বাংলাদেশে শিক্ষকদের একাডেমিক স্বাধীনতা কতটুকু?

ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক
ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক  © ফাইল ফটো

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর একটি জাতিকে শিক্ষিত জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন শিক্ষকরা। সাধারণত একজন ব্যক্তি তখনই পরিপূর্ণভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন যখন তিনি তার কাজের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা পান। বাংলাদেশে শিক্ষকদের আর্থিক ও প্রশাসনিক মর্যাদা আশাব্যঞ্জক নয় বলে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা রয়েছে।  কর্মক্ষেত্রে তাঁরা কতটুকু একাডেমিক স্বাধীনতা পান সম্প্রতি সে প্রশ্নও উঠেছে। 

একজন শিক্ষকের জন্য একাডেমিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বলতে সাধারণত বোঝানো হয় ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানো এবং যেকোনো বিষয়ে আলোচনা করার অধিকার, গবেষণা করা, সেটির ফলাফল প্রকাশ করা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে দেশে বর্তমানে ৪৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক। গত মার্চে শ্রেণীকক্ষে লেকচার দেয়াকালে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন বলে বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মামলার আসামী হয়ে ওই শিক্ষক এখনও কারাবন্দী। এ ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কতটা একাডেমিক স্বাধীনতা পাচ্ছেন শিক্ষকরা? 

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. কুদরত-ই জাহান বলেন, ‘বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার একাডেমিক ক্ষেত্রে খুব একটা বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় না। তবে সামগ্রিকভাবে যদি বলি তাহলে আমরা সবসময় যা চাই বলতে পারি না, নিজেদের সকল মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের নেই। নিজেদের ওপর নিজেদেরই একটা সেন্সর চাপিয়ে দিতে হচ্ছে।’ 

একই বিষয় উল্লেখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাঈদ ফেরদৌস বলেন, ‘আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এমন কোনো আইন তৈরি করা হয়নি যা শিক্ষকদের একাডেমিক স্বাধীনতাকে বাঁধাগ্রস্ত করছে। তবে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি কিছুটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে অনেক শিক্ষক হয়তো এই একাডেমিক স্বাধীনতা চর্চা করতে ভয় পাচ্ছেন।’ 

আরও পড়ুন: গুচ্ছে আয় কমায় অসন্তোষ, ভর্তি ফি’র পুরোটাই পাবে বিশ্ববিদ্যালয়

নীতি নির্ধারক এবং শিক্ষকদের দায়িত্বের বিষয়টি উল্লেখ করে এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘পলিসি মেকার যারা রয়েছেন তাদের দায়িত্ব এমন পরিবেশ নিশ্চিত করা; যেখানে শিক্ষকরা তাদের একাডেমিক স্বাধীনতার চর্চা করতে পারবেন। একইসাথে শিক্ষকদেরও নিশ্চিত করতে হবে যে, তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন।’

একাডেমিক স্বাধীনতার অবনতি হচ্ছে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অধ্যাপনার অভিজ্ঞতা থেকে বললে এখন পর্যন্ত একাডেমিক স্বাধীনতার চর্চার ক্ষেত্রে তেমন কোনো বাঁধার সম্মুখীন হইনি। তবে যারা সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকতা করছেন তাদের হয়তো কিছু ক্ষেত্রে বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। অথবা যদি কারও কোনো কথা কিংবা কাজ ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে যায় সেক্ষেত্রেও হয়তো বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়।

সম্প্রতি বিজ্ঞানের একজন শিক্ষককে গ্রেফতারের ঘটনাটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একজন শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করবেন এটাই স্বাভাবিক বিষয় এবং শিক্ষকের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে প্রদান করা। কিন্তু এরূপ একটি ঘটনায় যখন শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয় সেটি একাডেমিক স্বাধীনতায় আঘাত হানে। আর এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে এটি বলতেই হয় যে পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে।’ 

পদার্থ বিজ্ঞানের এই অধ্যাপক মনে করেন, পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেনো শিক্ষকদের তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। শিক্ষার্থীর মনে প্রশ্ন তৈরি হলে নৈতিক দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে তাকে সেই বিষয়ে সঠিক উত্তর প্রদান করতে হবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউল্যাব, ঢাকা কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ উচ্চ শিক্ষার ১১টি প্রতিষ্ঠানের পৃথক ২০টি বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘তাঁদের শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষে কখনও কখনও এমন বক্তব্য দেন যা কারও ধর্মীয়, ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক অনুভূতিতে লাগে। এ নিয়ে শ্রেণীকক্ষে অনেকসময় দীর্ঘ আলোচনাও হয়। কিন্তু তা কখনও শ্রেণীকক্ষের বাইরে যায়নি। বিষয়টিকে একাডেমিক আলোচনা হিসেবেই দেখেন দুই পক্ষ। এ নিয়ে বিবাদ চান না কোনো পক্ষই। দুই পক্ষই মনে করেন, শ্রেণীকক্ষে সবাই মনের কথা ও প্রশ্ন বলে বিভিন্ন বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখাটাই শ্রেয়।’ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীরা বলেন, ‘রাজনীতি বা গোষ্ঠীতন্ত্রের চর্চা দেশের অন্য অঙ্গনের মত শিক্ষাঙ্গনেও রয়েছে। সে অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। তবে শ্রেণীকক্ষের আলোচনা-উত্তেজনা শ্রেণীকক্ষের বাইরে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য সৎ নয়। অনেকে তিলকে তাল করে দেখায়। এতে রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীগত বা কারও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্য থাকে। রাজনৈতিক মেরুকরণ তীব্রতর হওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা যদি সৎভাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ন্যায্য আচরণ করেন; তাহলে অনেকাংশেই সমস্যা কমানো যায়।’ 

তবে একজন শিক্ষক সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই উল্লেখ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সরকার আলী আক্কাস বলেন, ‘একজন শিক্ষক যদি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন সেক্ষেত্রে তাকে বাঁধা দেয়ার কিংবা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই। যেমন, একজন আইনের শিক্ষক হিসেবে আমি পড়ানোর প্রয়োজনে ধর্মীয় বিষয়সহ অনেক বিষয়ে আলোচনা করি। কিন্তু আলোচনার সময় আমি এটি মাথায় রাখি আমার আলোচনাটি কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সঙ্গতভাবেই যদি এটি করে তাহলে তাদের একাডেমিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের সুযোগ কেউ পাবে না। আর এরপরেও যদি হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে তাহলে জোরালো প্রতিবাদের সুযোগ রয়েছে।’

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া একাডেমিক স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আমরা বিবেচনা করি তাহলে এখানে এখনও শিক্ষকরা মুক্তমতের চর্চা করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের একাডেমিক স্বাধীনতা রয়েছে, কেউ কেউ হয়তো ব্যক্তিগত জায়গা থেকে সেই চর্চাটা করেন না কিংবা করতে ভয় পান। তবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এটা স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করতে চাই যে, একাডেমিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, এখানে একজন শিক্ষক সেটিই বলবেন যেটি সঠিক এবং বিজ্ঞান সম্মতভাবে প্রমাণিত।’


সর্বশেষ সংবাদ