‘আমি কি জানতাম ওটাই আমার ছেলের শেষ খাওয়া’: শোভনের মা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শহিদুল ইসলাম শোভন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শহিদুল ইসলাম শোভন

‘সেদিন ছিল শুক্রবার। শোভন দুপুরে বিরিয়ানি খাচ্ছিল, ওর বন্ধুরা তখন বার বার ফোন দিচ্ছিল। ছেলেটা আমার তাড়াহুড়া করে খেয়ে চলে গেলো... আমি কি জানতাম ওটাই আমার ছেলের শেষ খাওয়া!’ কাঁদতে কাঁদতে বললেন শোভনের মা শাহনাজ বেগম। শহিদুল ইসলাম শোভন (২১) গত ১৯ জুলাই রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত হন।

শোভন গত বছর শেখ বোরহান উদ্দিন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। চকবাজারের সেলসম্যান আলমগীরও সেদিন তার দুই বন্ধুকে নিয়ে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল। গত ১৯ জুলাই বিক্ষোভরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে ঢাকা নিউমার্কেট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন সাইদুল ইসলাম শোভন। পড়াশোনার জন্য তার জাপানে যাওয়ার কথা ছিল। কাগজপত্র ও প্রায় রেডি। কিন্তু আর যাওয়া হলো না তার। তার আগেই মালিকের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলো ওপারে।

শহীদ শোভনের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার কোলাপাড়া গ্রামে। শোভন নিহতের ঘটনায় তার আত্মীয়স্বজন, সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজনের মধ্যে শোক নেমে আসে। তার বাবা-মা এখন পাগলপ্রায়। শোভনের মামা মনির হোসাইন বলেন, এই সন্তানকে নিয়ে তার বাবা-মায়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। পরিবারের সবার ইচ্ছে ছিল শোভন বড় হয়ে বাবা-মায়ের সব স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু দেশের জন্য শহীদ হয়েছে শোভন।

 ‘আমরা তখন নিউমার্কেট পেট্রোল পাম্পের সামনে। ধাওয়া-পালটা ধাওয়া চলছে। গুলির শব্দ হচ্ছে মুহুর্মুহু। পেছনে তাকিয়ে দেখি একটা ছেলে সেজদার ভঙ্গিতে উঁবু হয়ে বসে আছে। ততক্ষণে আমাদের ছাড়িয়ে পুলিশ আরো সামনের দিকে চলে গেছে। দৌড়ে গেলাম ছেলেটার কাছে। ওকে আঁকড়ে ধরলাম। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাই, আমাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যান, প্লিজ।’ একথা বলতে না বলতেই আমার গায়ে শরীর এলিয়ে দিলো। আমরা দ্রুত একটা রিকশা নিলাম। তখনো বেঁচে ছিল ছেলেটা। ওর আঙুল দিয়ে ওর ফোন আনলক করালাম। গলায় ঝুলানো আইডি কার্ডে লেখা: ‘সাইদুল ইসলাম শোভন, কলেজ শেখ বোরহানউদ্দিন’। ডায়ালড নাম্বার লিস্ট থেকে একটা নাম্বারে কল দিয়ে জানালাম, শোভনের গুলি লেগেছে। ওকে আমরা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছি, তার পরিবারকে যেন খবর দেয়া হয়।’

‘যাওয়ার পথে শোভন একটা বড় নিশ্বাস নিলো। আশঙ্কা হলো: হয়তোবা শোভন মারা গেছে।’

হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ওখানে আহত-নিহত মানুষের ছড়াছড়ি। চারদিকে কান্নাকাটি আর হুড়োহুড়ি। একজন ডাক্তার পার্লস দেখে বললেন, ‘আগেই মারা গেছে।’ শোভনকে নিয়ে কথাগুলো বলছিল আলমগীর হোসেন।

সন্ধ্যার দিকে পাশের বাড়ির এক ছেলে এসে বলে, ‘আন্টি শোভনের গুলি লেগেছে, ওকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হইছে। ওর বাবা তখন ইন্ডিয়াতে। পাগলের মত ছুটে গেলাম হাসপাতালে... গিয়ে দেখি ইমার্জেন্সির এক কোণায় একটা ট্রলিতে আমার শোভন পড়ে আছে, কয়েকটা ছেলে ওর পাশে দাঁড়ানো... শোভনের কাছে দৌঁড়ে গেলাম, আমার ছেলের দেহ নিথর। কত্ত ঝাঁকুনি দিলাম, ছেলে কিছু বলে না।  আমার শোভন তখন আর নাই!’ একথা বলে ঢুকরে কেঁদে ওঠেন শাহনাজ।

শোভনের মা শাহনাজ বেগম বলেন, ‘আমরা তো জানতাম না আমার ছেলে দেশের প্রতি এই রকম ভালোবাসা ছিল, ও যে নিজেই দেশের জন্য পোস্টারের আরেকজন শহিদ হয়ে গেল!’

তিনি আরও বলেন, ‘কত্ত স্বপ্প ছিলো ছেলেটাকে নিয়ে, সব শেষ হয়ে গেলো। আমার সাজানো-গোছানো সংসারটা শেষ হয়ে গেলো! জানি না বাকি জীবনটা কিভাবে কাটবে আমাদের! সরকারের কাছে আমাদের কিছু চাওয়ার নাই। শোভন দেশের জন্য যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে মারা গেছে- শোভন যেমন দেশ চেয়েছিল সেরকম হোক এই দেশটা। দেশের মানুষ যেন আমার সন্তানকে মনে রাখে, ওর আত্মত্যাগের কথা ভুলে না যায়।’

বোরহানউদ্দিন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘শোভন খুব সাহসী ছিল। সে আমাদের জাতীয় বীর। শোভনের মত তরুণদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই এই দেশের নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। আমরা এই জাতীয় বীরদের অবদান ভুলব না’।


সর্বশেষ সংবাদ