সংবিধান বাতিলের দাবি থেকে কি সরে এসেছেন ছাত্রনেতারা?

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি  © লোগো

বাংলাদেশের সংবিধান বাতিল হবে নাকি সংস্কার হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আছে নানাধর্মী আলোচনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বর্তমান সংবিধানকে বাহাত্তরের সংবিধান ও ‘মুজিববাদী সংবিধান’ আখ্যায়িত করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। এজন্য তারা জুলাই বিপ্লবের ঘোষাণাপত্র দিতে চেয়েছিলেন। তবে শেষপর্যন্ত তা হয়নি। সর্বশেষ জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দেবে অর্ন্তবর্তী সরকার। এ অবস্থায় অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে, সংবিধান বাতিলের দাবি থেকে কি সরে এসেছেন ছাত্রনেতারা?

জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব ও  ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সংবিধান বাতিলের দাবি থেকে আমরা সরে আসিনি। সেটা আমি পরিষ্কার করেছি। আমাদের দাবি এই সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। সেই সংবিধান প্রণয়ন করার ম্যান্ডেট থাকবে গণপরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। গণপরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংবিধান প্রণয়নের পাশাপাশি আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এখন বিএনপি চায় শুধু আইনসভা নির্বাচন। আমরা চাই গণপরিষদ-আইনসভার যৌথ নির্বাচন।

ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর সংবিধান বাতিলের দাবি করে আসছে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। জানা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপ্লবী সরকার হিসেবে রূপান্তরিত করতে সংবিধান বাতিল অন্যতম এজেন্ডা ছিল এই প্লাটফর্মের নেতাদের। কিন্তু রাজনৈতিক ঐক্য না থাকায় সে দাবি স্তিমিত হয়ে পড়েছে।

গত ২২ অক্টোবর সংবিধান বাতিল, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণ এবং ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধসহ পাঁচ দফা দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত সমাবেশে তারা গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা এবং জুলাই বিপ্লবের আলোকে ‘প্রজাতন্ত্রের ঘোষণা’ করার দাবি জানান। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহবায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ তখন বলেছিলেন, বর্তমান সংবিধানের অবসান ঘটিয়ে জুলাই বিপ্লবের চেতনার আলোকে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। তাছাড়াও, গত ৩১ ডিসেম্বর জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বর্তমান সংবিধানকে অকার্যকর ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন ছাত্রনেতারা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নিজ কার্যালয়ে ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছিলেন, আমরা চাই, মুজিববাদী সংবিধানকে কবরস্থ ঘোষণা করা হবে৷ যেখান থেকে এক দফার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, ঠিক সেই জায়গা থেকে মুজিববাদী বাহাত্তরের সংবিধানের কবর রচিত হবে৷

পরবর্তীতে ৩১ ডিসেম্বর জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠের পরিবর্তে একই স্থানে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ সমাবেশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই প্রোগ্রামে সহযোগিতা করে জাতীয় নাগরিক কমিটি।

অনুষ্ঠানে আখতার হোসেন ঘোষণা দেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই নতুন সংবিধান হবে। আগামী নির্বাচন হবে গণপরিষদ নির্বাচন। সে নির্বাচনে নির্বাচিতরাই সংবিধান সংশোধন করবে। বাংলাদেশের মানুষের অসংখ্য চাওয়া আছে, আগামীর নির্বাচনে যারা জয়ী হবেন তাদের সেই চাওয়াগুলো পূরণ করতে হবে।

এদিকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’-এর খসড়া প্রস্তাবে বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলের যে দাবি এসেছে, সে প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘এ দাবি এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। ভবিষ্যতে যদি কখনও সুযোগ ও সময় আসে, তখন জাতির চিন্তা করে দেখা উচিত।’

বাহাত্তরের সংবিধানকে মুজিববাদী সংবিধান বলে তা কবর দেওয়া হবে, কেটে ফেলা হবে— ছাত্রনেতাদের এমন বক্তব্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দপ্তর সেল সম্পাদক জাহিদ আহসান বলেন, আমাদের এখনো দাবি আছে যে এই সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা উচিত। সেক্ষেত্রে সংবিধানের লেজিটিমেট (বৈধ) বডি হিসেবে গণপরিষদ নির্বাচন হতে হবে। তারপর গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা এই সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান করবে। 

জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহবায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, আমাদের আলোচনায় ছিলো যদি সরকারিভাবে জুলাই প্রক্লেমেশন ঘোষণা করা হয় এবং এটাতে যদি অধিকাংশ রাজনৈতিক দল পজিটিভ হয় তাহলে ওেই জুলাই প্রক্লেমেশনকে ভিত্তি ধরে সাধারণত সংবিধান সংস্কার হবে। পরবর্তীতে যে নির্বাচন হবে এবং সেখানে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবে তারা কাজটি করবে। 

তিনি বলেন, প্রথমদিকে ৫ দফা দাবি ছিল। তার মধ্যে রাষ্ট্রপতির অপসারণ, সংবিধান বাতিল, প্রক্লেমেশন অব সেকেন্ড রিপাবলিক এবং সকল রাজনৈতিক দল নিয়ে একটা কাউন্সিল করা ছিল অন্যতম। রাষ্ট্রপতি অপসারণ করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকার কনভিন্স করতে পারেনি তাই পরবর্তীতে আগানো হয়নি। এখন আমাদের প্রধান দুইটা দাবি। একটা হলো জুলাই প্রক্লেমেশন। এটা করার জন্য আমরা একটা অল পার্টিস কাউন্সিল করার কথা বলেছিলাম। কিন্তু সরকারের কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। তখন বৈষম্যবিরোধীরা উদ্যোগ নিয়েছে প্রক্লেমেশন অব জুলাই ঘোষণা করার।

তিনি আরও বলেন, উপদেষ্টাদের একটা অংশও সেখানে আসার পরিকল্পনা ছিল। পরবর্তীতে সরকার উপলব্ধি করল যে, ছাত্ররা যদি করে এখানে কিছু জটিলতা থাকতে পারে। আমাদের প্রথম থেকে দাবি ছিলো সরকারই করুক। কিন্তু তারা না করায় ৩১ ডিসেম্বর আমাদের বড় ধরণের প্রস্তুতি ছিলো জুলাই প্রক্লেমেশন ঘোষণা করার।

আরিফুল ইসলাম যোগ করেন, যখন সারা দেশ থেকে মানুষ আসতেছিলো তখন সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা জুলাই প্রক্লেমেশন ঘোষণা দিবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলসহ সবার সাথে আলাপ আলোচনা করে। ফলে জুলাই প্রক্লেমেশনের সাথে সংবিধান বাতিলের একটা যোগসুত্র আছে। প্রক্লেমেশন যদি এভাবে লেখা যায় যে, ১৯৭১ পরবর্তী ৭২ এর সংবিধান মহান মুক্তিযুদ্ধকে রিপ্রেজেন্ট করে না। বরং একটা বিদেশী বা পররাষ্ট্রনীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এবং সে সংবিধানকে পুনরায় লিখতে হবে। তখন সংবিধান বাতিলের বিষয়টি একটাতেই হয়ে যায়।


সর্বশেষ সংবাদ