সেই ‘১০০১ শিক্ষকের বিবৃতি’র নেপথ্যে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী শিক্ষক নাকি অন্য কেউ?
২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত ১৭ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়েছেন। এই রায় ঘোষণার পর তা প্রত্যাখ্যান করে সেদিনই বিকেলে একটি বিবৃতি দেন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি ‘১০০১ জন’ শিক্ষক, যারা নীল দলের শিক্ষক হিসেবে গণ্য। ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষকবৃন্দ’ ব্যানারে পাঠানো এই বিবৃতি মূলত কে বা কারা প্রস্তুত করেছে, কে পাঠিয়েছে, কোন পদ্ধতিতে এতজন শিক্ষকের নাম যুক্ত করা হয়েছে, এক্ষেত্রে তাদের অনুমতি বা সম্মতি নেওয়া হয়েছে নাকি নেওয়া হয়নি, এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা ও সমালোচনা চলছে।
এরই মধ্যে, এ বিবৃতিতে নাম থাকা শিক্ষকদেরকে আদালতের রায় এবং জুলাই বিপ্লব অবমাননাকারী আখ্যা দিয়ে তাদেরকে অতি দ্রুত চিহ্নিত করে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে চাকরি থেকে অব্যাহতির দাবি জানিয়েছে ডাকসু, জাকসু, রাকসু, চাকসু। গত ১৮ নভেম্বর দেওয়া এক বিবৃতিতে তারা দাবি করে, এই শিক্ষকরা মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত খুনির পক্ষে অবস্থান নিয়ে মানবতাবিরোধী কাজই করেছেন।
অন্যদিকে, বিবৃতিতে নাম থাকা অনেক শিক্ষকই দাবি করেছেন, তাদের নাম তাদের সঙ্গে কথা না বলে এবং অনুমতি না নিয়েই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে, তারা তাদের ব্যক্তিগত এবং কর্মজীবন নিয়ে খানেকটা শঙ্কাবোধ করছেন। কারণ, ওই বিবৃতিতে নাম থাকা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি ওঠেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলোও এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছেন ভুক্তভোগী শিক্ষকরা। আবার অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দিচ্ছেন স্ট্যাটাসও।
“বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী ড. মাহবুব আলম প্রদীপ শুধু একটা সিম্বলিক ক্যারেক্টার (প্রতীকী চরিত্র)। তিনি তো অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। বিবৃতিতে একজন বার্তা প্রেরকের নাম দিতে হয়, সেই হিসেবে তার নামটা দেওয়া”- শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম প্রদীপ স্বাক্ষরিত এই বিবৃতিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০১ জন স্বাক্ষর করেছেন বলে উল্লেখ করা হলেও ৬৩০ জন শিক্ষকের নাম যুক্ত করা হয়েছে। যদিও বিবৃতিতে কোনো স্বাক্ষর ছিল না। এর আগেও ড. মাহবুব আলম প্রদীপের স্বাক্ষরে কয়েকটি বিবৃতি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
আরও পড়ুন: চার প্লাটফর্মে সক্রিয় আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের নীল দলের কার্যক্রম
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নীল দলের একজন শিক্ষক নেতা পরিচয় না প্রকাশের শর্তে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষকবৃন্দ’ ব্যানারে পাঠানো বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী হিসেবে রাবির সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম প্রদীপের নাম থাকলেও এটি প্রস্তুতের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বা নেতৃত্বে ছিলেন- ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা ও তার স্বামী আইআররের অধ্যাপক ড. এম ওয়াহিদুজ্জামান ওরফে চাঁন এবং সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আ. ক. ম. জামাল উদ্দিনসহ কয়েকজন নীলদলের শিক্ষক। তারাই নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করাসহ অনেক অনিচ্ছুক ও অজ্ঞাত অনেক শিক্ষকের নাম তাদের সঙ্গে কথা না বলেই ভিত্তিহীনভাবে বিবৃতিতে নাম উল্লেখ করেছে। এতে বার্তা প্রেরক ড. মাহবুব আলমের নামটি প্রতীকী বা ডামী।
তার দাবি, এ প্রশ্নবিদ্ধ বিবৃতি প্রস্তুতে নেতৃত্বদানকারীদের অন্যতম অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা। এ সংক্রান্ত কিছু প্রমাণ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে এসেছে। বিশেষ করে, ‘প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক প্লাটফর্মের এক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দেওয়া মেসেজের স্ক্রিনশট বিশ্লেষণ করে বিবৃতি প্রস্তুতের সঙ্গে অধ্যাপক জিনাত হুদার সম্পৃক্ততা মিলেছে।
স্ক্রিনশটটিতে দেখা যায়, ১৭ নভেম্বর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর বেলা ১ টা ১৪ মিনিটে ঢাবির ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. রায়হান সরকার ওরফে রিজভী ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরোধিতা করে একটি মেসেজ দেন। পুরো মেসেজে সরকার ও ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে বিষদগার করে মেসেজের শেষে তিনি লেখেন, ‘সেন্ড ইউর কনসেন্ট টু প্রফেসর জিনাত ম্যাডাম’।
নীল দল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই মেসেজের মাধ্যমে ড. রায়হান গ্রুপের অন্যান্য শিক্ষককে শেখ হাসিনার পক্ষে দেওয়া বিবৃতিতে ড. জিনাত হুদার কাছে সম্মতি জানানোর আহ্বান জানান। এতে বুঝার বাকী থাকে না যে, বিবৃতি প্রস্তুতে কে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সেই মেসেজটিতে ড. রায়হান লেখেন, বাংলাদেশের সফল প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও প্রহসনমূলক মামলার সাজানো রায় প্রত্যাখ্যান করেছে ‘বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষকবৃন্দ’। …… আমরা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষকসমাজ বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের সাথে সংহতি প্রকাশ করছি এবং ক্যাঙারু কোর্টের প্রহসনমূলক রায়কে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। Send your consent to Prof Zenat madam (0155…38357).’
তার এ বার্তার জবাবে বোটানী বিভাগের শিক্ষক ও নীল দলের বিদ্রোহী কমিটির কো-কনভেনার ড. আজমল হোসাইন ভূঁইয়া লেখেন, ‘Great initiative indeed!’
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে?
এ ব্যাপারে ‘প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক প্লাটফর্মের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে থাকা এক শিক্ষক বলেন, অধ্যাপক জিনাত হুদা নিজে সরাসরি না বলতে পেরে ড. রায়হানকে দিয়ে গ্রুপে বলিয়েছেন বলেই আমার ধারণা। কারণ, এই গ্রুপে থাকা শিক্ষকরা তাকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না। যার কারণে, তিনি অধ্যাপক জামালদেরকে সাথে রেখে মুভ করেন।
বিবৃতি প্রস্তুতের সঙ্গে জড়িতদের ব্যাপারে তথ্য জানিয়ে ঢাবি নীল দলের আরেক শিক্ষক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী ড. মাহবুব আলম প্রদীপ শুধু একটা সিম্বলিক ক্যারেক্টার (প্রতীকী চরিত্র)। তিনি তো অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। বিবৃতিতে একজন বার্তা প্রেরকের নাম দিতে হয়, সেই হিসেবে তার নামটা দেওয়া। উনি যেহেতু দেশের বাইরে আছেন, সেহেতু নিজেদের ওপর থেকে দায় সরানোর জন্য তাকে যুক্ত করা। এটা নিয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নীল দলের অনেক শিক্ষক বিরক্ত যে, সারা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, তিনি আবার অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, প্রফেসরও নন। মূলত বিবৃতি প্রস্তুতের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা ও তার স্বামী অধ্যাপক ড. এম ওয়াহিদুজ্জামান ওরফে চাঁন এবং অধ্যাপক জামাল উদ্দিনসহ কয়েকজন নীলদলের শিক্ষক।
তিনি আরও বলেন, ১৭ তারিখের ওই বিবৃতিতে কিছু নামের পুনরাবৃত্তি করে নামের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। ওখানে কারো পরিচয় ঠিকঠাক প্রকাশ করা হয়নি। অনেক শিক্ষক আছেন যাদের অনুমতিই নেওয়া হয়নি। বিবৃতির ব্যাপারে অফলাইন বা অনলাইনে কোনো মিটিংও হয়নি। উল্লেখিত নামগুলোর কোনো কোনো নামে বিভিন্ন এসোসিয়েট প্রফেসরকে প্রফেসর হিসেবে দেখানো হয়েছে।
আক্ষেপ প্রকাশ করে এই শিক্ষক আরও বলেন, নীল দল তো কোনো লেজুরবৃত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনের মতো প্লাটফর্ম নয়, এটি বুদ্ধিবৃত্তিক একটা পেশাজীবী প্লাটফর্ম। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় হয়েছে, এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগসহ এর অঙ্গসংগঠনগুলোর আগেই আমাদের এত অতি উৎসাহী হয়ে বিতর্কিত বিবৃতি দিয়ে কেন নিজেদের এতজন শিক্ষককে বিপদে ফেলতে হবে?
আরও পড়ুন: হাসিনার পক্ষে ১০০১ শিক্ষকের বিবৃতি, যা বললেন ঢাবি উপাচার্য
অনুমতি ব্যতিরেকে নাম উল্লেখের বিষয়ে বিবৃতি দিয়ে, গণমাধ্যমে কথা বলে এবং সামাজিক মাধমে পোস্ট করে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করেছেন অনেক শিক্ষক। তাদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনওয়ারুল ইসলাম ও প্রভাষক গোলাম কুদ্দুস লাভলু অন্যতম। তারা গত ১৭ নভেম্বর এক যৌথ বিবৃতিতে লেখেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় সংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নাম সংবলিত বিবৃতিতে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের জানামতে, আমরা এ ধরনের কোনো বিবৃতিতে স্বাক্ষর বা কারো সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করিনি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা, অধ্যাপক ড. এম. ওয়াহিদুজ্জামান চাঁন, অধ্যাপক ড. আ. ক. ম. জামাল উদ্দিন এবং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বার্তা প্রদানকারী শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. রায়হান সরকার ওরফে রিজভীকে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।