শিক্ষাসফর আর ফলাফল নিয়ে রাবির উর্দু বিভাগে তুঘলকি কাণ্ড
- মারুফ হোসেন মিশন
- প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৩, ০৯:৫৪ PM , আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২৩, ১০:৪৫ PM
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উর্দু বিভাগের ফল বিপর্যয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অফিস, সেমিনার, শ্রেণীকক্ষসহ শিক্ষকদের চেম্বারে তালা দিয়ে সকল একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ, অনশন ও আন্দোলন করে আসছেন বিভাগটির শিক্ষার্থীরা। তবে শুরুতে এ আন্দোলনে উদ্দেশ্য ও গতিপথ এক রকম থাকলেও সময়ের সাথে সাথে পাল্টে গেছে আন্দোলনের গতিপথও। ঘটনার আদ্যোপান্ত জানার পর বিভক্ত হয়েছেন খোদ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাই।
শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের ফলাফল বিপর্যয়ের অভিযোগ করে তা পুনঃমূল্যায়নের দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। তাতে সমর্থন জানান বিভাগটির সভাপতি অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান। তবে, এ ঘটনার মোড় পাল্টাতে থাকে যখন শিক্ষার্থীরা জানতে পারেন বিভাগের সভাপতি ও শিক্ষকদের মাঝে ধন্ধের বিষয়টি, তখন দুভাগে বিভক্ত শিক্ষার্থীরা নতুন করে বিভক্ত হন তিনভাগে; সভাপতিপন্থী আন্দোলনকারী, শুরুতে আন্দোলন করলেও বর্তমানে আন্দোলনে না থাকা এবং কোনো পক্ষেই না থাকা পক্ষ।
আন্দোলনের সূচনালগ্নে শিক্ষার্থীরা বলেছিলেন তাদের এই আন্দোলনের সাথে বিভাগের সভাপতি একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু আজকে তারা এটা অস্বীকার করে জানিয়েছেন বিভাগের সভাপতি বরাবরই এটা অস্বীকার করে এসেছে।তিনি বলেছেন, আমি তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করিনি।
এরপর চলমান আন্দোলনের মধ্যে ঘটনায় নতুন মোড় আসে বৃহস্পতিবার (৯ মার্চ) এ নিয়ে বিবৃতি দেন বিভাগের পাঁচ শিক্ষক; তাতে অভিযোগ করা হয়, সভাপতির অনুগত কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে আন্দোলনের নামে বিভাগে বারবার তালা লাগিয়ে একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত করা, পরীক্ষা কমিটিতে থাকা শিক্ষকদের সাথে অসহযোগিতা ও অসৌজন্যমূলক আচরণ, শিক্ষকদের তোয়াক্কা না করা, বিভাগের ভাবমূর্তি নষ্ট করা, শিক্ষার্থীদের সাথে অশালীন ভাষায় কথা বলা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে থানায় মিথ্যা জিডি করা, অফিসে সময় না দিয়ে চায়ের দোকানে আড্ডা দেওয়া, তিন লক্ষাধিক টাকা নিজ কাজে ব্যয়সহ নানা অনিয়মের।
২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ৩৫ জন নিয়মিত ও তিনজন অনিয়মিত শিক্ষার্থী রয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই প্রথম সেমিস্টারে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। তাদের দ্বিতীয় সেমিস্টারের পরীক্ষা গত ১২ এপ্রিল শুরু হয়ে শেষ হয় ২১ এপ্রিল। পরে দীর্ঘ চারমাস পর গত ২৫ আগস্ট প্রকাশিত হয় ফলাফল। এতে ৩৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩০ জনের প্রকাশিত ফলে ৬ জন নিয়মিত ও দুজন অনিয়মিত শিক্ষার্থীর ফল প্রকাশিত হয়নি এবং ছয়জন শিক্ষার্থী একটি করে কোর্সে ফেল করেন।
মূলত, পরীক্ষার আগে সাত দিনের ট্যুরে যাওয়া শিক্ষার্থীরাই খারাপ করে ফলাফলে; এরপর ওই শিক্ষার্থীদের দিয়েই আন্দোলন গড়ে তোলেন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান-অভিযোগ সভাপতির বিপক্ষে থাকা শিক্ষকদের। তাদের অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের ফলাফল খারাপ হওয়া কোর্স যেসব শিক্ষকদের অধীনে করা হয়; তাদের সাথে এ আন্দোলনে কাজ করেছে বিভাগের সভাপতির পূর্ববিরোধও।
বাকি শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুধুমাত্র তিনজন শিক্ষার্থী সিজিপিএ-৩ এর উপরে আর সবাই সিজিপিএ-৩ এর নিচে পেয়েছেন। এছাড়া প্রথম সেমিস্টারের সিজিপিএ-৩.৯১ পেয়ে প্রথম হওয়া শিক্ষার্থী নিশাত তাসনিম দ্বিতীয় সেমিস্টারে পেয়েছেন সিজিপিএ-৩.২৮, প্রথম সেমিস্টারে সিজিপিএ-৩.৮৩ পেয়ে দ্বিতীয় হওয়া শিক্ষার্থী ফৌজিয়া তুরানী দ্বিতীয় সেমিস্টারে পেয়েছেন সিজিপিএ-২.৭৩ এবং প্রথম সেমিস্টারে সিজিপিএ-৩.৭৫ পেয়ে তৃতীয় হওয়া শিক্ষার্থী মো. আলম দ্বিতীয় সেমিস্টারে পেয়েছেন ২.৬২।
আরও পড়ুন: আন্দোলনে উস্কানি, আর্থিক অনিয়মসহ নানা অভিযোগ সভাপতির বিরুদ্ধে
আন্দোলন থেকে সরে আসা উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, পরীক্ষার আগে প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ৭ দিনের শিক্ষা সফরে যায়। শিক্ষাবর্ষের ২য় সেমিস্টারে ৩টি কোর্সের মধ্যে ২টি (ইংরেজি ও উর্দু) কঠিন থাকায় শিক্ষার্থীরা ভালো পরীক্ষা দিতে পারেনি। আর অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর অধিকাংশই শিক্ষা সফরে গিয়েছিলো। আশানুরূপ ফল না পেয়ে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যেও বিরোধ চলমান।
আর এ কারণেই অন্য শিক্ষকগণ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে সমাধানের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কোনো স্যার ইনকোর্স নেওয়ার নোটিশ দিলে চেয়ারম্যান স্যার তা বন্ধের নোটিশ দিচ্ছে। এখন আমরা হয়েছি বলির পাঠা। ফল প্রকাশের ৬ মাস পেরোলেও এখনো ভর্তি হতে পারিনি। এমনিতেও করোনার কারণে আমরা পিছিয়ে আছি। এসব বিবেচনা করে আমরা অধিকাংশ শিক্ষার্থী আন্দোলন থেকে ফিরে এসেছি।
বিভাগের একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, আন্দোলনকে ঘিরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, শিক্ষকদের সাথে অশোভন আচরণ, প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা ব্যক্তিদের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, বিভাগে পাল্টাপাল্টি নোটিশ প্রদান, সহপাঠীর দ্বারা হুমকি, শিক্ষকদের মধ্যে মতপার্থক্যসহ শিক্ষক দ্বারা শিক্ষার্থীর নামে জিডি করার মত চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে বিভাগের শিক্ষকদের মাঝেও দুটি গ্রুপের পাল্টাপাল্টি অবস্থান এখন দৃশ্যমান। বাহ্যিক-ভাবে ফলাফল নিয়ে আন্দোলনের কথা বলা হলেও এর পেছনে রয়েছে অন্য কিছু। যার ফলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বড় অংশ আন্দোলন ছেড়ে শ্রেণীকক্ষে মনোযোগ দিয়েছে। ফলে আবারও নতুন করে সামনে এসেছে শিক্ষকদের সাথে বিভাগের সভাপতির ধন্ধের বিষয়টি।
বৃহস্পতিবার (৯ মার্চ) দুপুর ১টার দিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিভাগে তালা দিয়ে ৪ জন শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান করে আছেন। এসময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী বায়েজীদ হোসাইন বলেন, আমাদের দ্বিতীয় সেমিস্টারের প্রকাশিত ফলাফল পুরোটাই অসঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে। যদিও পরীক্ষা কমিটি ফলাফল পুনঃমূল্যায়ন করে বলেছে যে অস্বচ্ছতা নাই। তবুও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল তার প্রতিবেদন আমরা চাই। তারাও যদি একই কথা বলে তাহলে আমাদেরকে খাতা দেখার সুযোগ করে দিতে হবে। অস্বচ্ছতা না পেলে আমরা মেনে নিবো। তবে অস্বচ্ছতা পেলে সংশ্লিষ্ট কোর্স শিক্ষকদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আমরা দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা কোনো সমাধান পাইনি। আমাদের বিষয় সমাধান না করেই ভর্তির নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আমাদের দাবি না মানলে এই আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার বিকেলে বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের সেমিস্টার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৩০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৬ জন ২য় বর্ষে ভর্তি এবং সেমিস্টার পরীক্ষা গ্রহণের জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করে বলেন, বিভাগে তালা লাগানোর সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা আর একটি দিনও নষ্ট করতে চাই না। এমনিতেই আমরা ২ বছর পিছিয়ে আছি। এসময় বিভাগের অফিস ও ক্লাস রুম খুলে দেওয়াসহ ৭ দফা দাবি জানিয়ে প্রশাসন বরাবর স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন তারা।
তবে বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান বলছেন, গত ৬ মার্চে ভর্তির নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এর পর থেকেই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা একাডেমিক ভবনে তালা দিয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। তাদেরকে আমরা বুঝানোর চেষ্টা করেও আন্দোলন থেকে সরাতে পারছিনা। তবে তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একাডেমিক পরীক্ষা কমিটিকে ফল পুন:বিবেচনার অনুরোধ করেছিলাম। পরীক্ষা কমিটি তাদের ফল বিবেচনা করে কোনো অস্বচ্ছতা পায়নি বলে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রশাসন থেকেও ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে কিন্তু প্রতিবেদন এখনো জমা দেয়নি।
তিনি পরীক্ষার পূর্বমুহূর্তে শিক্ষার্থীদের ৭দিনের জন্য শিক্ষা সফরে নিয়ে যাওয়া, শিক্ষকদের মধ্যে মতপার্থক্যসহ শিক্ষক দিয়ে শিক্ষার্থীর নামে জিডির বিষয়ে জানতে চাইলে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, আন্দোলনের কারণে কোনো বিভাগ বন্ধ হয়ে থাকাটা প্রত্যাশিত নয়। প্রতিটি বিভাগে একজন সভাপতি ও পরীক্ষা কমিটি রয়েছে। কোনো ক্রটি থাকলে তা শিক্ষকদের সাথে নিয়ে এর সমাধার করার দায়িত্ব বিভাগের। তা নাহলে তাদের দায়িত্বের অপারগতা প্রকাশ পাবে। তাদের নির্দিষ্ট দায়িত্বে ব্যর্থ হলে তাদেরও জবাব দিতে হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তাদের প্রতিবেদন দ্রুতই জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।