এখতিয়ার বহির্ভূত নিয়োগের অভিযোগ খুবির প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপকের বিরুদ্ধে

অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম ও খুবি লোগো
অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম ও খুবি লোগো  © সংগৃহীত

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও আর্থিক বিষয়ের রুটিন দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, বদলি করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসির জন্য বরাদ্দকৃত গাড়ি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার, রেজিস্ট্রার, প্রভোস্ট ও ছাত্রবিষয়ক পরিচালকের দপ্তরে নিয়োগসহ একাধিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিচালনা, শিক্ষার্থীদের খাবার নিশ্চিত করার জন্য এসব নিয়োগ দিয়েছেন বলে দাবি ড. রেজাউল করিমের। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, রুটিন দায়িত্ব পালনের সময় নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। এমনকি ভিসি কিংবা প্রো-ভিসির গাড়িও ব্যবহার করা যাবে না।

‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছিল, আর্থিক ও প্রশাসনিক বিষয়গুলোর রুটিন দায়িত্ব পালন করা যাবে। রুটিন দায়িত্ব পালনকালীন নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এগুলো করা যাবে না। এমনকি ভিসি, প্রো-ভিসির গাড়িও ব্যবহার করা যাবে না। এগুলো নিয়ম বহির্ভূত কাজ—ড. শেখ আব্দুর রশীদ, সিনিয়র সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি ও রেজিস্ট্রার পদত্যাগ করেন। এ অবস্থায় অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে খুবি। পরবর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রশাসনিক এবং আর্থিক বিষয়গুলো সচল রাখতে সিনিয়র হিসেবে অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম দায়িত্ব পালন করেন। এরপর গত ৫ সেপ্টেম্বর তিনি ড. এস এম মাহবুবুর রহমানকে রেজিস্ট্রারের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেন। যদিও শুধু রাষ্ট্রপতি নিয়োগকৃত ভিসিই রেজিস্ট্রার নিয়োগ দিতে পারেন।

অভিযোগ উঠেছে, ড. এস এম মাহবুবুর রহমানকে রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব দেওয়ার পরপরই অন্তত তিনটি পদে নিয়োগ দেন ড. রেজাউল করিম। এসবের মধ্যে রয়েছে- হল প্রভোস্ট, সহকারী ছাত্র পরিচালক ও আয়া। এমনকি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলির প্রক্রিয়াও শুরু করেন। যদিও এ বিষয়গুলো তার এখতিয়ার বহির্ভূত বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছিল, আর্থিক ও প্রশাসনিক বিষয়গুলোর রুটিন দায়িত্ব পালন করা যাবে। রুটিন দায়িত্ব পালনকালীন নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এগুলো করা যাবে না। এমনকি ভিসি, প্রো-ভিসির গাড়িও ব্যবহার করা যাবে না। এগুলো নিয়ম বহির্ভূত কাজ বলেও জানান তিনি।’

রেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে জারিকৃত এক অফিস আদেশ থেকে জানা যায়, ড. রেজাউল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকাস্থ গেস্ট হাউজে অস্থায়ী ভিত্তিতে মোসা. শারমিন হোসেনকে মাসিক ১৩ হাজার ৫০০ টাকা ভাতায় নিয়োগ দিয়েছেন ৷ নিয়োগটি  ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে বলে উল্লেখ আছে। এর আগে ৫ সেপ্টেম্বর এক অফিস আদেশে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস এম মাহবুবুর রহমানকে রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়৷ এসব নিয়োগসংক্রান্ত ডকুমেন্ট দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে এসেছে। 

বিধি মোতাবেক, এ ধরনের নিয়োগ তার এখতিয়ার বহির্ভূত। নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি শুধুমাত্র সরকার কর্তৃক মনোনীত উপাচার্যই দিতে পারেন। সরকার এখনো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেননি। 

‘আমি রুটিন দায়িত্ব পালন করলে এ ধরনের কাজ করতাম না। কেননা রুটিন দায়িত্ব পালনকালীন এ বিষয়গুলো এখতিয়ার বহির্ভূত’—অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ, চেয়ারম্যান, ইউজিসি

ডিন ও প্রধানদের সভা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ড. রেজাউল করিমকে প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন ও ছুটিসহ কিছু রুটিন দায়িত্বভার দেওয়া হয় ৷ স্বাভাবিকভাবেই কোনো ধরনের নিয়োগ, বদলি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পলিসি পর্যায়ের কাজ বাস্তবায়নের এখতিয়ার তার নেই।

জানা গেছে, নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগের পাশাপাশি ভিসি ও প্রো-ভিসির গাড়িও ব্যবহার করেন ড. রেজাউল। পরিবহন দপ্তর জানায়, সম্প্রতি প্রো-ভিসির জন্য বরাদ্দকৃত গাড়ি নিয়ে ঢাকা ঘুরে এসেছেন রুটিন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা ৷ নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, ড. রেজাউল করিম কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে গত ৯ সেপ্টেম্বর অফিস আদেশের মাধ্যমে বিভিন্ন দপ্তরে বদলি করেছেন ৷ অফিস আদেশে আল্টিমেটাম দিয়ে জানানো হয়, ‘তিন দিনের মধ্যে বদলীকৃত কর্মস্থলে যোগদান না করলে, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বর্তমান কর্মস্থল থেকে বিমুক্ত বলে গণ্য হবেন।’

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জারিকৃত অফিস আদেশ হতে জানা যায়, রেজিস্ট্রার ছাড়াও ছাত্রবিষয়ক পরিচালকের দপ্তরের পদগুলোতেও নিয়োগ দিয়েছেন। তার সাথে কয়েকজন শিক্ষক কয়েকটি আবাসিক হলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে প্রোভোস্ট পরিচয় দিয়েছেন। যদিও এ সংক্রান্ত কোন অফিসিয়াল আদেশ বা নোটিশ জারি করা হয়নি।

এ বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. এটিএম জহিরউদ্দিন বলেন, রেজাউল স্যার এমন কাজ না করলেই ভালো হতো। আর অতীতের কোন অভিযোগ নিয়ে বক্তব্য দিতে আমি বিব্রতবোধ করছি।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ড. রেজাউল করিম এখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালের উপাচার্য হাওয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। এসব গুরুতর অভিযোগ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের আবেগকে ব্যবহার করতে তিনি নানান অনৈতিক আশ্বাস ও কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ আছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘সবগুলো নিয়োগই অস্থায়ী ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে। গেস্ট হাউজে আয়া না থাকায় ময়লা হয়েছিল। সেজন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে এ নিয়োগ সাবেক উপাচার্য দিয়ে গেছেন বলে দাবি করেছেন তিনি। যদিও খুবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন জানিয়েছেন, 'গত ২০ আগস্ট আমি পদত্যাগ করেছি। আমি আয়া নিয়োগ দেইনি। আয়া নিয়োগ হয়েছে আমার পদত্যাগের পর। ড. রেজাউলের দাবি ভিত্তিহীন।'

প্রো-ভিসির গাড়ি ব্যবহার করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে ডেকেছিল। আমি নিজের গাড়ি নিয়েই ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়েছিলাম। তবে গাড়িটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ায় প্রো-ভিসির গাড়ি নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলাম। এছাড়া প্রভোস্ট না থাকায় শিক্ষার্থীরা হলে ঠিকভাবে খাবার পাচ্ছিলেন না। সেজন্য একজনকে রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।'

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি রুটিন দায়িত্ব পালন করলে এ ধরনের কাজ করতাম না। কেননা রুটিন দায়িত্ব পালনকালীন এ বিষয়গুলো এখতিয়ার বহির্ভূত।’


সর্বশেষ সংবাদ