চার বছর অপেক্ষার পরও বোর্ড বৃত্তি পাচ্ছেন না মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ফটো

প্রতিবছরের মত বৃত্তির টাকা হাতে পেয়েছেন এইচএসসিতে বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীরা৷ তবে এবারও সেই কাঙ্ক্ষিত বৃত্তির টাকা হাতে পায়নি কৃতিত্বের সাথে আলিম পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে থাকা মেধাবী শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে মাদ্রাসা থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের বৃত্তির টাকা হাতে পাওয়ার  আক্ষেপ যেনো আরও দীর্ঘ হলো।

গতকাল সোমবার ও আজ মঙ্গলবার এইচএসসি/আলিম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় মেয়াদে বৃত্তির টাকা দেয়া হলেও শুধুমাত্র সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পাশ করা শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পেয়েছেন। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে দেয়া প্রথম ধাপের বৃত্তির টাকাও পায়নি আলিম থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা। 

এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত আলিম থেকে উঠে আসা মেধাবী শিক্ষার্থীরা। তাদের মতে, শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ১৩.৭ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হলেও অধিকাংশ ব্যায় যে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধেই ব্যায় হয়ে যায় তারই জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ মাদরাসা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের বোর্ড বৃত্তি প্রদান না করা। 

শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বারবার বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আশ্বাস প্রদান করা হলেও দৃশ্যমান কোন ফল দেখা যায়নি। এমনকি মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতরের উপ মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের উপ পরিচালকসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সাথে সাক্ষাৎ করেও দাবি জানানো হয়েছে। চিঠি ও স্মারকলিপিও দেয়া হয়েছে মাউশি এবং ভিসি বরাবর। তবুও কোনো দৃশ্যমান ফলাফল আসেনি। 

ভুক্তভোগী ঢাবি শিক্ষার্থীরা জানান, তারা করোনার আগ থেকেই এই অবহেলার স্বীকার হয়ে আসছেন। পরবর্তীতে প্রশাসনিক ভবনের নোটিশ অনুযায়ী আবেদন করেও টাকা পাননি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয় অনলাইনে কোন সমস্যার কারণে হয়তো তারা বৃত্তির টাকা পায়নি। পরবর্তীতে প্রশাসনিক ভবন থেকে জানানো হয় মাউশি থেকে মাদরাসা বোর্ড আলাদা হওয়ায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। 

এরপর শিক্ষার্থীরা একাধিকবার মাউশি ও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে গেলে তারা মাদ্রাসা কিংবা মাদরাসা থেকে জেনারেল লাইনে পড়তে এসেছে বলে একে অপরের দিকে আঙুল তুলে। পরবর্তীতে  ২০২২ সালের ২২ নভেম্বর মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে গেলে বোর্ড শিক্ষার্থীদের একটা ডকুমেন্টস দেখিয়ে বলে যারা মাদরাসা বোর্ড থেকে জেনারেল লেভেলে এসেছে তাদের বৃত্তির দায়িত্বে মাউশি রয়েছে। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা সেই ডকুমেন্টস নিয়ে মাউশিতে গেলে তারা তাদের দায়িত্বে রয়েছে স্বীকার করলেও কবে নাগাদ বৃত্তির টাকা দেয়া হবে সেটার কোন আশ্বাস দিতে পারেনি। 

পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন কর্মসূচি করে আবারও মাউশি বরাবর স্মারকলিপি দিলে এবং সরাসরি কথা বললে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পরবর্তী সময়ে জুন মাসে বৃত্তি প্রদানের আশ্বাস প্রদান করে।

এর আগে, গত ২২ মে ঢাবিতে অধ্যয়নরত আলিম শ্রেণীতে বোর্ড বৃত্তিপ্রাপ্ত মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বৃত্তির টাকা আটকে রাখার প্রতিবাদে ও অনতিবিলম্বে অর্থ প্রদানের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন করেন ঢাবি শিক্ষার্থীরা। তারও আগে ২০২২ সালের ৩ আগস্ট ঢাবির সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। উভয় মানববন্ধনে ঢাবিতে অধ্যয়নরত মাদরাসা ও অন্যান্য সাধারণ শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও টনক নড়েনি বোর্ড কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু ২০২০ সালে আলিম পাশ শিক্ষার্থীরাই বৃত্তি পাচ্ছেন না এমন না। কয়েকটা ব্যাচের (২০১৬-১৭, ১৭-১৮, ১৮-১৯, ১৯-২০, ২০-২১, ২১-২২) শিক্ষার্থীদের বোর্ড বৃত্তির টাকা আটকে আছে। টানা তিন বছরের অধিক সময় ধরে তাদের বোর্ডবৃত্তির টাকা আটকে আছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। এবছর এইচএসসি বা আলিম সমমানের বৃত্তিপ্রাপ্তদের জেনারেল গ্রেডে ৫২৫০ টাকা ও টেলেন্টপুলে বৃত্তিপ্রাপ্তদের ১১৭০০ টাকা প্রদান করা হচ্ছে। 

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী মরিয়ম খাতুন ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের বৃত্তির টাকা সেই ২০২০ সাল থেকেই আটকে আছে। আমরা করোনার আগ থেকেই টাকা পাচ্ছি না যদিও আমরা কলেজের শিক্ষার্থীদের মতই বৃত্তি পেয়েছি। পরবর্তীতে ঢাবির প্রশাসনিক ভবনের নোটিস অনুযায়ী অনলাইনে আবেদন করেও লাভ হয়নি। আমরা এ নিয়ে মাউশি থেকে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছি কিন্তু আশানুরূপ ফল পাইনি। এ বছরের শুরুর দিকে আমরা মাউশিকে আবারও বললে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে এবং জুন মাসেই বৃত্তি দিবে বলে আশ্বাস প্রদান করলেও গতকাল কিংবা আজকে আমরা আমাদের টাকা হাতে পাইনি। বোর্ড বৃত্তি নিয়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের নিয়ে অবহেলা ও ছেলেখেলা করা হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি এবং তাদের সহযোগিতায় প্রশাসন ও অন্যান্যদের এগিয়ে আসার আহবান জানান।

ভুক্তভোগী আইন বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী রাফিদ হাসান সাফওয়ান বলেন, কিছুদিন পূর্বে আমরা মাউশির সামনে শাহবাগে আন্দোলন করি। আমাদের আশ্বস্ত করা হয় যে, এ বাজেটে সবার সাথে আমরাও বৃত্তির টাকা পাবো। কিন্তু এবারও কোনো টাকা না পাওয়ায় আমরা হতাশ। অবিলম্বে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের প্রতি এমন বিমাতাসূলভ আচরণের প্রতিকার চাই।

কারমাইকেল কলেজ থেকে বৃত্তিপ্রাপ্ত ঢাবির লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী হেলালুর রহমান বলেন, আলিম/এসএসসি পরীক্ষায় মেধার স্বাক্ষর রেখেই একজন শিক্ষার্থী মেধা বৃত্তির জন্য নির্বাচিত হয়। কিন্তু যখন শুধু কলেজ থেকে বৃত্তিপ্রাপ্ত‌ শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পায় এবং মাদ্রাসা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা নানা জটিলতায় সেই বৃত্তির টাকা পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকে তখন সেটিকে শুধু টেকনিক্যাল সমস্যা বলে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সাথে রীতিমত অন্যায় করা হচ্ছে। একই কাজ যদি জেনারেল বোর্ড করতে পারে তাহলে মাদ্রাসা বোর্ড কেন তা পারবে না? চড়া মূল্যস্ফীতির বাজারে বৃত্তির এই টাকা একজন মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীর জন্য কী পরিমাণ সহায়ক হয় এই পরিস্থিতিতে না থাকলে তা যে কারোর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তাই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সাথে করা এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের অতি দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চের প্রধান জুলিয়াস সিজার তালুকদার বলেন, মাউশির পরিচালক (প্রশাসন) কথা দিয়েছিলেন যে জুনের মধ্যে সকল দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষ হবে এবং শিক্ষার্থীরা টাকা পাবে৷ আশা করি মাউশি কথা রাখবে৷ আর যদি বিলম্বিত হয় তবে আমরা সরাসরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে যাব ও সমস্যাটির সমাধান নিয়েই ফিরব৷

ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, যখন মাউশি থেকে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড আলাদা হয়ে যায় তখন নিজের ভেতরের সমন্বয়হীনতার জন্য এই সমস্যার সৃষ্টি হয়। কিন্তু এটার খারাপ ফল ভোগ করছে মেধাবী শিক্ষার্থীরা। আমি আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য পূর্বে একাধিকবার মাউশি ও বোর্ড সচিবকে এ বিষয়ে অবহিত করেছি। তারা বলেছিলো কাজ সমন্বয় করে বৃত্তি প্রদান করা হবে কিন্তু তবুও কেন দেয়া হলো না সেটা আমি বুঝতে পারছি না। তবে আমি আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের সাথে কথা বলে বোর্ডের সাথে কথা বলে বিষয়টি দ্রুত সমাধানের ব্যাপারে বলবো।


সর্বশেষ সংবাদ