পতাকা হাতে বিজয়োল্লাসে গিয়ে মাথায় গুলি, ১৩-তেই থেমে গেল স্কুলছাত্র নূরের জীবন

সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল জুলাই আন্দোলনে

সামিউ আমান নূর
সামিউ আমান নূর  © টিডিসি সম্পাদিত

জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন ছাত্রশিবিরের কর্মী সামিউ আমান নূর (১৩)। গেল বছরের ১৮ জুলাই ঢাকার উত্তরা বিএনএস সেন্টারে পুলিশের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষে আহতও হয়েছিলেন তিনি। এরপর সারাদেশে কারফিউ থাকা সত্ত্বেও তিনি রাজপথ ছাড়েননি। ১৯ জুলাই থেকে প্রতিদিনই মিছিলে ছিলেন সামনের সারিতে।

পরবর্তীতে ৫ আগস্টে দুপুরে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বের হওয়া বিজয় মিছিলে শামিল হতে জাতীয় পতাকা হাতে বাসা থেকে বের হয়েছিল গাজীপুরের টঙ্গীর এই স্কুল শিক্ষার্থী। টঙ্গীর বৌ-বাজার এলাকায় বেড়ে ওঠা এই শিক্ষার্থী সেদিন কল্পনাও করতে পারেনি স্বৈরাচারের পতনের পরও তাকে গুলিতে প্রাণ হারাতে হবে। পরিবারও বুঝে উঠতে পারেনি তাদের সন্তান সবাইকে কাঁদিয়ে না পরপারে পাড়ি জমাবে।

সামিউ আমান নূর টঙ্গীর সিরাজ উদ্দিন সরকার বিদ্যানিকেতনের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। তার পরিবার টঙ্গীর পূর্ব আরিচপুর এলাকায় বসবাস করে, তাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়ায়। ছাত্রশিবিরের টঙ্গী শিল্পাঞ্চল থানার ৪৫নং ওয়ার্ডের গাজীবাড়ী উপশাখার কর্মী ছিলেন বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা।

অভিযোগ উঠেছে, জুলাই বিপ্লবের আট মাস পেরিয়ে গেলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো নেতা শহীদ সামিউ আমান নূরের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেননি। কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় পর্যায়ে কেউই তাদের খোঁজ খবর নেয়নি কখনো। তবে জুলাই রেভ্যুলেশনারি এলাইন্সের পক্ষ থেকে গত ২৪ মার্চ শহীদ পরিবারের সাথে ইফতার করা হয়। 

এদিকে, গাজীপুর মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক জামাল উদ্দিন শহীদ সামিউ আমান নূরের বাসায় গিয়ে খোঁজখবর নেন এবং দুই লাখ টাকা উপহার দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে। এছাড়া জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন শহীদ নূরের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা প্রদান করেছে।

সামিউ আমান নূর— পরিবারের সবার ছোট, দুই বোনের আদরের ভাই। মাত্র ১৩ বছর বয়স, উচ্চতায় ছিল ৫ ফুটের বেশি। নম্র, ভদ্র, মেধাবী, ইংরেজিতে দক্ষ এবং আদর্শ ছাত্র। কিন্তু সেই প্রতিভাবান কিশোরের জীবন থেমে গেল ৫ আগস্টের এক নির্মম গুলিতে।

জানা যায়, ৫ আগস্ট দুপুর ৩টার কিছু পরে শেখ হাসিনার পতনের খবর পেয়ে উচ্ছ্বাসে রাজপথে নামেন তিনি। জাতীয় পতাকা হাতে বিজয় মিছিলে উত্তরা বিএনএস ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় পাশের একটি ভবন থেকে টার্গেট করে মাথায় গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন নূর। তাকে দ্রুত টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়, সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার করা হয়। তবে উত্তরা আজমপুর পার হতে না পেরে নেওয়া হয় উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে, যেখানে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন শহীদ সামিউ আমান নূর।

সামিউ আমান নূরের বাবা মো. আমান উল্লাহ বলেন, আমার ছেলেসহ সকল শহীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। শেখ হাসিনার ফাঁসি চাই। আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করা হোক।

তার বড় বোন আফরিন আমান বলেন, আমাদের আদরের ছোট ভাইকে শেখ হাসিনার নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এই হত্যার বিচার চাই, তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।

শহীদ সামিউ আমান নূরের সহপাঠীরা জানান, শহীদ সামিউ আমান নূর শুধু একটি নাম নয়, বরং লাল জুলাই বিপ্লবের এক উজ্জ্বল সাক্ষী। তার রক্ত যেন বৃথা না যায়, তার স্বপ্ন যেন বেঁচে থাকে প্রতিটি বিপ্লবী হৃদয়ে। তার আত্মত্যাগকে স্মরণ করে অন্যায়, বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রাম আরও দৃঢ় করতে হবে।

টঙ্গী শিল্পাঞ্চল থানা শিবিরের সভাপতি নুর মুহাম্মদ বলেন, শহীদ সামিউ আমান নূর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই আমাদের সাথে যুক্ত ছিলেন। ৫ আগস্ট সরকারবিরোধী আন্দোলনের বিজয় মিছিলে অংশ নেওয়ার সময় উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনে ঘাতকের গুলিতে তিনি নিহত হন।

তিনি আরও বলেন, নূর একজন মেধাবী ও অমায়িক স্বভাবের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি সবসময় শান্তভাবে কথা বলতেন এবং সংগঠনের প্রতি তার গভীর নিষ্ঠা ছিল। তিনি ছাত্রশিবিরের টঙ্গী শিল্পাঞ্চল থানার ৪৫নং ওয়ার্ডের গাজীবাড়ী উপশাখায় দায়িত্ব পালন করতেন।


সর্বশেষ সংবাদ