসির বাদ দেওয়ার ক্ষমতা নেই। শুধু সিন্ডিকেট আমাদের বাদ দিতে পারেন।
তিনি বলেন, আইনে কিন্তু স্পষ্ট আছে যে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত নির্বাচিত শিক্ষকরা সিন্ডিকেট সদস্য থাকবেন।
তার মতে, সিন্ডিকেটের মেয়াদ ২ বছর। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সিন্ডিকেট ২ বছরের মধ্যে নির্বাচন দিতে পারেনি। যেমন গত সিন্ডিকেট ছিল সাড়ে ৪ বছর। এর আগের সিন্ডিকেট ৪ বছর। ফলে, পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত মেয়াদ থাকে।
তবে ভিসি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, আমরা চেয়েছিলাম এই সিন্ডিকেট দিয়ে চালিয়ে নিতে। কিন্তু এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের তীব্র দাবি ছিল। অনেক দল-মতের পক্ষ থেকে ক্ষোভ জানানো হয়েছে। সে প্রেক্ষিতে আমরা আইনগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে বাদ পড়ছেন?
উল্লিখিত বাদ পড়া ৫ শিক্ষকের আওয়ামীপন্থী নীলদলের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ পতনের পর তাদেরকে সিন্ডিকেট থেকে বাদ দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা কয়েকবার আন্দোলনে নেমে পড়েন। আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ল রিভিউ কমিটির কাছে বিষয়টি উত্থাপন করলে তারা বাদ দিতে আইনি জটিলতা নেই বলে উল্লেখ করেন।