গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ
- গবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২৪, ১২:৪৩ PM , আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০২৪, ০১:০৩ PM
গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) সাবেক রেজিস্ট্রার এস তাসাদ্দেক আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন ২০২০ সালে। তার পর থেকেই অনিয়ম জালিয়াতি করাকে নিয়মে পরিণত করেছিলেন যিনি। ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি দেখিয়ে চাকরিতে বসেই শুরু করেছিলেন নানা ধরনের নৈরাজ্য। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) এই সাবেক রেজিস্ট্রার।
তাসাদ্দেক আহমেদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ, যোগদানের পর থেকেই নানা তুচ্ছ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অনেককেই চাকরিচ্যুত করতে ভূমিকা রেখেছেন তাসাদ্দেক আহমেদ। এরপর সে সব পদে নিয়োগ দিয়েছেন নিজের লোকদের।
আরও অভিযোগ রয়েছে, তার রোষানলে পড়ে চাকরি হারিয়েছেন অধ্যাপক, সহ অধ্যাপক, সিনিয়র প্রভাষক, প্রভাষক, সহকারী প্রভাষকসহ প্রায় ১৭ শিক্ষক। এছাড়াও প্রশাসনিক কর্মকর্তা, লাইব্রেরিয়ান, সিকিউরিটি গার্ড, ক্লিনার ইনচার্জ, ড্রাইভারসহ বিভিন্ন পদে থাকা প্রায় ২১ জন কর্মকর্তা চাকরি হারিয়েছেন তার কারণে।
আরও পড়ুন: ডা. জাফরুল্লাহ’র মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় দখল গণস্বাস্থ্যের মেডিক্যাল কলেজ
তাসাদ্দেক আহমেদের ভূমিকায় চাকরি হারিয়েছেন দাবি করে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ক্যাপ্টেন ড. জিয়াউল আহসান বলেন, ‘‘আমার নিয়োগের সময় পদার্থ ও রসায়ন বিভাগ একত্রে থাকলেও অবৈধ সুযোগ গ্রহণের জন্য রেজিস্ট্রারের তত্ত্বাবধানে দুটো বিভাগে অর্থাৎ রসায়ন বিভাগ ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ বিভক্ত করা হয়।’’
তিনি বলেন, ‘‘আমি ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হতে ৩ বছরের জন্য পদার্থ ও রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান পদে যোগ দান করি। নিয়োগপত্রের ২য় শর্তে বলা হয়েছিল চুক্তির মেয়াদকালের মধ্যে নিজ উদ্যোগে চাকরির মেয়াদ নবায়ন করে নিবেন।
তিনি আরও বলেন, এ ব্যাপারে দেড় মাস পূর্বেই সাবেক রেজিস্ট্রারের সাথে যোগাযোগ করি। তিনি তখন বলেন মেয়াদ শেষ হওয়ার একসপ্তাহ পূর্বে নবায়নের আবেদন করলেই হবে এবং ২০২৩ সালের ২২ ডিসেম্বর (১ মাস ৮ দিন পূর্বে) নবায়নের জন্য আবেদন করি। অথচ চুক্তির শেষ সময়ের একদিন পূর্বে রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত এক নোটিশের মাধ্যমে জানানো হয়—আমার নিয়োগ নবায়ন করা হয়নি অথচ আমার চাকরির বয়সসীমা এখনো রয়েছে।’’
জিয়াউল আহসান বলেন, ‘‘নোটিশে উল্লেখ করা হয় বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তি কমে গেছে এবং এ ব্যাপারে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে আমার উদ্যোগ দেখা যায়নি। আমার নিয়োগপত্রের কোথাও শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর ব্যাপারে কোনো কথা উল্লেখ ছিল না। চুক্তি অনুযায়ী তিন মাসের বেতনও প্রদান করা হয়নি। এ ব্যাপারে আমি বারবার ভিসি স্যারের সাথে যোগাযোগ করলেও তিনি ট্রাস্টি বোর্ডের দোহাই দিয়ে কোনো কিছুই জানাননি।’’
রেজিস্ট্রারের কারণে বদলির শিকার হওয়ার পর চাকরি ছেড়ে দেওয়া এক নিরাপত্তা কর্মী বলেন, ‘‘২০১৬ সাল থেকে আমি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা কর্মী, মাঠকর্মী, দাফতরিক বিজ্ঞপ্তি লাগানো ও প্রচার, চিঠি আদান-প্রদানসহ বিভিন্ন কাজ করেছি। ১৮ অক্টোবর ২০২১ এ হঠাৎ রেজিস্ট্রার তাসাদ্দেক স্যার আমাকে একটি চিঠি দিয়ে বলেন গণস্বাস্থ্যে চিঠি নিয়ে যেতে এবং এক কপি নিজে নিয়ে যেতে।
তিনি বলেন, গণস্বাস্থ্যে যাওয়ার পর আমাকে বলা হয় কেন আমাকে বদলি করে দেওয়া হলো। আমি তখনও বুঝতে পারিনি কার বদলির কথা বলছে কারণ চিঠি আমি খুলে দেখিনি। কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে বদলি করা হবে ভাবিনি। পরে আমাকে জানানো হয় চিঠিতে বদলির কথা উল্লেখ করা। তখন আমি তাকে জানাই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিকিউরিটি সুপারভাইজার হিসেবে ছিলাম। কিন্তু দরখাস্তে নিরাপত্তা কর্মী উল্লেখ থাকায় আমাকে বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই পদবি নিয়ে আসার জন্য।’’
ওই নিরাপত্তাকর্মী অভিযোগ করে বলেন, রেজিস্ট্রার স্যারের কাছে বদলির আদেশ বাতিল করার জন্য দরখাস্ত করেছিলাম তা প্রত্যাখান করে এবং আমি স্যারকে হাতেপায়ে ধরে অনুরোধও করেছিলাম বদলি না করার জন্য। পরবর্তীতে আমি বাধ্য হয়ে ২০২১ সালের ১ নভেম্বর চাকরি ছেড়ে দিই।
২০ বছর ধরে প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে ২০ বছর চাকরি করেছি এবং এর আগে ৩ বছর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সহকর্মী হিসেবে ছিলাম। হঠাৎ ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি সাবেক রেজিস্ট্রার এস তাসাদ্দেক আহমেদ স্বাক্ষরিত এক দরখাস্তে আমাকে জানানো হয় চাকরির অবসর প্রসঙ্গে এবং তা কার্যকর হয় ১ ফেব্রুয়ারি হতে।
তিনি জানান, ‘‘আমার কোনো অপরাধ ছিল না। দরখাস্তে আমাকে জানানো হয় ৭২ বছর পূর্ণ হওয়ায় চাকরিতে রাখা যাবে না। কিন্তু আমার মতোই বয়স্ক সিনিয়র শিক্ষক ও কর্মকর্তা এখনও কাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি (রেজিস্ট্রার) যখনই কাউকে সরাতে চাইতেন, তার বিরুদ্ধে নানা প্রোপাগান্ডা ছড়াতেন। একজন সরালে ২ জন আত্মীয় আনতে পারতেন। আরও অনেক চাকরিজীবীকে তিনি কোনো অভিযোগ ছাড়াই চাকরিচ্যুত করে এবং তার আত্মীয়-স্বজনদের মোটা অর্থের বিনিময়ে বেআইনিভাবে নিয়োগ দিয়েছেন।’’
অভিযোগের বিষয়ে এস তাসাদ্দেক আহমেদ বলেন, ‘‘রেজিস্ট্রার অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রধান, নিয়োগের ব্যাপারে আমার কোনো ক্ষমতাই নাই। তাহলে কীভাবে কাউকে চাকুরি দেওয়া বা চাকরিচ্যুত করার দায় আমার হতে পারে! নিয়োগের ক্ষেত্রে ট্রাস্টির তিনজনসহ ভিসিও থাকেন। উনারা অ্যাপ্রুভ করার পরে আমি কাগজে সই দিতে পারি। এতটুকুই আমার দায়িত্ব। আর ট্রাস্টিবোর্ডের নির্দেশ ছাড়া কখনোই কোনো নিয়োগ বা বাতিলের এখতিয়ার রেজিস্ট্রার রাখে না। ব্যাপারটা অবান্তর।’’
২০২০ সালের ১২ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেয় এস তাসাদ্দেক আহমেদকে। ওই নিয়োগপত্রে তার নামের আগে 'ডক্টর' লেখা দেখা যায়। তবে পরবর্তীতে জানা যায়, ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি দেখিয়ে চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। ভুয়া ডিগ্রির অভিযোগ ক্রমশ ছড়িয়ে যাওয়ায় নামের আগে ড. লেখা বন্ধ করেন ও ইউজিসির ওয়েবসাইটেও তার নামের আগে ড. পদবি মুছে ফেলা হয়।