সকালের নাশতা শরীরের জন্য কেন জরুরি, জেনে নিন

সকালের নাশতা হতে পারে জীবন-রক্ষাকারী
সকালের নাশতা হতে পারে জীবন-রক্ষাকারী  © সংগৃহীত

অনেকে ডায়েট করতে গিয়ে সকালের নাশতা পুরোপুরি বাদ দেন। অথচ এই প্রবণতা শরীরে বাধাতে পারে নানা রোগ। ডেকে আনতে পারে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। সকালে ভরপেট খেয়ে কাজে বের হওয়া ছিল বাংলাদেশের সংস্কৃতি। কিন্তু এখন যেন সেই সংস্কৃতি পরিবর্তন হওয়া শুরু করেছে। কেউ কেউ তাড়াহুড়া করে আবার অনেকে ঘুম থেকে দেরী করে ওঠার কারণে নাশতা এড়িয়ে চলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, সকালের নাশতা হতে পারে জীবন-রক্ষাকারী। তাই নাশতা করাটা খুবই জরুরি।

এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানা যায়, যে সমস্ত মানুষ সকালের নাস্তা বাদ দেন তাদের মধ্যে ২৭ শতাংশের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন! নাশতা আমাদের শরীরের ফ্যাট বার্নিং এনার্জি বাড়ায়, রক্তে শর্করার মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে হার্ট সুস্থ থাকে।

সকালের নাশতা না খেলে মনমানসিকতায় নেগেটিভ প্রভাব পড়ে। দেহের শক্তির যথেষ্ট ঘাটতি হয়। ফলে মেজাজ হয়ে যায় খিটখিটে, ঘিরে ধরে অবসাদ। সকালের নাশতা বাদ দিলে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা যায়। ক্যালসিয়াম আমাদের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

সকালে নাশতা করাটা কেন জরুরি তা জানানো হয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে।

১. সকালের নাশতা শরীরকে দিনটি শুরু করার শক্তি দেয়।

২. সকালের নাশতা শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।

৩. রক্তে গ্লুকোজের ভারসাম্যহীনতা নিয়ন্ত্রণ করে সকালের নাশতা।

৪. সকালে ভালোভাবে নাশতা করলে দীর্ঘ সময় পেট ভরা অনুভূত হয়। এর ফলে বাইরের খাবার খাওয়ার আগ্রহ কমে।

৫. রাতের খাবার খাওয়ার পর অন্তত ৮- ১০ ঘণ্টা পর সকালের নাশতা করা হয়। এতটা সময় উপবাস থাকার পর খাবার খেলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ে।

৬. সকালের নাশতা শরীরে পুষ্টিস্তর ঠিক রেখে বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমায়।

হার্ট অ্যাটাক এড়াতে সকালের নাস্তার বিকল্প নেই

৭. সকালের নাশতা রোগ প্রতিরোগ ক্ষমতা বাড়ায়। এ কারণে সকালের নাশতায় সব সময় স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

৮. সকালের স্বাস্থ্যকর নাশতা করলে ভালো খ্যাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে। এতে যখন তখন খাওয়ার ইচ্ছে কমে যায়।

৯. স্বাস্থ্যকর সকালের নাশতা টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়, বিপাকক্রিয়া বাড়ায়।

১০. সকালের নাশতায় ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার রাখলে অন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত হয়।

অ্যামেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি থেকে গত ২০১৯ সালের ২২শে এপ্রিল প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সকালের নাশতা হতে পারে জীবন-রক্ষাকারী, প্রাতরাশ বাদ দিলে তার ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে।

চিকিৎসক এবং বেশ কয়েকটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এই গবেষণা ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখেছেন। ছয় হাজার পাঁচশো পঞ্চাশ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি, যাদের বয়স ৫০ থেকে ৭৫ বছর এবং তারা ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ক জাতীয় জরিপে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের কাছ থেকে নেয়া নমুনা বিশ্লেষণ করেন এই চিকিৎসক ও গবেষক দল।

সকালের নাস্তা বাদ দেয়ার ফলে হতে পারে মাইগ্রেন। সেইসঙ্গে আপনার শরীরে পানির ঘাটতি ঘটতে পারে। সকালের নাস্তা বাদ দেয়ার নেগেটিভ প্রভাব পড়বে আপনার মুডে। আপনি খিটখিটে হয়ে উঠবেন। আপনার এনার্জিতে ঘাটতি হবে। অবসাদ ঘিরে ধরবে। কমে আসবে স্মৃতিশক্তি।

সকালের নাস্তায় কয়েকটি স্বাস্থ্যকর খাবার

১. ওটস
ওটস জিনিসটা খেতে ভালো না লাগলেও এটি আমাদের দেহের জন্য অনেক ভালো একটি খাবার। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। ওজন কমাতে এবং কলেস্টোরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওটসের জুড়ি নেই। সকালে হাবিজাবি খাবার বাদ দিয়ে একবাটি ওটস রাখুন। তবে কোন ফ্লেভারড বা চিনিযুক্ত ওটমিল খাবেন না। চিনির পরিবর্তে মধু এবং সাথে কিছু ফলমূল যোগ করে নিতে পারেন। ওটস খিচুড়িও নাস্তা হিসেবে চমৎকার।

২. ডিমটোস্টের ওপর ডিম
ডিমকে বলা হয় ‘সুপারফুড’। ডিমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এবং মিনারেলস। প্রোটিনের সব চাইতে ভালো উৎস হচ্ছে ডিম। এতে ক্যালোরিও থাকে বেশ কম। সকালের নাস্তায় অবশ্যই প্রত্যেকের ডিম খাওয়া উচিৎ। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসেবে সকালে ২ টি ডিম খেলেই যথেষ্ট। তবে যারা একটু বেশি স্বাস্থ্যবান তাদের ডিমের কুসুম এড়িয়ে যাওয়া উচিৎ। সকালে ডিম সেদ্ধ বা ডিমের অমলেট দিয়ে নাস্তা সারতে পারেন।

৩. ফল
সকালের নাস্তার জন্য সব চাইতে ভালো খাবার হচ্ছে ফলমূল। কলা, আপেল, কমলা, আঙুর ইত্যাদি ধরণের ফলমূল অথবা মৌসুমি ফলমূল দিয়ে সকালের নাস্তা করা সব চাইতে ভালো। ২টি কলা, ১টি আপেল, ১টি কমলা, ২/৩টি স্ট্রবেরি এভাবে শুধুমাত্র ফল দিয়ে নাস্তা করা সকালের জন্য ভালো। চাইলে ফলমূল দিয়ে সালাদের মত তৈরি করেও খেতে পারেন।

৪.গ্রিন টি
গ্রিন টি এর মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমানে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি , বি৫, ডি, ই, সি, ই, এইচ সেলেনিয়াম, ক্রোমিয়াম, জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ ও সামান্য ক্যাফেইন। গ্রিন টির উপকারিতা অনেক। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্রণে সাহায্য করে, ওজন কমাতে সাহায্য করে, ক্যান্সার প্রতিরোধ করে ও মস্তিস্ককে উদ্দীপ্ত করে। এছাড়া ত্বকের সৌন্দর্য রক্ষার্থে গ্রিন টির জুড়ি মেলা ভার। গ্রিন টি বার্ধক্য এবং কপালের বলিরেখা থেকে রক্ষা করে ত্বককে উজ্জ্বল ও সতেজ রাখে। তবে খাবার খাওয়ার ১ ঘন্টা আগে অথবা খাবার খাওয়ার ১ ঘন্টা পর গ্রিন টি পান করা উচিত। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রিন টি পান করা উচিত নয়। এবং সকালে খালি পেটে গ্রিন টি পান করা উচিত নয়।

৫. আটার রুটি
সকালের নাস্তার জন্য বেশ ভালো একটি খাবার হচ্ছে আটার রুটি। বিশেষ করে যারা ভারী খাবার পছন্দ করেন। সকালে পাউরুটি বা ভাত খাবার চাইতে আটার রুটি সবজি ভাজি বা ডিম অথবা ঝোলের তরকারি কিংবা কলা দিয়ে খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ভালো। এছাড়া রুটি বেশ ভালো এনার্জি সরবরাহ করে আমাদের দেহে যা পুরো দিনই রাখবে সতেজ। তবে অবশ্যই তেলে ভাজা পরটা থেকে দূরে থাকবেন।

৬. খিচুড়ি
অনেকেরই সকালে ভাত খাওয়ার অভ্যাস। তারা ভাতের বদলে সকালের নাস্তায় রাখতে পারেন খিচুড়ি। তবে অবশ্যই সবজি খিচুড়ি। চালের পরিমাণ কমিয়ে বেশি পরিমাণে সবজি দিয়ে রান্না করা সবজি খিচুড়ি দিয়ে সেরে নিতে পারেন সকালের নাস্তা। এতে করে ভারী নাস্তা করা হলেও দেহে পৌঁছাবে পর্যাপ্ত পুষ্টি।

৭.কাঠবাদামhealthy breakfast
ভিটামিন ও খনিজে ভরা কাঠবাদাম। এটি পানিতে ভেজালে পুষ্টিগুণ অনেক বেড়ে যায়। হজমশক্তি বাড়ায় ও ওজন কমাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকার পর সকালে ৫-১০টি কাঠবাদাম খেলে পুষ্টি জোগানোর পাশাপাশি সারাদিন রুচিও বাড়ায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, কাঠবাদামের বাদামি আবরণে ট্যানিন নামের উপাদান থাকে, যা পুষ্টি শোষণ করে। ভেজানো হলে খোসা খুলে যায় এবং সহজে পুষ্টি বের হয়। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণসহ ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল (লো ডেন্সিটি লিপোপ্রোটিন) নিয়ন্ত্রণ করে আমন্ড। এবং এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস শরীরের ফোলাভাব কমায় ও অকালপক্কতা নিয়ন্ত্রণ করে।

৮. দই
দিনের শুরুটা দই দিয়ে শুরু হোক অনেকেই তা চান না। কিন্তু দই দেহের জন্য অনেক বেশি কার্যকরী একটি খাবার। এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম যা হাড়ের গঠনে কাজ করে। দিনের শুরু দই দিয়ে করলে পুরো দিন আপনার দেহে থাকবে অফুরন্ত এনার্জি। ক্লান্তি স্পর্শ করবে না দিনের শেষেও। সুতরাং সকালের নাস্তায় কিছু ফলমূলের পাশাপাশি রাখুন দই।

৯. সালাদ
সালাদ মানেই যে শসা, টমেটো এবং গাজরের হতে হবে এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য এই সকল সবজির সাথে সালাদে ব্যবহার করতে পারেন সেদ্ধ ডিম বা সেদ্ধ মাংস অথবা সেদ্ধ ছোলাবুট। এছাড়া খেতে পারেন ফলমূলের সালাদ। এইসব ধরণের সালাদ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো এবং দিনের শুরুটা চমৎকার করতে বেশ কার্যকরী।

সকালের নাশতা ওজন হ্রাস করে। কারণ একবারে দুপুরের খাবার খেলে অনেক বেশি খাওয়া হয়ে যায়। সকালের নাশতা না করে অনেকে আবার মাঝখানে ফাস্টফুড, বিভিন্ন প্যাকেটজাত খাবার খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেন, যা ওজন বাড়ায় ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।


সর্বশেষ সংবাদ