ভর্তি পরীক্ষার্থী সুমনের লাশ তিন দিন পড়ে ছিল ঢামেক মর্গে

সুমন ইসলাম
সুমন ইসলাম  © সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঘাতকের বুলেটের আঘাতে শহিদ শিক্ষার্থী সুমন ইসলামের (২০) লাশ মৃত্যুর তিন দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে খুঁজে পান তার পরিবারের সদস্যরা।

গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের দিন বিকেলে সুমন ইসলামের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেলেও আহত সুমনকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে সুমন ইসলামের পরিবার। সাভারের বিভিন্ন স্থানে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন তারা। হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন এ হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল। 

কোথাও খুঁজে না পেয়ে বিভিন্ন জনের দ্বারস্থ হন সুমন ইসলামের পরিবার। পরে চাচাতো ভাই সোহাগের পরামর্শে ৭ আগস্ট বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে মর্গে শহিদ সুমনের মৃতদেহ দেখতে পান।

শহিদ সুমন ইসলামের বাবা হামিদ ইসলাম (৬০) এবং মা কাজলী বেগম (৫০)। গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা থানাধীন বকশিগঞ্জ আলমনগর গ্রামে। দাদার নাম মৃত খালেক মন্ডল এবং দাদি মৃত জয়তুন্নেছা। নানির নাম আয়শা খাতুন (৭৫) এবং নানা মৃত মসলিম উদ্দিন।

কল্পনা, হাজেরা, মলিদা ও মনিরা- এই ৪ বোনের একমাত্র ভাই সুমন ইসলাম ছিল পরিবারের সবার আদরের। সুমন ইসলাম পড়াশোনায়ও ছিল অত্যন্ত ভালো। উচ্চশিক্ষা লাভের আশায় এইচএসসি পাসের পর সম্প্রতি সাভারে আশুলিয়ার বাইপাইল পলাশবাড়ী এলাকায় দুলাভাই আতারুল ইসলামের ভাড়া বাড়িতেই থাকতেন। 

শহিদ সুমন ইসলামের বাবা বৃদ্ধ হামিদ ইসলাম  জানান, আমার ছেলেটা অনেক সাংসারিক ছিল। সবসময় পরিবারের কথা চিন্তা করত। পড়াশোনার পাশাপাাশি পোশাক কারখানায় কাজ করত। অনেক স্বপ্ন ছিল ওর। আমাদের বাড়ি পাকা করে দেবে। ওর মায়ের চিকিৎসা করাবে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে আমাদেরও অনেক স্বপ্ন ছিল। বুড়ো বয়সে আমাদের দেখভালের দায়িত্ব নেবে। ওর মৃত্যুতে আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছি। ভাষা হারিয়ে ফেলেছি কথা বলার। সরকারের কাছে বুড়ো বয়সে তাদের স্বামী-স্ত্রীর ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার পাশাপাশি ছেলে হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।

শহিদ সুমন ইসলামের মা কাজলী বেগম বলেন, আমার ছেলের মতন ছেলে হয় না। সব কিছুর প্রতি ওর খেয়াল ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি ইপিজেডে কাজ করে আমাদের খরচ দিতো। পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকুরি করে বাড়ি ঠিক করার কথা ছিল সুমনের।

আমার কোমরের হাড় ক্ষয় হয়ে গেছে। এর চিকিৎসার কথাও বলেছিল সুমন। কিন্তু ওর মৃত্যুতে আমাদের সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। একমাত্র বুকের ধন ছেলেকে হারিয়ে আমরা পাগলপ্রায়। নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের ছেলেকে ওরা মেরে ফেলেছে। আমি এর বিচার চাই।

শহিদ সুমন ইসলামের বোন মনিরা বলেন, আমার ভাইয়ের মতো ভাই লাখে একটা। আমাদের ৪ বোনের একমাত্র ভাই ছিল সুমন। সবাই ওকে অনেক আদর করতাম। গত বছর আমাদের বড় বোন কল্পনা মারা গেছে।

মা-বাবার একমাত্র ছেলে ছিল সুমন। ওকে ঘিরেই তাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। ভেবেছিলাম পড়াশোনা শেষ করে বাবা-মায়ের দায়িত্ব নেবে। সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। ঘাতকরা আমার ভাইটিকে বাঁচতে দিলো না। গুলি করে হত্যা করে ওকে।

শহিদ সুমন ইসলামের দুলাভাই আতারুল ইসলাম জানান, অত্যন্ত মেধাবী সুমন ইসলাম ছিল আমাদের সবার আদরের। এইচএসসি পাশ করে অনার্সে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল সুমন। আমার আশুলিয়ার বাড়িতেই থাকতো ও।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল সুমন। বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেয় সে। গত ৪ আগস্ট রাবার বুলেট খেয়ে বাসায় চলে আসে। পরদিন ৫ আগস্ট ফের সুমন বাসা থেকে বের হয় আন্দোলনে যাওয়ার জন্য। বিকেলে দিকে আমরা খবর পাই সুমন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

এরপর থেকেই পরিবারের আমরা সবাই বিভিন্নস্থানে সুমনকে খুঁজতে থাকি। কোথাও কোন হদিস পাই না সুমনের। এমন অবস্থায় আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি। আশুলিয়া ও সাভারের প্রায় প্রতিটি হাসপাতাল তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াই সুমনকে।

কোথাও ওকে খুঁজে না পেয়ে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি। ৭ আগস্ট দুপুরের পরে সুমনের চাচাতো ভাই সোহাগ আমাদের খবর দেয় আজ সাভার থেকে ৩ জনের মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে এসেছে। তোমরা খোঁজ নাও।

আমাদের পক্ষ থেকে যাওয়া সম্ভব না হওয়ায় সোহাগই প্রথম সুমন ইসলামের মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে শনাক্ত করে। পরে আমাদের খবর দিলে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সুমনের লাশ নিয়ে আসি। ৮ আগস্ট গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা থানাধীন বকশিগঞ্জ আমিননগর গ্রামে শহিদ সুমন ইসলামের লাশ দাফন করা হয়।

বিএনপি থেকে ২ লাখ এবং জামায়াত ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে সুমন ইসলামের পরিবারকে। শহিদ সুমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে আশুলিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।

সূত্র: বাসস


সর্বশেষ সংবাদ