বায়োচার প্রযুক্তিতে পবিপ্রবি গবেষকের অভাবনীয় সাফল্য

প্রফেসর ড. শামীম মিয়া
প্রফেসর ড. শামীম মিয়া  © টিডিসি ফটো

ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ু। ফলে পৃথিবী আক্রান্ত হচ্ছে সাইক্লোন, বন্যা, খরা অথবা লবণাক্ততার মতো নানা দুর্যোগে। আর এ দুর্যোগের অন্যতম নিয়ামক মনুষ্যসৃষ্ট গ্রীনহাউস গ্যাস। গ্রীনহাউস গ্যাস তাপ ধরে রাখার কারনে পৃথিবীতে আপতিত সূর্যরশ্মি যে তাপ উৎপন্ন করে তা পৃথিবীর বাইরে যেতে পারে না। ফলে তৈরি হয় বৈশ্বিক উষ্ণতা। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের এই সমস্যা প্রতিরোধ করতেই কৃষিতে এক বৈপ্লবিক সংযোজন বায়োচার প্রযুক্তি। যেটি গুণগত কৃষি চাষ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য এক অপার সম্ভাবনার হাতছানি। 

পবিপ্রবি'র কৃষিতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. শামীম মিয়া তিন বছর দীর্ঘ গবেষণার পর ২০১৪ সালে বায়োচার প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সক্ষম হন। তিনি সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ও পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদে পিএইচডি গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বর্তমানে বায়োচার প্রযুক্তির উন্নয়নে বেশ কয়েকজন স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি শিক্ষার্থী নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।

আরও পড়ুন: ৫ দিনের রিমান্ডে ফারদিনের বান্ধবী বুশরা

ইতোমধ্যে বায়োচার প্রযুক্তি নিয়ে এডভান্স কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (এসিআই) ও পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। পবিপ্রবি’র উপাচার্য প্রফেসর ড. স্বদেশ চন্দ্র সামন্ত’র উপস্থিতিতে এসিআই ফার্টিলাইজারের বিজনেস ডিরেক্টর বশির আহমেদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম এই প্রযুক্তি বিনিময় স্মারকে স্বাক্ষর করেন। 

এই সমঝোতা স্মারকের অধীনে, পবিপ্রবি বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য এসিআই ফার্টিলাইজারকে বায়োচার উৎপাদন প্রযুক্তি হস্তান্তর করবে। এসিআই বায়োচার সমৃদ্ধ সার উৎপাদনের জন্য তাদের কারখানায় প্রবেশাধিকার প্রদান করবে এবং তাদের নিজস্ব গবেষণা ও উন্নয়ন ক্ষেত্রে এবং কৃষকদের মাঠে প্রদর্শনী স্থাপন করবে। এছাড়াও, বায়োচার সমৃদ্ধ সার প্রযুক্তি এসিআই’র নিকট হস্তান্তর করবে। এসিআই দেশের কৃষকদের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের জন্য বায়োচার সমৃদ্ধ সার প্রযুক্তি গ্রহণ করবে।

বর্তমানে প্রফেসর ড. শামীম মিয়ার তত্ত্বাবধানে জৈব বর্জ্য থেকে বায়োচার উৎপাদন এবং সেই বায়োচার কম্পোস্ট বায়োমাসের সাথে মিশিয়ে উন্নত মানের কম্পোস্ট সার উৎপাদনের  প্রক্রিয়া চলমান আছে। এ গবেষণায় সফল হলে দেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও উৎপন্ন বর্জ্যের কার্যকর ব্যাবহার নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি এ প্রকল্পের আওতায় বায়োচার সমৃদ্ধ ফসফেট সার উৎপাদন, বায়োচার থেকে রাইজোবিয়াল ফার্টিলাইজার বা বায়োচার অণুজীব সার উৎপাদন প্রক্রিয়া গবেষণাধীন রয়েছে। যেগুলো আমাদের মতো কৃষি নির্ভর দেশের জন্য এক অপার সম্ভাবনার হাতছানি। কৃষি প্রযুক্তি ও গুণগত উন্নয়নে বায়োচার আগামীতে অনন্য ভূমিকায় থাকবে বলে আশা করছেন অনেকে।

প্রসঙ্গত, গ্রীনহাউস গ্যাসের অন্যতম উপাদান কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, গাছ বায়ুমণ্ডল থেকে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে একটা নির্দিষ্ট সময় পর তার সমপরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ শুধু গাছ লাগানোই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সমাধান নয়। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ গবেষণায় বিকল্প একটি প্রস্তাব করা হয়। এতে বলা হয়, বায়ুমণ্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড প্রথমে গাছের মধ্যে  নিয়ে আসা এবং সেই কার্বনকে পাইরোলাইসিস প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করে মাটিতে প্রয়োগ করা। পাইরোলাইসিস প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত এই কার্বনকে বলা হয় বায়োচার।

বায়োচার হলো বিভিন্ন জৈব পদার্থ যেমন কাঠ, কাঠের গুঁড়া, জৈব আবর্জনা ইত্যাদিকে অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদিত এক ধরনের কয়লা। অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে তাপ প্রয়োগের ফলে জৈব পদার্থ গুলো সরল অ্যারোমেটিক বেনজিনযুক্ত জৈব যৌগে পরিণত হয়। যেহেতু মাটির অণুজীবগুলো অ্যারোমেটিক বেনজিনযুক্ত জৈবযৌগ গুলোকে সহজে ভাঙতে পারে না, তাই বায়োচার মাটিতে প্রয়োগ করলে এটি দীর্ঘ সময় (প্রায় ১০০ বছর বা তার অধিক) পর্যন্ত মাটিতে থেকে যায়। যা সাধারণত কার্বন স্থায়ীত্বকরন নামে পরিচিত। অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলের কার্বনকে দীর্ঘ সময়ের জন্য মাটিতে স্থায়ীকরন করে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তন রোধের জন্য যতগুলো প্রযুক্তি আছে, সম্ভবত এটিই সবচেয়ে সহজ ও টেকসই প্রযুক্তি। কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ রোধের পাশাপাশি ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্লটে বায়োচার সমৃদ্ধ নাইট্রোজেন সার নিয়ে গবেষণা চালানো হয়েছে এবং মিনারালাইজেসন স্টাডি করা হচ্ছে। এ গবেষণাও অনেকাংশে সফল। সেখানে দেখা গিয়েছে, সাধারণ ইউরিয়া সারের তুলনায় বায়োচার সমৃদ্ধ নাইট্রোজেন সার ১৫-২০% বেশী কার্যকর। বস্তুত, আমাদের দেশে ফসলে যে নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করা হয় তার ৭০ ভাগই বায়ু ও পরিবেশের মাধ্যমে সিস্টেম লস হয়। একই সাথে সরকার প্রতিবছর ইউরিয়া সারে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। বায়োচার সমৃদ্ধ এই নাইট্রোজেন সার ব্যবহারে যেমন আমাদের এই অর্থনৈতিক চাপ কমবে একই সাথে আমদানি নির্ভরতাও অনেকাংশে হ্রাস পাবে।