গৌরবের ২৮ বছরে চবি সাংবাদিক সমিতি

আলোচনা সভা
আলোচনা সভা  © টিডিসি ফটো

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (চবিসাস)। ২৭ পেরিয়ে পদার্পণ করেছে ২৮বছরে। ‘আটাশে চবিসাস, প্রাণখোলা উচ্ছ্বাস’ স্লোগানে ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে।  

বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) সকাল ১১টায় শুরু হওয়া আনন্দ শোভাযাত্রা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা ও প্রবন্ধ উপস্থাপন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখ্তার। 

চবিসাসের সভাপতি মাহবুব এ রহমানের সভাপতিত্বে এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌল্লাহ, চবি জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক ড. বশির আহাম্মদ, প্রক্টর অধ্যাপক ড. নূরুল আজিম সিকদার। এছাড়াও এতে উপস্থিত ছিলেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আমীর মুহাম্মদ মুছা, সিন্ডিকেট সদস্য মোহাম্মদ আলী এবং সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়া। 

চুয়েট সাংবাদিক সমিতির সভাপতি বলেন, চবিসাসের প্রতি আমাদের ভালোবাসা থাকায় আজকে এখানে ছুটে এসেছি। চবিসাসের সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন নিপীড়নের প্রতিবাদ যেন চুয়েট থেকেই আসে সেজন্য আমরা সবসময়ই আন্তরিক। 

সাবেক সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের চৌধুরী বলেন, সারাদেশে সাংবাদিকতার একটা বিরাট সংকট দেখা যাচ্ছে। এতো বেশি প্রতিযোগিতার মধ্যে পেশা হিসেবে এতে বিরাট সংকট তৈরী হয়েছে। দেশের ভালো সাংবাদিকেরা ক্যাম্পাস থেকেই বেড়ে উঠেন। এই সংকট যেন কেটে উঠে তা আমরা দেখতে চাই। 

চবিসাসের সাবেক সভাপতি আসহাবুর রহমান শোয়েব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা করতে অনেক সাংবাদিকের রক্ত ঝরেছে। যা অন্যকোনো সংগঠনের ক্ষেত্রে ঘটে না। কিন্তু আমাদের উপাচার্য ইতিবাচক চিন্তা করে সংবাদ করার কথা বলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম হিসেবে ইতিবাচক কিছু ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতিবাচক কিছু ঘটলে তা খুঁজে বের করাই সাংবাদিকদের মূল কাজ। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত হচ্ছে সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা না করে সহকারী হিসেবে বিবেচনা করবেন। এতেই সাংবাদিকদের থেকে ইতিবাচক সহযোগিতা পাবেন। সাংবাদিকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল অনিয়ম তুলে ধরবেন এটাই ইতিবাচকতা। কিন্তু প্রশাসনের সামনে একজন শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করা হলেও  তাঁরা লিখিত অভিযোগের নামে সময়ক্ষেপণ করেন। এতে দোষীরা চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ পেয়ে যান। 

সাবেক সভাপতি হুমায়ুন মাসুদ বলেন, সাংবাদিকরা কখনো হলুদ সাংবাদিকতা করেন না। যারা হলুদ সাংবাদিকতা করেন তারা সাংবাদিক না। ক্যাম্পাসের ক্ষেত্রে হলুদ সাংবাদিকতা কখনোই করার সুযোগ নাই। এই সাংবাদিক সমিতিই বিশ্ববিদ্যালয়কে গত ২৭ বছর ধরে বিশ্বের সামনে ব্রান্ডিং করে যাচ্ছে যা আর কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন করতে পারেনি। 

'সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩: সাংবাদিকতায় নেতিবাচক প্রভাবও করণীয়' শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপনে সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহাব উদ্দিন নীপু বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা জ্বলে বাস করে কুমিরের সাথে ঝগড়া করার মতোই। এটা ব্যক্তিগত বিরোধ নয়,পেশাগত। সত্যকে তুলে ধরতে গিয়ে তৈরী হয়। এটাই ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার বাস্তবতা। 

আরও পড়ুন: কানাডার ভিজিট ভিসা পেতে যা জানা দরকার, আবেদন যেভাবে

স্বাভাবিক অবস্থার ব্যতিক্রম হওয়াটাই হচ্ছে সংবাদ যা লেকে জানতে চায়৷ ইতিবাচক সাংবাদিকতা বলে সাংবাদিকতাকে অবদমিত করার চেষ্টা করা হতে দেখা যায়। 

২০০৬ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত এই আইনের অধীনে অনেক মানুষকে মামলা দেওয়া হয়। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের ভূমিকায় সরকার চাপের মুখে পড়ে এটি পরিবর্তন করেছে। সাংবাদিকতা বর্তমানে ভেতর ও বাহির থেকে চাপে আছে। বহুজাতিক কোম্পানির মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যম হওয়ায় বিভিন্ন সমস্যার তৈরী হয়েছে। এছাড়াও সংবাদমাধ্যমগুলো বিভিন্ন আদর্শে বিভাজিত হয়ে গেছে। সংবাদমাধ্যম গুলোর  মধ্যে কোনো একতা নাই। ফলে সরকারও এমন আইন করতে সক্ষম হয়েছে। 

নতুন আইনে অজামিনযোগ্য ধারা কমিয়ে চারটি করা হয়েছে। এছাড়াও কিছু ধারাকে আরো সুনির্দিষ্ট ও পরিষ্কার করা হয়েছে। তবে সমালোচিত ধারাগুলো এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে বলেই সাংবাদিকরা নিজেদের নিরাপদ মনে করছেন না। বর্তমানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা খুবই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। কারণ, সংবাদমাধ্যমকে আইনের বেড়াজালে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এজন্য সাংবাদিকদের এই আইন নিয়ে বিস্তারিত জানতে হবে। সরকার যেমন কৌশলী হয়েছে, সাংবাদিকদেরও তেমন কৌশলী হতে হবে। এ আইনে পুলিশকে অবারিত ক্ষমতা দেওয়ায় সাংবাদিকদের অনেক বেশি জানাশোনা প্রয়োজন।

প্রক্টর অধ্যাপক ড. নূরল আজিম সিকদার বলেন, ১৯৯৬ সালে শুরু হওয়া এই সংগঠন আজকে আটাশের প্রাণখোলা উচ্ছ্বাসে আমি অংশগ্রহণ করতে পেরে আনন্দিত হয়েছি। আমরা চাই আপনারা বিশ্ববাসীর কাছে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরবেন। আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে তৈরী করতে নিরলসভাবে কাজ করছি। স্মার্ট বাংলাদেশের অন্যতম অংশীদার আপনারা। আমরা আপনাদের মতো স্মার্ট সাংবাদিকদের নিয়ে গর্ববোধ করি। আপনারা সাংবাদিকতার সকল মৌলিকগুনে নিজেদের গুণান্বিত করবেন। 

জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক ড. বশির আহাম্মদ বলেন, আজকের সংবাদপত্র আগামীদিনের ইতিহাস।  একটি সংবাদ মাধ্যম, একজন সাংবাদিক অন্য দশজনের মতো রাজনীতি নিয়ে দলবাজি করতে পারেন না। তবে তাঁদেরও রাজনীতির অধিকার আছে। সংবাদপত্রে বিভিন্ন সংবাদ আসবে, কিন্তু সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠতা পাঠককে নির্ধারণ করতে হবে৷ ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ থেকে যেসকল পত্রিকা বের হতো সেগুলোর উপর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সেন্সরশিপ আরোপ করেছিল। ফলে কলকাতার সংবাদপত্রগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভিন্নধর্মী সংবাদ প্রকাশ করেছে। 

বিশেষ অতিথি হিসেবে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌলাহ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে তথ্যের আধারে তৈরী হয়েছে বলা হচ্ছে। তার মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নানান অনিয়ম বেড়েছে। তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে তথ্য পাওয়ার একটা বিষয় আছে। 

রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা থাকেন তারা তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য নানান কৌশল ব্যবহার করার রীতি পূর্বে থেকে চলে এসেছে। বর্তমানে সংবাদমাধ্যমগুলোকে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে বলে সংবাদমাধ্যম দুর্বল হয়ে পড়েছে।  কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সাংবাদিকতা থেমে যাবে। এটা একটা ক্রান্তিকালীন সময় চলছে বলা যেতে পারে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করার মাধ্যমে এই পেশাকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে এগিয়ে নিতে হবে। আপনারা ভয় নিয়ে বসে থাকবেন না। ভয় শীঘ্রই কেটে যাবে।  

উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির ২৭ বছর পূর্ণ হয়েছে। সমিতির সাবেক নেতৃবৃন্দ এসে উপস্থিত হওয়ায় দেখে ভালো লাগছে। সাংবাদিক সমিতি ৬ জন দিয়ে শুরু হয়েছিল। আজ তা ৩১ জনে দাঁড়িয়েছে। সাংবাদিকেরা জাতির বিবেক। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছুই জাতির সম্মুখে তুলে ধরেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে সংবাদ পরিবেশনে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রেখে চলতে হবে। আমাদের খারাপ কাজ কতটুকু হয়েছে জানিনা কিন্তু ভালো কাজের নিদর্শনও কম নাই। ব্যক্তিকে অপছন্দ করলেও বিশ্ববিদ্যালয় তোমাদের। তাই ইতিবাচক লেখাগুলো তুলে ধরবে বলে বিশ্বাস রাখি। 

তিনি বলেন, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা খুবই মেধাবী। আমরা চাই আমাদের সন্তানদের শিক্ষিত করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়কে ইতিবাচকভাবে জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে। এখন সময় পরিবর্তন হয়েছে। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে আছে। মেয়েরা মনে করে ফলাফল ভালো না করলে তাঁদের বিয়ে দিয়ে দিবে। তাই তারা ভালো পড়াশোনা করে ফলাফল ভালো করছে। 

তিনি আরো বলেন, আমরা আজকের জন্য কাজ করছি না। আমরা আগামী ৫০ বছর পরে কি হবে তা নিয়ে চিন্তা করছি। আমরা সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে এগিয়ে যাবো। বিদেশের অনেক এ্যালামনাই আমাদের সহযোগিতা করবেন বলেছেন। আমরা মেডিক্যাল সেন্টার তৈরি পরিকল্পনা করছি। এছাড়াও আমরা র‍্যাংকিংয়ে যাওয়ার জন্য কমিটি করেছি। আগামী বছরে হয়তো আমরা র‍্যাংকিংয়ে থাকতে পারবো। এছাড়াও আমরা কনফুসিয়াস সেন্টার করেছি সেখানে অনলাইনে পাঠদান চলছে। এছাড়াও বিশ্বের দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এমওইউ করেছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, তার কোনো শেষ হবে না৷ আমরা স্বপ্ন দেখে চলেছি। তাই তোমাদের এসব দেখে পজিটিভ সংবাদ করতে হবে। সবাই মিলে চেষ্টা করো যেন বিশ্ববিদ্যালয় ভালো জায়গায় নিয়ে যেতে পারি। অনুসন্ধানের মাধ্যমে সত্য জাতির সামনে উন্মোচন করবে তোমরাই। চবিসাসের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করছি।


সর্বশেষ সংবাদ