রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির তিনটি নোটিশে ৯৮ ভুল
নোটিশে অসংগতি ও বানান ভুল যেন পিছু ছাড়ছে না রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। এ ভুল যেন এক প্রকার নিয়মে পরিণত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জারীকৃত বিজ্ঞপ্তি, অফিস আদেশ, চিঠিতে বিভিন্ন অসংগতি ও বানান ভুল নিয়ে দেশের জাতীয় দৈনিক ও বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে কয়েকবার নেতিবাচক শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ভর্তিসংক্রান্ত তিনটি নোটিশে ৯৮টি অসংগতি ও বানান ভুল চিহ্নিত করেছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস।
সবচেয়ে বেশি অসংগতি ও ভুল বানান পাওয়া গেছে বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত 'সি' ইউনিটের নোটিশে। এই নোটিশে অসংগতি ও ভুল বানান পাওয়া গেছে মোট ৪৮টি। যেখানে এই ধরনের ভুলের সংখ্যা 'বি' ইউনিটে ৩৩টি ও 'এ' ইউনিটে রয়েছে ১৭টি।
'সি' ইউনিটের ভর্তিসংক্রান্ত নোটিশ
গতকাল ৯ মে প্রকাশিত এই নোটিশে যে বানান ভুল ও অসংগতি রয়েছে তা বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী চিহ্নিত করা হলো। সেগুলো হলো- 'বি.এসসি, বি.ফার্ম, বি.এসসি.এজি, ডি.ভি.এম, বি.এসসি, ফিশারীজ, ভেটেরিনারী, এন্ড, অনুষদ এর, হল, ০৯:৩০টা, একাডেমিক, কোন, ভর্তি সংক্রান্ত, চলাকালীন সময়ে, পূরণ সংক্রান্ত, পরবর্তীতে, ৪.০০টার, সময়সূচী, দেয়ার, ফরম, এইচ.এস.সি./সমমান এর, কোন, চীফ কোঅর্ডিনেটর, ডীন, মোবাইল ('এ-কার'-এ মাত্রা দিয়ে লেখা হয়েছে), একাউন্ট।'
উপর্যুক্ত অসংগতি ও ভুল বানানগুলোর প্রমিতরূপ হলো- 'বিএসসি, বিফার্ম, বিএসসিএজি, ডিভিএম, বিএসসি, ফিশারিজ, ভেটেরিনারি, অ্যান্ড, অনুষদের অথবা অনুষদের, হলো, ০৯:৩০ মি:, অ্যাকাডেমিক, কোনো, ভর্তিসংক্রান্ত, চলাকালীন ('সময়' বাহুল্য), পূরণসংক্রান্ত, পরে অথবা পরবর্তীকালে, ৪:০০ টার অথবা ৪টার, সময়সূচি, দেওয়ার, ফর্ম, এইচএসসি/সমমানের, চিফ কোঅর্ডিনেটর, ডিন, অ্যাকাউন্ট।' কিছু কিছু জায়গায় একই ধরনের ভুল হওয়ায় পুনরাবৃত্তি এড়াতে সেগুলো প্রতিবেদক উল্লেখ করেননি।
'বি' ইউনিটের ভর্তিসংক্রান্ত নোটিশ
'বি' ইউনিটের নোটিশে অসংগতি ও ভুল বানানগুলো হলো 'তারিখঃ, হল, ভতির্চ্ছু, একাডেমিক, কোন, পরবর্তীতে, ওয়েব সাইটে, ফরম, ডীনস্, ভর্তিকৃত, Automigration এর, ক্লাশ, ছাত্র-ছাত্রীদেরকে, হবেঃ, ভর্তি সংক্রান্ত, তথ্যাবলী, (http://admission.ru.ac.bd এর, চলাকালীন সময়ে, ডকুমেন্ট সমুহের, এস.এস.সি., এইচ.এস.সি, মাকর্সশীট, ৩ কপি এর, মুল, শর্তাবলীঃ, তথ্যাবলীতে, চীফ কোঅর্ডিনেটর।'
উপর্যুক্ত অসংগতি ও ভুল বানানগুলোর প্রমিতরূপ হলো 'তারিখ:, হলো, ভর্তিচ্ছু, অ্যাকাডেমিক, কোনো, পরে বা পরবর্তীকালে, ওয়েবসাইটে, ফর্ম, ডিনস্, ভর্তীকৃত, Automigration-এর, ক্লাস, ছাত্র-ছাত্রীদের ('র' বিভক্তির পর 'কে' বিভক্তি দেওয়া ঠিক নয়।), হবে:, ভর্তিসংক্রান্ত, তথ্যাবলি, (http://admission.ru.ac.bd-এর, চলাকালীন ('সময়ে' বাহুল্য), ডকুমেন্টসমূহের, এসএসসি, এইচএসসি, মাকর্সশিট, ৩ কপি-এর, মূল, শর্তাবলি:, তথ্যাবলিতে, চিফ কোঅর্ডিনেটর।'
আরো পড়ুন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বিজ্ঞপ্তিতে দুশোর বেশি ভুল
'এ' ইউনিটের ভর্তিসংক্রান্ত নোটিশ
'এ' ইউনিটের নোটিশের অসংগতি ও ভুল বানানগুলো হলো 'ভর্তি সংক্রান্ত, প্রার্থীদেরকে, দেয়া, চীফ কোঅর্ডিনেটর, ডীনস্, কোন, ফরম, মার্কশীট, ডীন।'
উপর্যুক্ত অসংগতি ও ভুল বানানগুলোর প্রমিতরূপ হলো 'ভর্তিসংক্রান্ত, প্রার্থীদের ('র' বিভক্তির পর 'কে' বিভক্তি দেওয়া ঠিক না।), দেওয়া, চিফ কোঅর্ডিনেটর, ডিনস্, কোনো, ফর্ম, মার্কশিট, ডিন।'
উপর্যুক্ত নোটিশে যে ভুলগুলো হয়েছে তার মধ্যে কিছু ভুলের ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো-
শব্দের শেষে করণ, কৃত, ভবন, ভূত প্রভৃতি প্রত্যয় যুক্ত (চ্বি প্রত্যয়-সহ) হলে ঈ-কার আগম হয়। যেমন: আত্ত থেকে আত্তীকৃত; এক থেকে একীকৃত, একত্র থেকে একত্রীকৃত। ঘন থেকে ঘনীকৃত, সম থেকে সমীকৃত ইত্যাদি। সে হিসেবে 'ভর্তিকৃত' না হয়ে হবে 'ভর্তীকৃত'।
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের পরিশিষ্টে (পরিশিষ্ট গ) বাংলা তারিখ ও সময় কীভাবে লিখতে হবে তা বর্ণিত হয়েছে। সে অনুযায়ী, '০৯:৩০টা' এবং '৪.০০টার' না হয়ে '০৯:৩০ মি:', '৪:০০ টার' অথবা '৪টার' হবে।
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান [পরিমার্জিত সংস্করণের তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ (এপ্রিল ২০১৮)] বলছে, ‘ডিগ্রি’-র নামের বানানের সংক্ষেপণে ডট (.) থাকবে না। লিখতে হবে ডট (.) ছাড়া এবং নিরেটভাবে। যেমন: এইচএসসি, এসএসসি, এমএ, এমএসসি, এমডি, এমকম, বিএ, বিএল, বিএসসি, বিকম। ব্যতিক্রম: এম বি বি এস। অন্যান্য সংক্ষেপণের ক্ষেত্রেও ‘মুণ্ডমাল শব্দের’ ন্যায় একই রীতি অনুসৃত হবে। যেমন: এসএমএস, ঢাবি, রাবি, চবি, ইউএনও। এই নিয়মের বাইরে গিয়ে সব জায়গায় 'এস.এস.সি., এইচ.এস.সি, বি.ফার্ম, বি.এসসি.এজি, ডি.ভি.এম, বি.এসসি' লেখা হয়েছে। যা ভুল।
বিসর্গ (ঃ) কোনো যতিচিহ্ন নয়, এটি বাংলা বর্ণমালার একটি স্বাধীন বর্ণ, এর নিজস্ব উচ্চারণ আছে। পদান্তে অবস্থিত বিসর্গ বর্ণের উচ্চারণ: হ্। যতিচিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত কোলন (:) বা সংক্ষেপণচিহ্নের (.) স্থলে বিসর্গ বিধেয় নয়। এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে কয়েক জায়গায়।
'সংক্রান্ত', 'এর' এই শব্দদ্বয় পূর্ববর্তী শব্দের সাথে সেঁটে বসার নিয়ম থাকলেও অগ্রাহ্য করে কয়েক জায়গায় লেখা হয়েছে 'ভর্তি সংক্রান্ত', 'পূরণ সংক্রান্ত' যা হবে যথাক্রমে 'ভর্তিসংক্রান্ত' ও 'পূরণসংক্রান্ত'। তাছাড়া 'নেওয়া' অর্থে নেয়া ও 'দেওয়া' অর্থে দেয়া ব্যবহার করা হয়েছে। যা চরম ভুল ও হাস্যকর অর্থ তৈরি করে। কারণ 'দেয়া ও নেয়া' শব্দদ্বয়ের নিজস্ব অর্থ আছে।
বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম পুস্তিকার ২.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল অতৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি ও মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের কারচিহ্ন ব্যবহৃত হবে। কারণ বাংলায় উচ্চারণগত দীর্ঘস্বর নেই। ই ঈ এবং উ ঊ প্রভৃতির উচ্চারণ অভিন্ন। তাই অতৎসম (দেশি, বিদেশি) শব্দে ঈ-কার নিষ্প্রয়োজন। উপর্যুক্ত তিনটি নোটিশে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে ১৪টি শব্দের ক্ষেত্রে।
‘কোন’ শব্দটি যখন সর্বনাম হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন এর অর্থ: কী, কে, কোনটি (কোন দিন, কোনটি চাই, কোন জন)। এটি কোনও বা কোনো শব্দের সমার্থক নয়। যেমন: “আপনি কোন দেশে থাকেন?” বাক্যে একই অর্থ প্রকাশের জন্য ‘কোনও’ বা ‘কোনো’ পদ ব্যবহার করা যাবে না। বাক্যে সর্বনাম ও বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত বাংলা ‘কোনো’ শব্দের অর্থ অনির্দিষ্ট বা অনির্ধারিত একজন লোক বিষয় বা বস্তু, কে বা কী (কোনো বিষয়), বহুর মধ্যে একটি বা একজন। নোটিশগুলোতে ‘কোনো’-এর পরিবর্তে 'কোন' লেখা হয়েছে। যা পরিহার্য।
‘পরবর্তী’ অর্থ 'পরে অবস্থিত'। ‘পরবর্তী’ শব্দের অব্যবহিত পরে কোনো বিষয় বা ধারণা যুক্ত হলেই কেবল শব্দটির অর্থ জাগ্রত হয়ে ওঠে। যেমন: পরবর্তী বছর, পরবর্তী সময়, পরবর্তী যুগ, পরবর্তী মানুষ, পরবর্তী শ্রেণি, পরবর্তী পদোন্নতি, পরবর্তী পৃষ্ঠা, পরবর্তী গ্রন্থ, পরবর্তী সারি, পরবর্তী দোকান, পরবর্তী শহর। 'পরবর্তীতে' একটি ভুল প্রয়োগ। নোটিশে 'পরবর্তীতে' না লিখে 'পরবর্তীকালে/পরে' লেখা সমীচীন ছিল।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার ২.২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে— বাংলায় এ বর্ণ বা -েকার দিয়ে এ এবং অ্যা এই উভয় ধ্বনি নির্দেশিত হয়। যেমন: কেন, কেনো (ক্রয় করো); খেলা, খেলি; গেল, গেলে, গেছে; দেখা, দেখি; জেনো, যেন; ব্যাঙ, ল্যাঠা। তবে বিদেশি শব্দে ক্ষেত্র অনুযায়ী অ্যা বা ্যা-কার ব্যবহৃত হবে। সেক্ষেত্রে 'একাউন্ট', 'অ্যাকাডেমি', 'এন্ড' না হয়ে 'অ্যাকাউন্ট', 'অ্যাকাডেমি', 'অ্যান্ড' হবে।
আরো পড়ুন: যে শব্দ নেই অভিধানে, তা দিয়েই শুরু হয় রাবির নোটিশ
ভুলের বিষয়ে ‘বি’ ইউনিটের চিফ কো-অর্ডিনেটর ও বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবু সাদেক মো. কামরুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এটা বাংলা ফন্টের কোনো গোলমালের কারণে হয়েছে হয়তো। যেহেতু ইনফরমেশনে কোনো গড়মিল নেই তাহলে এটা বড় কোনো সমস্যা না। কারণ ইনফরমেশনটাই মূল বিষয়। তবুও বানান ভুল থাকাটা একদমই ঠিক না। এত বানান কেন ভুল হবে! বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা রেপুটেশনের বিষয় আছে। যারা টাইপ করেছে তাদের আমি এখনই বিষয়টা জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ড. মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। পূর্বেও এটি নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক করা হয়েছে। তারপরও নোটিশে এতগুলো ভুল কখনোই কাম্য নয়। বিভাগসংশ্লিষ্ট যাঁরা এ দায়িত্বে রয়েছেন তাদের অবহিত করা হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ক্ষুণ্ণ করায় তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।