তিতুমীর কলেজের ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ছাত্রলীগের জায়েদের
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪১ PM , আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:০১ PM
রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন রেজায়ে রাব্বী জায়েদ নামের এক ছাত্রলীগ কর্মী। জায়েদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ পরিচয়ে হুমকি এবং নারী হেনস্থার নানান গুরুতর অভিযোগ থাকলেও বর্তমানে তিনি কলেজের বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ নানা জায়গায় অযাচিত হস্তক্ষেপ করছেন।
জানা গেছে, কলেজের প্রথম বর্ষে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হয়ে জায়েদ যোগ দেয় তিতুমীর কলেজ শাখা ছাত্রলীগে। সক্রিয় ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ছাত্রলীগের মিডিয়া উইং হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। তিতুমীর কলেজের নানা ফেসবুক গ্রুপ ও মেসেঞ্জার গ্রুপে ছাত্রলীগের প্রচারণাই ছিল তার কাজ। ছাত্রলীগের এই প্রভাবকে পুঁজি করে অপরাধ করেও পার পেয়েছেন বহুবার।
এছাড়াও জায়েদ তার নিজ বিভাগের এক নারী সহপাঠীর সাথে ব্যক্তিগত ঝামেলায় জড়িয়ে মেসেঞ্জার গ্রুপে বিরূপ মন্তব্য করেন। সম্প্রতি তার এসব মন্তব্য সংক্রান্ত বিভিন্ন স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও পরবর্তীতে গ্রুপগুলো থেকে তা সরিয়ে নেয়া হয়।
এ বিষয়ে ওই নারী শিক্ষার্থী মুঠোফোনে জানিয়েছেন, আমি এ বিষয়ে তখন সিনিয়রদের জানিয়েও কোন সমাধান পাইনি।
আরও পড়ুন: হেলপারের কাছে মাফ চাইলেন সহ-সমন্বয়ক পরিচয় দেওয়া জবির সেই শিক্ষার্থী
নারীদের হেনস্তা ছাড়াও জায়েদ বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের হুমকি প্রদান করতেন বিভিন্ন ইস্যুতে। এর মধ্যে কলেজের একটি অনুষ্ঠানে একজন ক্যাম্পাস প্রতিনিধি তার নির্দেশনা মতে ছবি না তোলায় চড়াও হন জায়েদ।
সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে ভুক্তভোগী ওই সাংবাদিক বলেন, আমি সেই সময় ক্যাম্পাস রিপোর্টার ছিলাম। ক্যাম্পাসের খবরাখবর গণমাধ্যমে তুলে ধরাই ছিল আমার কাজ। দায়িত্ব পালনকালে ছবি তুলে দিতে না চাওয়ায় জায়েদ আমাকে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করে। তিতুমীর কলেজ সাংবাদিক সমিতি নিয়ে কটূক্তি করে। এক পর্যায়ে মারতে আসেন এবং নিজেকে ছাত্রলীগ নেতা দাবি করে মারার হুমকি দেন।
চলতি বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর তিতুমীর কলেজের হলগুলো থেকেও পালিয়ে যায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এরপর তিতুমীর কলেজের ছাত্রীনিবাসে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন জায়েদ।
এর মধ্যে ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত থাকার কারণে হালিমা নামের এক মেয়েকে সুফিয়া কামাল ছাত্রীনিবাসে না রাখার সিদ্ধান্ত নেয় হল কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তখন জায়েদ সেখানে হস্তক্ষেপের করার চেষ্টা করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হলটির এক নারী শিক্ষার্থী জানান, ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত সেই মেয়েকে হলে রাখার জন্য জায়েদ সুপারিশ করেন, সুফিয়া কামাল ছাত্রীনিবাসের অন্য আরেক শিক্ষার্থীর কাছে। তবে তার এই সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি। শিক্ষার্থীরা জানান, হলে কে থাকবে না থাকবে তা সিদ্ধান্ত নিবে হল কর্তৃপক্ষ ও হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এখানে জায়েদ হস্তক্ষেপ করার কে?
আরও পড়ুন: উপাচার্য নিয়োগে কদর পশ্চিমা ডিগ্রি-গবেষণায়, রাজনৈতিক সক্রিয়রা বাদ
এছাড়াও অন্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বনলতা বিউটিকে পুলিশে দেওয়া নিয়েও এক নারী সমন্বয়কের ঝামেলায় জড়ান জায়েদ। ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বনলতা বিউটি যেই অপরাধ করেছে তার প্রেক্ষিতে নারী সমন্বয়ক আফিয়া অর্ণি তাকে পুলিশে দিতে চান। তবে জায়েদ মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায়, এক পর্যায়ে জায়েদ আফিয়া অর্ণিকে রাগান্বিত হয়ে ধমক দেয়।
এই বিষয়ে সমন্বয়ক আফিয়া অর্ণি বলেন, আমি নিজেও একজন সমন্বয়ক। উনি আমার সাথে এই আচরণ কেন করলো জানি না।
আফিয়া অর্ণি বলেন, আমি একজন সমন্বয়ক হওয়ার আগে একজন সাধারণ শিক্ষার্থী। সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমি আমার ক্যাম্পাসে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব চাই না। যারা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন করেছেন, তারা কোনো দলের হওয়ার আগে একজন শিক্ষার্থী।
জায়েদ প্রসঙ্গে কলেজের সহ-সমন্বয়ক মো. রাশেদুজ্জামান জানান, আমি নিজেও একজন সহ-সমন্বয়ক। কখনো এ পরিচয় বহন করিনি। কেননা তাদের কার্যকলাপের সাথে কোনো প্রকার মিল দিতে পারছি না। একা একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। বিশেষ করে এই জায়েদ, তাকে নিয়ে এর আগেও সমন্বয়ক গ্রুপে কথা হয়েছে। যেমন: হলের নাম পরিবর্তন, সেটা জায়েদ একা করার কে? এটা নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলাম গ্রুপে। সেটার উত্তর আজ পর্যন্ত পাইনি। এদিকে সে একা একা নানান কুকর্ম করেই চলছে।
এদিকে একাধিক অভিযোগের বিষয়ে জায়েদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়েছে। নারী সহপাঠীকে কটূক্তির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি জানান, এই ঘটনাটি ২০১৯ সালের। এখন কেউ উদ্দেশ্যেপ্রণোদিতভাবে সেটাকে সামনে আনার চেষ্টা করছে। আমি আমার বান্ধবীকে তুই তোকারি করে বলেছি মাত্র এবং সেটার জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।
রাজনৈতিক পরিচয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি এখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হইনি। বরং আমাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলের ট্যাগ দিয়ে হুমকি এবং হামলা করা হয়েছে। ক্যাম্পাসের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জায়েদ বলেন, ছাত্রদল যেন ক্যাম্পাসে মিছিল-শোডাউন না করে সে বিষয়ে আমরা তাদের সাথে কথা বলেছি।
তিতুমীর কলেজ সাংবাদিক সমিতিকে নিয়ে করা মন্তব্যের বিষয়ে তিনি দাবি করেন, সাংবাদিক সমিতিকে আমি পকেটে রাখি এমন কোনো মন্তব্য করেছি বলে মনে হয় না। সমিতি ছাত্রলীগ থাকাকালীনও তাদের বিরুদ্ধে নিউজ করেছিল।
এদিকে জায়েদ কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত নয় জানালেও অতীতে যেমন ছাত্রলীগের পরিচয় দিয়েছেন, বর্তমানে নিজ সুবিধার্থে বিএনপির পরিচয় দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন একাধিক শিক্ষার্থী।
একাধিক অভিযোগকারী বলেন, তিতুমীর কলেজে অনেক সমন্বয়কেরই একটি রাজনৈতিক আদর্শ আছে। তবে সেটি অন্যায় না। অন্যায় হচ্ছে রাজনৈতিক পরিচয়ে সমন্বয়কদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করা। আর জায়েদ সেই প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছেন বহুবার। অভিযোগ থাকলেও প্রভাব বিস্তারের কারণে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন: মুখে মুখে আদেশ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত দেন অধ্যাপক আলমগীর
তিতুমীর কলেজের বেশ কয়েকটি ক্লাবের দায়িত্বশীলরা জানান, এই ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের অরাজকতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করা হলে, আমরা তা কোনোভাবেই সহ্য করব না। শিক্ষা এবং সুশৃঙ্খল পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজন হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা সকলকে আহ্বান জানাই, কলেজের সুনাম ও শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখতে সকলেই দায়িত্বশীল আচরণ করুন।
বিভিন্ন স্ক্রিনশট ফাঁস ও জায়েদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিষয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিতুমীর কলেজ সমন্বয়ক নীরব হাসান সুজন বলেন, জায়েদের ব্যাপারে ভাইরাল হওয়া স্ক্রিনশটগুলো আমি দেখেছি। ব্যাপারটা আমরা খতিয়ে দেখছি। তাছাড়া আমরা কোনো উগ্র আচরণ বা সহিংসতাকে সমর্থন করিনা। যদি সেরকম কোন ঘটনা ঘটে থাকে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিব।
কোন সমন্বয়ক রাজনৈতিক পরিচয়কে ব্যবহার করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না—জানতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক সমন্বয়কের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।