ঢাবি শিক্ষার্থীদের নাগালের বাইরে কফি হাটের খাবার, ক্রেতারা বহিরাগত
- জোবায়ের হোসাইন
- প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৪৪ AM , আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৩৩ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সামনেই কফি হাট, যা ‘ডিইউ কফি হাট’ নামে পরিচিত। অনুষদ ভবনের সামনে সৌন্দর্যবর্ধনের পর সেখানে ফুড কোর্টটি বসানো হয়। এতে শিক্ষার্থীদের আশা ছিল, স্বল্প দামে মানসম্মত খাবার খেতে পারবেন তারা। তবে হয়েছে উল্টো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এখানকার খাবার খাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
অথচ শিক্ষার্থীদের কথা ভেবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতিক্রমে ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কফি হাট। কিন্তু চড়া দামের কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই খেতে পারেন না সেখানে। উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থী এবং বহিরাগতরা এর মূল ক্রেতা। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, কফি হাটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাধ্যের মধ্যে খাবার নেই। দাম বেশি হওয়ার পাশাপাশি মান নিয়েও প্রশ্ন তাদের। পাশাপাশি ময়লা ফেলায় জায়গাটি আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
জানা গেছে, জায়গাটিতে নিয়মিত আড্ডা দেন শিক্ষার্থীরা। তবে আগে আশপাশে মানসম্মত খাবারের দোকান ছিল না। এ ছাড়া সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী বিপুল সংখ্যক হলেও তাদের জন্য কোনো ক্যান্টিন নেই। ফলে তাদেরকে যেতে হয় হল, চারুকলা অথবা শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের ক্যান্টিনে। অনেকে পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের ক্যান্টিনেও দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য যায়।
তবে সময় স্বল্পতা ও ক্লাস থাকায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীই যেতে পারেন না দূরে। ফলে তাদেরকে কফি হাট অথবা পাশের হাকিম চত্বরের দোকানের ওপর নির্ভর থাকতে হয়। কিন্তু অন্যান্য দোকানে খাবারের সহনীয় দাম ও মান ভালো থাকলেও কফি হাটে দাম চড়া। সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য সহনীয় মূল্যের কোনো খাবার না রেখে বেশি দামের ফাস্টফুডের রমরমা ব্যবসা করছে রেস্তোরাঁটি।
শিক্ষার্থীদের কথা ভেবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতিক্রমে ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কফি হাট। কিন্তু চড়া দামের কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই খেতে পারেন না সেখানে। উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থী এবং বহিরাগতরা এর মূল ক্রেতা।
এসব দামি খাবারের ক্রেতা অধিকাংশই বহিরাগত। বিশেষ করে সন্ধ্যায় বাইরের মানুষের আনাগোনা বাড়লে তখন বিক্রিও বেড়ে যায় কয়েকগুন। তাদের ফেলা চা ও কফির কাপ এবং রেস্তোরাঁর ময়লায় নষ্ট হচ্ছে আশেপাশের পরিবেশও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাহিম হোসেন বলছিলেন, কফি হাটে যেসব খাবার পাওয়া যায়, তা স্বাস্থসম্মত নয়। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীরা সাধারণত এসব খাবার খায় না। কফি হাটের পরিবেশও খাওয়া-দাওয়ার উপযোগী নয়। মান বিবেচনায় খাবারের দাম বেশি। শিক্ষার্থীদের পক্ষে এখানে খাওয়া কষ্টকর। আশেপাশে কোনো ক্যান্টিন না থাকায় দুপুরে খেতে ছুটতে হয় চারুকলায় বা হলে। কখনো কখনো ক্লাসের মাঝে অত সময় পাওয়া যায় না। কাছাকাছি খাবার না পাওয়ায় অনেকে না খেয়েও থাকে।
সোমবার সরেজমিনে কফি হাটের খাবার ও মূল্য তালিকা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, সেখানে দেশীয় প্রচলিত তেমন কোনও খাবার নেই। তালিকা অনুযায়ী, ফ্রাইড রাইসের সঙ্গে চিকেন মাসালা ও ভেজিটেবলের দাম ১১০ টাকা, ফ্রাইড রাইসের সঙ্গে থাই চিকেন ফ্রাই ও ভেজিটেবলের দাম ১২৫, ফ্রাইড রাইসের সঙ্গে চিকেন ফ্রাই এবং ভেজিটেবল ১২৫, ফ্রাইড রাইসের সঙ্গে চিকেন ও চিকেন ফ্রাই ২১০, বার্গার ও কোল্ড কফি ১৫০ টাকা, চিকেন বার্গার ও ড্রিংকস ১৪৫, বিফ বার্গারের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও ড্রিংকস ১৫৫, দু’পিস ফ্রাইড চিকেনের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও ড্রিংকসে দাম ২০০ টাকা।
জানা গেছে, কফি হাটের প্রায় প্রতিটি পদের খাবারের দাম ১২০ থেকে ২০০ টাকা। শুধু স্যান্ডুইচের দাম ৪০-৫০ টাকা। তবে তা সব সময় পাওয়া যায় না। এর আগে তুলনামূলক কম দামে খিচুড়ি পাওয়া গেলেও এখন আর রাখা হয় না।
শিক্ষার্থী ছাব্বিরুল ইসলামের ভাষ্য, কফি হাটের সব কিছুর দামই চড়া। এ দামটা অনেকটা ধানমন্ডির অভিজাত রেস্তোরাঁয় খেলে যেমন আসে, তেমনই। একজন স্টুডেন্টের জন্য এমন দাম কখনোই সুবিধাজনক নয়। এটি একটা ক্যাম্পাসের হওয়ায় দাম শিক্ষার্থীদের নাগালের মধ্যে হওয়া দরকার। কফি হাটের প্লেটগুলো অপরিচ্ছন্ন থাকে। পাশের জায়গাও অপরিচ্ছন্ন। দেশীয় সাধারণ খাবার থাকা দরকার ছিল। সর্বোপরি এটিকে শিক্ষার্থীবান্ধব করে তুলতে হবে।
দাম ও মান নিয়ে একই ধরনের অভিযোগ করে উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী কৌশিক হাসান পরশ বলছিলেন, কফি হাটের খাবারের মান এবং দামের সমন্বয় করা জরুরি। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের চাহিদার খাবারগুলো পাওয়া যায় না। বেশিরভাগই বিদেশি। চড়া দামে সেগুলো কেনা শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় অসম্ভব। প্লেটগুলো যেভাবে নোংরা অবস্থায় ফেলে রাখা হয়, তা পরে কতটুকু পরিস্কার করা হয়, সে বিষয়েও সন্দেহ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে খাবার রাখা ও দাম নির্ধারণ করা জরুরি।
আরো পড়ুন: ঢাবির ভর্তি আবেদনের ওয়েবসাইট বন্ধ, যা বলছে কর্তৃপক্ষ
দাম নাগালের বাইরে থাকলেও পরিমাণেও কম থাকে বলে অভিযোগ আরেক শিক্ষার্থী নাবিলা রহিমের। তিনি জানান, ৬০ টাকার যে রাইস ও সবজির প্যাকেজ ছিল, সেখানে শুধু মুরগির মাংস যোগ করে দাম করা হয়েছে ১২০ টাকা। আবার সব সময় খাবার পাওয়াও যায় না।
শিক্ষার্থী ছাব্বিরুল ইসলামের ভাষ্য, কফি হাটের সব কিছুর দামই চড়া। এ দামটা অনেকটা ধানমন্ডির অভিজাত রেস্তোরাঁয় খেলে যেমন আসে, তেমনই। একজন স্টুডেন্টের জন্য এমন দাম কখনোই সুবিধাজনক নয়। এটি একটা ক্যাম্পাসের হওয়ায় দাম শিক্ষার্থীদের নাগালের মধ্যে হওয়া দরকার।
এ বিষয়ে রেস্তোরাঁ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আসিফ আহমেদ মিরাজ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে ১ লাখ টাকা ভাড়া দিতে হয়। পাশাপাশি রাঁধুনিসহ ১৫ জন কর্মচারী রয়েছে, যাদের পারিশ্রমিক প্রতি মাসে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এছাড়া গ্যাস বিল ৮০ হাজার, পানি বিল ১ হাজার এবং ময়লা বিল ৮০০ টাকার সঙ্গে বিদ্যুৎ বিলও আছে। এসব কিছু মিলিয়ে কম দামে খাবার বিক্রি করা যায় না। দামি সামগ্রী খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকে এ ধরনের খাবার কেনার সক্ষমতা রাখে না স্বীকার করে তিনি বলেন, আগে কম দামে খিচুড়ি বিক্রি করতেন। তবে কিছুদিনের জন্য বন্ধ আছে। তাছাড়া স্যান্ডউইচ ও ফুচকা ৪০ টাকায় বিক্রি হয়। এ সময় তিনি শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে কম দামি খাবারও বিক্রির আশ্বাস দেন।
রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আগে কফি হাটের ভাড়া ছিলো ৫১ হাজার ৭৫০ টাকা। এ বছর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেটি বাড়িয়ে করেছে ১ লাখ টাকা। এ রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন অন্তত ৬০ হাজার টাকার খাবার বিক্রি হয়। সে হিসাবে এক মাসে তাদের বিক্রি হয় প্রায় ১৮ লাখ টাকার খাবার। তবে বিশেষ দিনগুলোতে বিক্রি লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এভাবে তারা রমরমা ব্যবসা করলেও শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাকসুদুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘খাবারের দাম বেশি ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সামর্থ্যের বাইরে, সে বিষয়ে আমরা অবগত আছি। এ ধরনের কার্যক্রমের জন্য তাদেরকে কয়েকবার জরিমানাও করা হয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলে দাম কমানোর চেষ্টা করছি। দোকানের যে সার্বিক পরিবেশ ও খাবারের মান, এগুলো নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে।’
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, এ ধরনের রেস্তোরাঁ অনুষদের সামনের পরিবেশ নষ্ট করছে। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলছে, বহিরাগত বাড়ছে। বার বার জরিমানা করা হলেও তাদের ব্যবসায় এত লাভ যে, দ্রুত পরিশোধ করে। প্রক্টোরিয়াল টিমের সহায়তায় এ দোকানটি তুলে দেওয়া উচিৎ। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যান্টিন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আরো পড়ুন: ডিইউ কফি হাটে একই থালায় খাচ্ছে মানুষ ও কুকুর, স্বাস্থ্যঝুঁকির শঙ্কা
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসার ফাতিমা বিনতে মুস্তাফা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি কফি হাট পরিদর্শন করেছি। এ বছর তাদের ভাড়া দ্বিগুন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আমাদের একটা তদারকি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন উপাচার্য। প্রতিবেদন আসলে আশা করছি ভালো কিছু হবে, যেটা শিক্ষার্থী বান্ধব। তাদের মূল্য তালিকা ও খাবারের তালিকা দেখেছি। সেটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সামর্থ্যের বাইরে।’
তিনি বলেন, ‘পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তাদেরকে সতর্ক করেছি। প্লেট ও রান্নার সরঞ্জামের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভিম ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। পাশাপাশি সবচেয়ে বড় যে বিষয়, ফিল্টারকৃত পানি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। শিক্ষার্থীরা লাইনের পানিই পান করছে। এটি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। তারা যেন অবশ্যই ফিল্টার ব্যবহার করে, কঠোরভাবে সে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’