ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মধুর ক্যান্টিনের দিতে হয় না ভাড়া-বিল, তবুও দাম চড়া খাবারের
- জোবায়ের হোসাইন, ঢাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৩, ০৩:২২ PM , আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:৫৪ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মধুর ক্যান্টিন (রেস্তোরাঁ)। বর্তমানে এটি রেস্তোরাঁ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই ক্যান্টিনের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিলসহ সব ধরনের খরচ বহন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাছাড়াও দিতে হয় না কোনো ধরনের মাসিক ভাড়া।
তবুও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এখানে খাবারের মান নিম্নমানের হলেও দাম অত্যধিক চড়া। এছাড়াও সেখানকার কর্মচারীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। ক্যান্টিনের পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অরুণ দে জানান, বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ার কারণে এর প্রভাব পড়েছে ক্যান্টিনের খাবারের মূল্যে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বলছেন, এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।
জানা যায়, মধুদা ছিলেন একজন সাধারণ রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী। তার আসল নাম মধুসূদন দে। সবাই ডাকতেন ‘মধুদা’। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের উত্তর-পূর্ব দিকে যে রেস্তোরাঁ, এই মধুদার নামেই তাঁর নাম হয়েছে। মধুদার রেস্তোরাঁ সবার কাছে এখন ‘মধুর ক্যান্টিন’ নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তান-পর্বে এখানে অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পরিকল্পনা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন আন্দোলনে ছাত্রদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মধুর ক্যান্টিন সেসব আন্দোলন আর সংগ্রাম-পরিকল্পনার সাক্ষী হয়ে আছে। ছাত্র রাজনীতির প্রায় সকল কার্যক্রম এখনো মধুর ক্যান্টিন ঘিরেই হয়ে থাকে।
মধুর ক্যান্টিনের বর্তমান পরিচালক হলেন মধুদার ছেলে অরুণ দে। ক্যান্টিনে কানাই এবং মাইকেল নামে দুজন কর্মচারী কাজ করেন। জানা যায়, সারাদিন কর্মচারীরা কাজ করার পর রাতে অরুণ দে এসে হিসাব বুঝে নিয়ে চলে যায়। তবে খাবারের দাম বেশি হওয়ায় সেখানে আগের থেকে কম যাতায়াত করেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল দোকান ঘুরে জানা যায়, হলের দোকানগুলো হল প্রশাসনকে মাসিক ভাড়া দিতে হয়। এছাড়াও বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল দোকানদাররা নিজেরাই বহন করে। তাছাড়া বিভিন্ন সময় ছাত্রসংগঠনের নেতাদের দোকানগুলো থেকে মাসিক চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এত কিছুর পরেও দোকানগুলোতে চা বিক্রি হয় ৭ টাকায়, সিঙ্গাড়া বিক্রি হয় ৫ টাকায়, স্যান্ডউইচ ২৫ থেকে ৩০ টাকায় আর সমুচা পাওয়া যায় ৫ টাকায়।
অপরদিকে কোনো ধরনের বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল না দিয়েও মধুর ক্যান্টিনে খাবারের তালিকা অনুযায়ী সিংগারা ১০ টাকা, সবজি রোল ১৫ টাকা, সমুচা ১০ টাকা, স্যান্ডউইচ ৬৫ টাকা, শর্মা ৮৫ টাকা, পুডিং ৩৫ টাকা, পাটিসাপ্টা ২৫ টাকা, ব্রেড বাটার ৪০ টাকা, রং চা ১০ টাকা, ছানা ছোট ২ টুকরা ৩৫ টাকা, ছোট ৫ পিচ মিষ্টি ৫০ টাকা প্লেট এবং কেক ১৫ টাকা দাম রাখা হয়।
শিক্ষার্থীরা বলছে, খাবারের মান অনুযায়ী দাম অত্যধিক বেশি। এত দাম দিয়ে কিছু খাওয়ার সামর্থ্য সবসময় সব শিক্ষার্থীদের থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাকিল শেখ জানান, আমাদের হলে বা অন্যান্য হলে যে সিংগারা, সমুচা বিক্রি করে তার সাইজ আর মধুর ক্যান্টিনের সিংগারা সমুচার সাইজ একই। কিন্তু স্বাদ আহামরি না হলেও দাম বেশি নেওয়া হয়। ১০ টাকার চায়ে লিকারের পরিমাণ না বললেই চলে। এত খারাপ চা মধুর ক্যান্টিন ছাড়া অন্য কোথাও নেই। মধুদার স্মৃতি বিজড়িত এই ক্যান্টিনের মত একটা ঐতিহাসিক স্থানে এ ধরনের অব্যবস্থাপনা কাম্য নয়।
আরেক শিক্ষার্থী রাকিবুজ্জামান জানান, মধুর ক্যান্টিনের বাহ্যিক দিকটা সংস্করণ করা হলেও ভেতরের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। চেয়ার-টেবিলের অনেকগুলো রয়েছে ভাঙা-অর্ধ ভাঙা। খাবারের অবস্থা তো আরও খারাপ। একদিকে চেয়ার টেবিলের অবস্থা খুব একটা ভালো না, খাবারের মান ভালো না তার উপর আবার দাম অত্যধিক বেশি। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজর দেওয়া উচিত।
এছাড়াও ক্যান্টিনের দুই কর্মচারীর ব্যবহার নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। একাধিক শিক্ষার্থী জানান, মধুর ক্যান্টিনের দুই কর্মচারী রুবেল (মাইকেল) এবং কানাই শিক্ষার্থীদের সাথে খারাপ আচরণ করে। সরেজমিনে গিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। তবে অনেকেই মনে করছেন কানাই এবং মাইকেল মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ নন।
খাবারের দাম বেশি কেন এবং ব্যবহার নিয়ে জানতে চাইলে কানাই এবং মাইকেল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, খাবারের দাম অরুণ দে কর্তৃক ঠিক করে দেওয়া। তাদের এখানে কোনো হাত নেই। তবে খারাপ ব্যবহার সম্পর্কে তারা জানায়, অনেক শিক্ষার্থীদের সাথে তারা মজা করলেও শিক্ষার্থীরা সেটা খারাপ ব্যবহার হিসেবে নেয়। তাছাড়া তারা কারো সাথে খারাপ আচরণ করে না।
অত্যধিক দামের বিষয়ে জানতে চাইলে ক্যান্টিনের পরিচালক অরুণ দে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বাজারে বিভিন্ন জিনিসের দাম বাড়ায় খাবারের দাম বেড়েছে। মিস্টি ঢাকার বাহিরে থেকে আসে তাই দাম বেশি।
কর্মচারীদের খারাপ ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি খারাপ ব্যবহারের বিষয় জানি না। বিষয়টি নিয়ে তাদের সাথে কথা বলবো।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাকসুদুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, আমি খাবারের দাম এবং ব্যবহারের ব্যাপারে অবগত ছিলাম না। তবে তালিকা অনুযায়ী কিছু খাবারের দাম তারা অত্যধিক বেশি রাখছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসারের সাথে কথা বলে শিগগিরই বিষয়টা দেখবো। আর স্টাফদের খারাপ আচরণের অভিযোগটাও আমি মাথায় রাখলাম। যতদ্রুত সম্ভব বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করবো।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সব ঘটনার সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন। মধুর ক্যান্টিনের প্রতিষ্ঠাতা আদিত্য চন্দ্র। তার কনিষ্ঠ পুত্র মধুসূদনের নামে পরিচিতি লাভ করে ক্যান্টিনটি। আদিত্য চন্দ্র অসুস্থ হয়ে পড়লে ক্যান্টিনের দায়িত্ব এসে পড়ে মধুসূদনের ওপর। মধুসূদন দের বয়স তখন মাত্র ১২। ১৯৩৪-৩৫ সাল থেকে বাবার সঙ্গে এখানে ব্যবসা শুরু করেন। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) উদ্যোগে ক্যান্টিনের নাম করা হয় ‘মধুর রেস্তোরাঁ’, যা অনেকের কাছে ‘মধুর স্টল’, ‘মধুর টি-স্টল’ নামেও পরিচিতি পায়।
সততার জন্য মধুসূদন দে ছাত্র-শিক্ষকসহ সবার কাছে এতটাই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেন যে, ক্যান্টিনটি ধীরে ধীরে ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত তৎকালীন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর রোষানলে পড়েন মধুসূদন।
২৬ মার্চের কামানের গোলায় জর্জরিত হয় মধুর ক্যান্টিন। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে সপরিবারে নিহত হন মধুদা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) ভবনের পেছনে শিববাড়ী এলাকায় পাকিস্তানিদের গুলিতে নিজেদের কোয়ার্টারে নিহত হলেও মধুদাকে আহত অবস্থায় জগন্নাথ হলের মাঠে মাটি খুঁড়ে অন্য শহীদদের সঙ্গে জীবিত অবস্থায় মাটিচাপা দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারি মধুর ক্যান্টিন আবার চালু করেন মধুদার সন্তান অরুণ দে। বর্তমানে মধুর ক্যান্টিন পরিচালনা করছেন তিনিই।