ফুটবলের দুর্ভাগা রাজকুমার নেইমার

একজন দুর্ভাগা নেইমার
একজন দুর্ভাগা নেইমার  © সংগৃহীত

ব্রাজিলের ‘হেক্সা’ জয়ের মিশনে এবারও কোচ তিতের অন্যতম ভরসা নেইমার। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে সার্বিয়ার বিপক্ষে গোল না পেলেও চেনা চেহারায় ছিলেন ৩০ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড। কিন্তু প্রতিপক্ষের লক্ষ্য যাঁর দুটি পা। বর্ণিল ক্যারিয়ারে চোট যেন তার চিরসঙ্গী। গত রাশিয়া বিশ্বকাপেও চোট পেয়ে ছিটকে গিয়েছিলেন তিনি। নেইমার জুনিয়র ফুটবলের যেন এক দু:খী রাজকুমার। যার ক্যারিয়ারে সবকিছু শেষ করে দিয়েছে ইনজুরি। 

নেইমার বিশ্বকাপে খেলবে আর চোটে পড়বে এটাযেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোটে পড়ে বিশ্বকাপের পরের দুই ম্যাচের জন্য ছিটকে গেছেন নেইমার। সার্বিয়ার বিপক্ষে শেষ বাঁশি বাজার ১৩ মিনিট আগে ডান পায়ের গোড়ালিতে আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি। তবে এই ইনজুরি তার ক্যারিয়ারের প্রথম নয়। ২০১৪ সালের পর থেকে সব মিলিয়ে মোট ১৮ বার নানান ধরণের ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছেন নেইমার। আর ১৮ বারের ইনজুরিতে পড়ে খেলতে পারেননি ৭১টি ম্যাচ।

ইনজুরির শিকার নেইমারকে সব থেকে বেশি পাঁচ ভুগিয়েছে ডান পায়ের গোড়ালি। জানুয়ারি ২০১৪ সালে প্রথম ডান পায়ের গোড়ালিতে চোট পায় নেইমার। সেবার ৮টি ম্যাচ খেলতে পারেননি নেইমার। এরপর একই স্থানে চোট পান সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে। সেবার নেইমার ১টি ম্যাচ খেলতে পারেননি। এরপরে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবারও ডান পায়ের গোড়ালিতে আঘাত পান নেইমার। সেবার ১৮টি ম্যাচ খেলা থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল নেইমারকে।

জানুয়ারি ২০১৯ সালে একই জায়গায় আঘাত পায় নেইমার। প্রায় আড়াই মাস মাঠের বাইরে থেকে ১৮টি ম্যাচ খেলতে পারেননি নেইমার। কোপা আমেরিকার ঠিক আগে জুন ২০১৯ সালে আবারও একই জায়গায় আঘাত পেয়ে ছিটকে গেছেন কোপা আমেরিকার পুরো টুর্নামেন্ট থেকেই। 

২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট চার বার বাম উরুর ইনজুরিতে পড়েছে নেইমার। আর এই চারবারের ইনজুরিতে নেইমার খেলতে পারেননি ছয়টি ম্যাচ। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাম উরুর ইনজুরিতে পড়ে তিন ম্যাচ খেলতে পারেনি নেইমার। এরপর ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে এই ইনজুরির কারণে খেলেননি ১টি ম্যাচ। ২০১৭ সালের মার্চ এবং নভেম্বরে পৃথক দুই ইনজুরিতে মিস করেন একটি করে মোট দুইটি ম্যাচ।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে পাঁজরের ইনজুরির কারণে একটি ম্যাচ মিস করেন নেইমার। নেইমার এখন পর্যন্ত মাত্র একবার কাঁধের ইনজুরিতে পড়েছেন। ২০১৫ সালের আগস্টে কাঁধের ইনজুরিতে পড়ে চারটি ম্যাচ খেলতে পারেননি নেইমার। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে ১৮টি পৃথক ইনজুরিতে পড়েছে নেইমার। একজন ফুটবলারের কাছে তার ফিটনেসটাই সব থেকে বড় অস্ত্র। আর ব্রাজিলিয়ান এই তারকা দিনকে দিন যেন হারিয়ে ফেলছে সেই অস্ত্রটিই।

জাতীয় দলের জার্সিতে হোক বা ক্লাব ফুটবল ক্যারিয়ারে নেইমার যে কতবার চোটে পড়েছেন, ইয়ত্তা নেই। ২০১৭ সালে বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত চোট, অসুস্থতা, ফিটনেস সমস্যা ও বিশ্রাম মিলিয়ে মোট ৩৫৬ দিন মাঠের বাইরে কাটিয়েছেন। এর মধ্যে মেটাটারসাল বা পায়ের পাতার হাড়ে চোট পেয়ে ২০১৭-১৮ মৌসুম ৯০ দিনের জন্য ছিটকে যান। এ তো গেল নেইমারের ক্লাব ক্যারিয়ারের চোটের কথা। 

আরও পড়ুন: এত অর্জনেও তার এক অপ্রাপ্তি যেন সোনালী ছোঁয়া

২০১৪ বিশ্বকাপ

ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ হওয়ায় সেবার ফেবারিট ছিল ব্রাজিল। সবার আশা ছিল সেলেসাওদের হেক্সা মিশন পূরণ করবেন নেইমার। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের সময় মেরুদন্ডের আঘাতে বিশ্বকাপ যাত্রা শেষ হয়ে যায় নেইমারের। সেই ইনজুরিটা এতটাই মারাত্মক ছিল যে শেষ হয়ে যেতে বসেছিল নেইমারের ফুটবল ক্যারিয়ার। তবে সে যাত্রা মাত্র ২টি ম্যাচ খেলতে পারেননি নেইমার। ম্যাচটিতে ফাউল হয়েছিল মোট ৫৪টি। ওই বিশ্বকাপে নেইমারের ফাউলের শিকারের অনুপাতের হার ছিল ৩ দশমিক ৬। 

২০১৮ বিশ্বকাপ

রাশিয়া বিশ্বকাপেও তিতের অন্যতম অস্ত্র ছিলেন নেইমার। ৫ ম্যাচে সর্বোচ্চ ২৬ বার ফাউলের শিকার হতে হয়েছে নেইমারকে। বড় চোট কাটিয়ে দলে ফিরে সেই আশাও জাগিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এবারও সেলেসাওরা বিদায় নেয় শেষ আট থেকে। নেইমার অবশ্য প্রতি ম্যাচেই খেলেছিলেন। পুরো আসরে তাঁর ফাউলের শিকার হওয়ার অনুপাতের হার ছিল ৫ দশমিক ২।

২০২২ বিশ্বকাপ

সার্বিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ব্রাজিল ২-০ গোলের জয় দিয়ে হেক্সা-মিশন শুরু করেছে। কিন্তু ওই ম্যাচের শেষদিকে অ্যাঙ্কেলের চোট নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন নেইমার। চোট বেশ গুরুতর। গ্রুপপর্বে সুইজারল্যান্ড এবং ক্যামেরুনের বিপক্ষে ম্যাচে মাঠে নামতে পারবেন না ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার। 

খেলার ৮০ মিনিটে মাঠ ছাড়ার আগে নেইমার মোট ৯ বার ফাউলের শিকার হন। যা এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত কোন সিংগেল প্লেয়ারকে সর্বোচ্চ ফাউলের রেকর্ড। নেইমার যখন ম্যাচশেষে সাইডবেঞ্চে বসে ছিলেন, তখনই তার চোখেমুখে স্পষ্ট হয়েছে ইনজুরির যন্ত্রণা। দল যখন জয় উদযাপনের অপেক্ষা করছিল, তখন ব্রাজিলের মেডিকেল টিম তার প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত ছিল।

ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলোতে ২০২২-২৩ মৌসুমে সবচেয়ে বেশিবার ফাউলের শিকারও নেইমার। সংখ্যাটি ৬৬। 

নেইমারের ফেরার বার্তা

এই জার্সি পরে আমি যে গর্ব ও ভালোবাসা অনুভব করি, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। যদি ঈশ্বর আমাকে নির্দিষ্ট কোনো একটি দেশে জন্ম নেওয়ার জন্য বেছে নিতে সুযোগ দেন, তবে সব সময় সেটি হবে ব্রাজিল। আমি জীবনে কোনো কিছু সহজে লাভ করিনি। আমাকে সব সময় নিজের স্বপ্ন ও লক্ষ্যের পথে ক্রমাগত ছুটতে হয়েছে। আজকের এই দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলোর একটি। এবং আবারও বিশ্বকাপে। হ্যাঁ, আমি চোটে পড়েছি। এটা যন্ত্রণা দেবে, তবে আমি ফিরে আসতে পারব। নিজের দেশ, সতীর্থ এবং নিজেকে সহায়তা করতে সম্ভাব্য সবকিছু করব। অনেক অপেক্ষার পর শত্রুরা এভাবে আমাকে হারিয়ে দেবে? কখনো না। আমি সৃষ্টিকর্তার সন্তান এবং আমার বিশ্বাস চিরন্তন।

প্রসঙ্গত, পেলের সঙ্গে তুলনা নিয়ে যাঁর ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল নেইমারের। পেলের কাছাকাছি আছেন দেশের হয়ে গোলের সংখ্যায়। ৯২ ম্যাচে পেলের ৭৭ গোল ব্রাজিলকে তিনটি বিশ্বকাপ দিয়েছে। ১২১ ম্যাচে নেইমারের ৭৫ গোল। এই বয়সে আরও একটা বিশ্বকাপের সামনে দাঁড়িয়ে নেইমার দেখছেন। তাঁর এখনো কিছুই দেওয়া হয়নি ব্রাজিলকে, পাওয়া হয়নি কিছুই। কাতার বিশ্বকাপই যেন নেইমারের স্বপ্নপূরণের মঞ্চ।


সর্বশেষ সংবাদ