কোটা আন্দোলনে নিহত যত শিক্ষার্থী
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ও পরবর্তী সংঘাতে এ পর্যন্ত দুইশরও বেশি মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি মারা গেছে গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) ৮৪ জন। মৃত্যুর এই হিসাব কিছু হাসপাতাল, মরদেহ নিয়ে আসা ব্যক্তি ও স্বজনদের সূত্রে পাওয়া। সব হাসপাতালের চিত্র পাওয়া যায়নি।
নিহতদের মধ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া, এমনকি স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীও রয়েছে। এই আন্দোলনে প্রথম মৃত্যুর খবর আসে গত ১৬ জুলাই। সেদিন দুপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২তম ব্যাচের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাইদ (১)। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলন সমন্বয় কমিটির সদস্য ছিলেন। এরপর থেকেই নতুন মাত্রা পায় কোটা সংস্কার আন্দোলন।
এদিন দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর-মুরাদপুর এলাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ওয়াসিম আকরাম (২)। তিনি কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক বলে জানা গেছে।
এ ঘটনায় মুরাদপুর দুই নম্বর গেটের মাঝামাঝি জায়গায় গুলিবিদ্ধ হন ওমরগনি এমইসি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ফয়সাল আহমেদ শান্ত (৩)। পরে হাসপাতালে তিনি মারা যান। সেখানে নিয়ে আসা মিসকাত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তাদের সাথেই আন্দোলনে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হন শান্ত। শান্তর গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের মহিষাদী গ্রামে।
ওইদিন রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ঢাকা কলেজের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী এবং কলেজ শাখার ছাত্রলীগ কর্মী সবুজ আলী (৪)। তিনি কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন। এর আগে বিকেলে সাইন্সল্যাবে কোটা আন্দোলনে সংঘর্ষে তিনি আহত হয়েছিলেন।
এদিকে, ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) দুপুরের পর থেকে রাজধানী ও এর আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষে একের পর এক মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন জেলা থেকেও আসে এই মৃত্যুর খবর।
১৮ জুলাই বেলা ১১টার পর ঢাকার উত্তরার আজমপুর এলাকায় পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন জাহিদুজ্জামান তানভীন (৫)। তিনি গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির যন্ত্র প্রকৌশল (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং) বিভাগ থেকে দুই বছর আগে স্নাতক করেন। যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতকোত্তরে পড়তে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের ভিটি-বিশাড়া গ্রামে।
এদিন উত্তরায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া তরুণ মাহমুদুল হাসান রিজভী (৬)। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়া পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের চর কৈলাশ এলাকায়। লক্ষ্মীপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ইলেকট্রনিকস বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করে চলতি মাসেই ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ শুরু করেন মাহমুদুল।
একইদিনে দুপুরের পর সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শেখ আসসাবুল ইয়ামিন (৭) নামে আন্দোলরত শিক্ষার্থীদের একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। তিনি ঢাকার মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স টেকনোলজির (এমআইএসটি) শিক্ষার্থী ছিলেন।
এর আগে দুপুরে মাদারীপুরে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের সময় পুলিশের ধাওয়ায় শকুনি লেকে পড়ে নিখোঁজ দিপ্ত দে (৮) নামে এক শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। তিনি মাদারীপুর সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
ওইদিন রাজধানীর বাড্ডা-রামপুরা এলাকায় পুলিশ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে ইমরেপিয়াল কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী জিল্লুর রহমান (৯) মারা যান।
অন্যদিকে, ধানমন্ডির পুরানো ২৭ নম্বর সড়ক এলাকায় কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকার সমর্থক ও পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষে মারা যায় ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থীর ফারহান ফায়াজের (১০)। তিনি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং ২০২৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সাথে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কথা ছিল।
নরসিংদী সদর উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তাহমিদ তামিম (১১) নামে এক স্কুলশিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। বিকেল ৫টার দিকে সদর উপজেলার ভেলানগর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয় গত ১৮ জুলাই। এদিন পুলিশের ধাওয়া খেয়ে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে খাল পার হতে গিয়ে ডুবে প্রাণ হারান রুদ্র সেন (১২)। তিনি শাবিপ্রবির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।
১৮ জুলাই উত্তরায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে আহত হয় অনেকে। সেদিন আহতদের যারা হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন, তাদেরই একজন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) এমবিএর শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ (১৩)। সঙ্গে ছিল বন্ধু নাইমুর রহমান আশিক। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ একটি গুলি এসে লাগে মুগ্ধর কপালে। তাৎক্ষণিকভাবে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
মুগ্ধ বিইউপিতে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (এমবিএ) অর্জনের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন চলতি বছরের মার্চে। এর আগে গত বছরই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা, গান এবং বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমেও ছিল তার সরব উপস্থিতি। কারো বিপদ দেখলেই সহযোগিতার জন্য ছুটে যেতেন বলে জানিয়েছেন তার বন্ধুরা।
এর আগে বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে উত্তরা আজমপুর থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হন মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচেলর অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বিবিএ) ডিপার্টমেন্টের ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী পারভেজ শাকিল (১৫)। পরে আহত অবস্থায় বাংলাদেশ মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
টঙ্গী সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী রিদোয়ান শরীফ রিয়াদ (১৬), যিনি গত ১৯ জুলাই শুক্রবার দুপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। তার বোন শিমু আহমেদ ফেসবুকে লেখেন, আমার ভাইকে মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। আমাদের হাসিখুশি পরিবার এক সেকেন্ডে শেষ।
১৯ জুলাই বিকেলে রাজধানীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সরকারী মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী মাহামুদুর রহমান সৈকত (১৭)। তিনি কলেজটির এইচএসসি ২০২৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। নিহত সৈকতের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায় বলে জানা গেছে।
কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পড়াশোনা শেষ করে মারুফ হোসেন (১৮) সপ্তাহ তিনেক আগে ঢাকায় এসেছিলেন চাকরি খুঁজতে। গত ১৯ জুলাই দুপুরে বাড্ডা এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ চলাকালে তার পিঠে গুলি লাগে। পরে তিনি হাসপাতালে মারা যান।
গত ২০ এপ্রিল দুপুরে যাত্রাবাড়ীতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিতে ইমাম হোসান তায়ীম (১৯) নামে এক কলেজছাত্র মারা গেছে। তার বাবা মইনাল হোসেন রাজরবাগ পুলিশ লাইনে উপ-পরিদর্শক (এসআই) হিসেবে কর্মরত। নিহত তায়ীম নারায়ণগঞ্জের একটি কলেজের ছাত্র বলে জানা গেছে।
গত ২৩ জুলাই সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তড়ুয়া (২০)। এর আগে ১৮ জুলাই চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। নিহত হৃদয় চন্দ্র তড়ুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি পটুয়াখালী জেলায় এবং তার বাবার নাম রতন চন্দ্র তড়ুয়া।
২১ জুলাই যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় এক বাসায় টিউশনিতে যায় মাইন উদ্দিন (২১) নামের এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। টিউশনি শেষ করে বাসায় ফেরার পথে তার গুলি লাগে। এরপর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল তিনি। বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) দিনগত রাত ২টার দিকে ঢামেকের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় এই মাদ্রাসা ছাত্রের।
গত ১৯ জুলাই ইমতিয়াজ রামপুরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন বেসরকারি সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদ ডালিম (২২)। শুক্রবার (২৬ জুলাই) ভোর ৪টার দিকে চিকিৎসাধীন থাকাকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার। তিনি সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বিবিএ) বিভাগে অধ্যয়নরত ছিলেন।
[নোট: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। পরবর্তীতে নিহত আরও শিক্ষার্থীর নাম-পরিচয় পাওয়া গেলে প্রতিবেদনটি আপডেট করা হবে]