বছর জুড়েই আলোচনা-সমালোচনায় রাবি

  © ফাইল ফটো

বছরজুড়ে ছোট-বড় নানান ঘটনার সাক্ষী হয়ে বিদায়ের পথে ২০১৯ বর্ষ। মানুষ গড়ার কারখানা-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ঘটে গেছে নানান ঘটনা। দেশজুড়ে আলোচিত-সমালোচিত ঘটনাপ্রবাহ সয়লাব ছিল বছরব্যাপী। বাদ যায়নি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বছরের শুরুতেই রাকসু নির্বাচন দেয়ার ঘোষণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত কথা রাখতে পারেন নি রাবি উপাচার্য। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড, মারধর, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনার আড়ালে ঘটেছে অনেক প্রাপ্তি ও সাফল্যের ঘটনাও। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বছরের বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো বছর জুড়েই ছিলো আলোচনায়। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো দেখে নেয়া যাক একনজরে।

জানুয়ারি

রাকসু নির্বাচনের কথা রাখতে পারেন নি উপাচার্য: হাইকোর্টের আদেশের ফলে ডাকসু নির্বাচন দিতে ঢাবি প্রশাসন অনেকটা বাধ্য হয়ে পড়ে। একই সময় আন্দোলন শুরু হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও। ছাত্রদের দাবিতে সায় দিয়ে বছরের শুরুর দিকে ‘এ বছরের মধ্যে রাকসু’ নির্বাচন দেয়ার ঘোষণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত কথা রাখতে পারেন নি উপাচার্য। নির্বাচন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রাকসু নির্বাচন সংলাপ কমিটি গঠন করে বছরের অর্ধেকের বেশি সময় তা চালিয়ে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ডাকসু নির্বাচনের পরপরই এ দাবি আরো জোরালো হয়ে ওঠে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী ছাত্রসংগঠন, হলের আবাসিক শিক্ষার্থী, প্রাধ্যক্ষদের সঙ্গে সংলাপ হলেও রাকসু নির্বাচনকে ঘিরে কোনো অগ্রগতির দেখা মেলেনি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। তাদের ভাষায় সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের কমিটির মেয়াদ না থাকায়, নতুন কমিটির অপেক্ষায় রাকসু থেমে আছে।

ছাত্রলীগ নেতাকে ছুরিকাঘাত: ২০জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইমতিয়াজ আহমেদকে বহিরাগত কয়েকজন ছুরিকাঘাত করে। এ ঘটনায় পরে মামলা করেন ইমতিয়াজ।

ফেব্রুয়ারি
হল প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ: বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমানের বিরুদ্ধে অনধিকার চর্চা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনে পদত্যাগ করেন মতিহার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আলী আসগর। ৪ ফেব্রুয়ারি সকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। একই দিন বিকেলে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান। পরে মতিহার হলে নতুন প্রাধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মুসতাক আহমেদ।

সাংবাদিককে মারধরের ঘটনায় স্থগিতাদেশ: আগের বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনাতয়নে বাণিজ্যিক সিনেমা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করে মিলনাতয়ন বন্ধ করে গেটে অবস্থান নেয় প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীসহ শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাদের ওপর ছাত্রলীগের হামলায় সাংবাদিকসহ মারধরের শিকার হন কয়েকজন। সাংবাদিক আলী ইউনুস হৃদয়কে মারধরের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাবরুল জামিল সুস্ময়কে সাংগঠনিক সব কার্যক্রম থেকে এক মাসের স্থগিতাদেশ দেয় ছাত্রলীগ।

দুই কর্মচারী বহিষ্কার: ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময়ে চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও মাদক সেবনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই কর্মচারীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮৮তম সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

শিক্ষককে হত্যার হুমকি: ২৮ ফেব্রুয়ারি সর্বহারা পার্টির পরিচয়ে চাঁদা দাবি করে রাবির দুই শিক্ষককে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। এ ঘটনায় নগরীর মতিহার থানায় জিডি করেন ওই দুই শিক্ষক। তারা হলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম এবং দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোতাছিম বিল্লাহ।

মার্চ
ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ: ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে রাবি ছাত্রলীগের দুইপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ১ মার্চ সন্ধ্যায় দুই দফায় তাদের মধ্যে মারধরের ঘটনা ঘটে। এতে তিনজন আহত হয়।

উপাচার্যের রাজাকার বিতর্ক: ২৫ মার্চ কালরাত স্মরণে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সাথে মতবিনিময়কালে উপাচার্য কোটা আন্দোলন প্রসঙ্গে বলেন, ‘কোটা আন্দোলন রাজাকারের সন্তানরাই করতে পারে’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহানের এমন বক্তব্যে নানা মহলে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। বক্তব্য প্রত্যাহারে উপাচার্যকে আল্টিমেটাম দেয় সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। যদিও উপাচার্যের দাবি তার বক্তব্য বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।

এপ্রিল
রাবি শিক্ষক হত্যা মামলায় তিন জনের মৃত্যুদণ্ড: বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক একেএম শফিউল ইসলাম লিলন হত্যা মামলায় তিনজনের মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। ১৫ এপ্রিল এ আদেশ দেন রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালতের বিচারক অনুপ কুমার রায়।

মে
সাত পুকুর গবেষণা প্রকল্প: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছোট-বড় অনেকগুলো পুকুর ছিল, যা দীর্ঘদিন সংস্কার করা হয়নি । এসব পুকুর সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও গবেষণা কাজে লাগানোর লক্ষ্যে ‘সাত পুকুর প্রকল্প’ নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ২৯ মে উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান সাত পুকুর গবেষণার প্রকল্পভুক্ত জোহা হল পুকুরে মাছের পোনা অবমুক্ত করেন। তবে বছর জুড়ে হতে থাকা ছাত্র-শিক্ষদের আন্দোলনে বারবার প্রকল্পের টাকা নয়-ছয় করার অভিযোগ উঠেছে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা উপ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে।

জুলাই
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে মহাসড়ক অবরোধ: গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে এবং সিলিন্ডার গ্যাসের দাম কমানোর দাবিতে ৭ জুলাই রাবির প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতা-কর্মীরা। এতে সড়কের উভয় দিকে যানজটের সৃষ্টি হয়।

শিক্ষককে অব্যাহতি: রাবির শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) ১ শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুই ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে উঠে। পরে দুই ছাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে গঠিত তদন্ত কমিটি ঘটনার সত্যতা পেয়ে তদন্ত জমা দেয়। পরে অভিযুক্ত শিক্ষককে সকল প্রকার একাডেমিক কার্যক্রমে অব্যহতি দেয়া হয়।

গুজববিরোধী ফোরাম: দেশব্যাপী গুজব প্রতিহতকরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাবিতে আত্মপ্রকাশ করে গুজববিরোধী ফোরাম। ২৭ জুলাই ৩১ সদস্য বিশিষ্ট ফোরামের নতুন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে গণযোগযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মুসতাক আহমেদকে সভাপতি ও লোক প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারাহা নওয়াজকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

সেপ্টেম্বর
ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ: ১৩ সেপ্টেম্বর মাদার বখশ হলের অতিথি কক্ষে বসাকে কেন্দ্র করে রাবির ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করে পরিস্থিতি শান্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ ঘটনায় চারজন আহত হয়।

‘জয় হিন্দ’ স্লোগান দিয়ে বিপাকে উপাচার্য: ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান দিয়ে বিপাকে পড়েন উপাচার্য এম আব্দুস সোবহান। ‘অখণ্ড ভারতের জয়ধ্বনি’ দেয়ার অভিযোগ এনে উপাচার্যকে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী শিক্ষকদের সাদা দল। একই সঙ্গে এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় তারা। এর সাথে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়ার বিরুদ্ধে উঠা নিয়োগ দুর্নীতিকে যোগ করে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তবে ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান দেয়ার ঘটনাকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বিকৃত করে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে বলে দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

অক্টোবর
একাই দাঁড়িয়ে শিক্ষকের প্রতিবাদ: দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গণের দাবিতে নীরব প্রতিবাদ জানিয়ে কর্মসূচি পালন করেছেন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ফরিদ খান। ৩ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা চত্বরে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে একটি প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। প্ল্যাকার্ডে লিখা ছিল- ‘দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন চাই, শিক্ষকের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চাই’।

উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি: নিয়োগ বাণিজ্য ও দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়াসহ প্রশাসনকে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে ৩ অক্টেবর সকাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন তারা।

জাবিতে হামলার প্রতিবাদ: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের অপসারণ দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ওপর হামলাকারীদের শাস্তির দাবিতে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধসহ মানববন্ধন করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

ববির ভিসি হিসেবে রাবির অধ্যাপক: বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. ছাদেকুল আরেফিন মাতিন।

৮ শিক্ষার্থীর ইউজিসির মেধাবৃত্তি লাভ: বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মেধাবৃত্তি পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ৮ শিক্ষার্থী।

নভেম্বর
একাদশ সমাবর্তন: নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ৩০ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাদশ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দীর্ঘদিন সমাবর্তন না হওয়ার পর ২০১৮ সালে ১০ম সমাবর্তনের ধারাবাহিকতায় একাদশ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হওয়া বড় সফলতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এবারের সমাবর্তনে অংশ নেয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষার্থী। শিক্ষাজীবনের সেরা মুহূর্তে আনন্দের জোয়ারে ভেসেছেন সবাই।

দেখতে দেখতে বিদায় নিতে চলেছে ঘটনাবহুল আরো একটি বছর। বছর জুড়ে প্রতিনিয়তই ঘটেছে নানা পরিবর্তন, সৃষ্টি হয়েছে নতুন ইতিহাস। বছর ঘুরে এমন অনেক ঘটনায় অনেক সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনার সাক্ষী হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। নতুন বছর নতুন বার্তা নিয়ে এসে শুভ দিনের সূচনা করবে এই প্রত্যাশায় থাকবে মতিহারের এই সবুজ চত্বর।


সর্বশেষ সংবাদ