১১৪ বছরের প্রথা ভেঙে মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ অমুসলিম ছাত্র ভর্তি
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:৫৭ PM , আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৪:০৯ PM
১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে শুধুমাত্র মুসলিম শিক্ষার্থীদের ভর্তি হওয়ার সুযোগ ছিল নগরীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম’-এ। তবে ১১৪ বছরের প্রথা ভেঙে আগামী ২০২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে মুসলিম শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অমুসলিম বিদ্যার্থীরাও প্রতিষ্ঠানটিতে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। এর মধ্যেই পঞ্চম, ষষ্ঠ ও নবম শ্রেণিতে এই প্রথমবারের মতো ছয়জন অমুসলিম শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। আগামী ১৪ ডিসেম্বর ভর্তি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুন: মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ে অমুসলিম শিক্ষার্থী ভর্তিতে আপত্তি অভিভাবকদের
এদিকে, কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বলছেন, যে প্রতিষ্ঠানের জন্মই মুসলিম ছাত্রদের জন্য, সেখানে অন্য ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা কেন আসবে? তাই এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বানও তাদের। তবে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারের নিয়ম অনুযায়ী ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ দিচ্ছেন তারা। লটারিতে যারাই নির্বাচিত হবে তারাই প্রতিষ্ঠানটিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ আক্তার বলেন, সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক যেকোনো ধর্মের কোনো শিক্ষার্থী যদি আমাদের বিদ্যালয়ে লটারির মাধ্যমে চান্স পায়, আমরা সেই শিক্ষার্থীকে ভর্তি নিচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে আমরা ছয় জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করেছি। ১৪ তারিখ পর্যন্ত বিদ্যালয়ের ভর্তি চলবে। আমার কাছে ধর্ম কোনো বিষয় না। আমার বিষয় হচ্ছে লটারিতে পাশ করেছে তাদের ভর্তি করতে হবে, যারা মেধাতে এসেছে তারা ভর্তি হবে।
সম্প্রতি রাতের বেলা বিদ্যালয়ের দেয়ালে টাঙানো ব্যানারের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ‘সম্মিলিত অভিভাবক ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এর নামে ওই ব্যানারটি লাগানো হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেখানে লেখা হয়েছে, “চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের ভর্তি লটারিতে অমুসলিম ছাত্রদের অংশগ্রহণের অর্ন্তভুক্ত না দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় শুধুমাত্র মুসলিম ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত একটি প্রতিষ্ঠান।” যদিও গত শনিবার ওই ব্যানার টানানোর পরের দিন সেখানে ব্যানারটি আর দেখা যায়নি।
নগরীর কোতোয়ালি থানার সীমানা দেয়ালের সাথে লাগানো সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর। এই বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় একশ বছরের বেশি সময় আগে, হাজী মুহাম্মদ মহসীনের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ফান্ডের টাকায়। শুরুতে এটি চট্টগ্রাম মহসিনিয়া মাদ্রাসা নামে যাত্রা শুরু করে। পরে হাজী মুহাম্মদ মহসিন উচ্চ বিদ্যালয় ও হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ নামের দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়।
এক সময় ইসলাম ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ায় স্থানীয় মুসলিম নেতাদের উদ্যোগে বিদ্যালয়ের ‘অ্যাংলো-পার্সিয়ান ডিপার্টমেন্ট’ হিসেবে (এখানে ইংরেজি ও ফারসি ভাষা পড়ানো হত) মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়।
সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, “খুব কম সময়ের ব্যবধানে এ ডিপার্টমেন্টের ছাত্র সংখ্যা বাড়তে থাকলে প্রয়োজনের তাগিদে এ ডিপার্টমেন্টটি রেজিস্ট্রেশন ভবনে অর্থাৎ বিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত হয় ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে।
“স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের দাবি ও চেষ্টার ফলে উক্ত ডিপার্টমেন্টটি ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে গভ. মুসলিম হাইস্কুল নামে বর্তমান জায়গায় পর্তুগিজ আমলে নির্মিত পুরাতন দ্বিতল ভবনে স্থানান্তরিত হয় পূর্ণাঙ্গ বিদ্যালয়ের স্বাধীন সত্তা নিয়ে।”
ওয়েবসাইটে লেখা আছে, “বিদ্যালয়ের স্বাধীন গভর্নিং বডি গঠিত হয় ১৯১৬ সালে। উল্লেখ থাকে যে, বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে এটাই একমাত্র বিদ্যালয় যা স্থাপিত হয়েছিল কেবল মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষা লাভের জন্য।
“অবকাঠামোগত দিক দিয়ে বিদ্যালয়টি আকর্ষণীয় না হলেও গুণগত, আদর্শ ও কৃষ্টিগতভাবে এটি ছিল তৎকালীন মুসলিম পরিবারের মেধাবী ও প্রতিভাবান ছাত্রদের আকর্ষণীয় শিক্ষালয়। সেই সময়ে এই বিদ্যালয়কে মনে করা হত মুসলিম ঐতিহ্য ও তমদ্দুনের প্রতীক হিসেবে।”
দেশ ভাগের পর ভারত থেকে আসা উর্দুভাষী মুসলিম, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা বাহিনীর পোষ্যদের প্রয়োজনে এই বিদ্যালয়ে ১৯৫১ সালে উর্দু শাখা খোলা হয়।
পরে মুসলিম উচ্চবিদ্যালয় সরকারি করা হয়। তবে আগের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে সেখানে কোনো অমুসলিম ছাত্র ভর্তি করা হত না। সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তিতে লটারি পদ্ধতি চালু হওয়ার পর এই প্রথম বিদ্যালয়টিতে কয়েকজন অমুসলিম শিক্ষার্থী ভর্তি হল।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানের বর্তমানে দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে বলে জানা গেছে। বিদ্যালয়টিতে ৫ম থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। এখানে ভর্তির সুযোগ পায় শুধুমাত্র ছেলে শিক্ষার্থীরা। মুসলিম শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ায় এখানে তাদের জন্য ড্রেসকোডে সাদা শার্ট ও প্যান্টের সঙ্গে সাদা টুপি পরাও বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে। এখন থেকে অমুসলিম শিক্ষার্থী ভর্তি হলে তাদের ড্রেসকোড কেমন হবে— সে বিষয়ে কোনো উত্তর দিতে পারেননি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ আক্তার।