আইন শিক্ষা উন্মুক্ত কলেজে, শর্তে আটকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বার কাউন্সিলের লোগো
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বার কাউন্সিলের লোগো  © টিডিসি ছবি

দেশের সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে মানতে হয় বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের বেঁধে দেওয়া নিয়ম। আইনজীবীদের সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও নিয়ন্ত্রক এই সংস্থার সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতি সেশনে ৫০ জনের অধিক শিক্ষার্থী এলএলবি (স্নাতক) কোর্সে ভর্তি নেওয়ার সুযোগ নেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তবে তার বিপরীত চিত্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা সরকারি ও বেসরকারি আইন কলেজসমূহের আসন নির্ধারণের ক্ষেত্রে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বার কাউন্সিল থেকে কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই এসব কলেজে এলএলবি (পাস) কোর্সে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে। জানা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা সারাদেশে ৭০টিরও অধিক সরকারি-বেসরকারি কলেজ রয়েছে। এসবের মধ্যে কিছু কলেজে ভর্তির জন্য আবেদনকারী সব শিক্ষার্থীকেই ভর্তি নেওয়া হয়ে থাকে বলে জানা গেছে। 

আসন বেঁধে দেয়ার বিষয়ে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনা থাকলে আমার কিছু বলার নেই। তবে বার কাউন্সিল দ্বারা আসন নির্ধারণ করা হলে আমি বলব, স্বল্প আয়ে ভালো শিক্ষক দ্বারা পাঠদান করানো অসম্ভব ব্যাপার-অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী

অন্যদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে ট্রাই সেমিস্টার (তিন সেমিস্টার) থাকা অবস্থায় ১৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম চালিয়ে আসলেও সম্প্রতি বাই সেমিস্টার (দুই সেমিস্টার) চালু হওয়ার পর চাপে পড়ে এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ফলে প্রতি বছর ১০০ শিক্ষার্থী (এক সেমিস্টারে ৫০ করে) ভর্তি করানোর সুযোগ পাচ্ছে শিক্ষার্থীদের টাকায় চালিত এসব বিশ্ববিদ্যালয়। 

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে শিক্ষার্থী ভর্তির এই নির্দেশনা থাকলে তাদের করার কিছু থাকে না। তবে কম শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে ভালো শিক্ষক দ্বারা পাঠদান করানো অসম্ভব ব্যাপার হয়ে পড়ছে। তাদের মতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের থেকে আদায় করা টিউশন ফি'র টাকা দিয়েই চলে। কিন্তু দুই সেমিস্টারের কারণে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ায় তারা এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ওপর আইন বিভাগে সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়া তাদের জন্য বাড়তি চাপ বলে মনে করছে।

রাজশাহী আইন কলেজ

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত দু’শত আসনে ভর্তি নিতে পারবে ঢাকার ক্যাপিটাল ল কলেজ। তবে আসন পূর্ণ না হওয়ায় ভর্তি ফরম পূরণ করা সকলেই হতে পারে এই কলেজের আইনের শিক্ষার্থী। কলেজের উপাধ্যক্ষ এড. আকবর হোসেন জুয়েল বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আমাদেরকে দু’শত শিক্ষার্থী ভর্তি নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে। দু’শত আবেদন না পড়লে আসন ফাঁকা রেখেই ফরম পূরণ করা সব শিক্ষার্থীকে নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়৷ 

আইন কলেজে পড়ুয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা আইন কলেজে আসন রয়েছে একশ থেকে শুরু করে পাঁচ শতাধিক পর্যন্ত। নোয়াখালী আইন কলেজের এক শিক্ষার্থী জানান, তার সেশনে এই কলেজে রয়েছে শতাধিক শিক্ষার্থী। শুধুমাত্র পরীক্ষার সময়ই এসব শিক্ষার্থীকে কলেজে দেখা যায় বলে জানান। 

কুমিল্লা আইন কলেজের এক শিক্ষার্থী জানান, তার সেশনে এই কলেজে পাঁচশত শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ কারো মাধ্যমে ভর্তি ফরম প্রেরণ করেই হয়েছেন এই কলেজের আইনের শিক্ষার্থী। এর জন্য বসতে হয়নি কোন ভর্তি পরীক্ষায়। 

অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী

এছাড়া ক্লাসে অংশ না নিয়েও শুধুমাত্র পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে পাস করলেই মিলছে এসব আইন কলেজ শিক্ষার্থীদের আইনের সনদ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আইন কলেজে পড়ে সনদপ্রাপ্ত একাধিক শিক্ষার্থী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। 

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনক্রমে সেশনে পাঁচশত এবং ছয়শত শিক্ষার্থী ভর্তি নেয় যথাক্রমে বঙ্গবন্ধু আইন কলেজ এবং সেন্ট্রাল ল কলেজ। সর্বশেষ ব্যাচেও ছয়শত শিক্ষার্থী ভর্তি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সেন্ট্রাল ল কলেজ কর্তৃপক্ষ। তারা জানিয়েছে, এবারও আবেদন পাওয়া গেলে এই পরিমাণ শিক্ষার্থী ভর্তি নেওয়া হবে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু ল কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিবছর নির্ধারিত আসন অনুযায়ী পাঁচ শত শিক্ষার্থী ভর্তি নেয় এই কলেজ। 

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছরের এলএলবি (পাস) কোর্স বন্ধ করে দেয়া হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এই কোর্স এখনো চালু রয়েছে। এ বিষয়টিকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি’র উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী।

তিনি বলেন, আসন বেঁধে দেয়ার বিষয়ে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনা থাকলে আমার কিছু বলার নেই। তবে বার কাউন্সিল দ্বারা আসন নির্ধারণ করা হলে আমি বলব, স্বল্প আয়ে ভালো শিক্ষক দ্বারা পাঠদান করানো অসম্ভব ব্যাপার। 

কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে ৫০ জনের অধিক শিক্ষার্থী ভর্তি করানো যাবে না। যদি করা হয় তাহলে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটবে-আবুল বাতেন, চেয়ারম্যান, বার কাউন্সিলের লিগ্যাল এডুকেশন কমিটি

তিনি আরও বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষকদের দ্বারা মান সম্মত আইন শিক্ষা প্রদান করা হয়। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সবধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকি। উপযুক্ত উপায়ে পরীক্ষা নেয়া হয়, এতে অসদুপায় অবলম্বনেরও কোন সুযোগ নেই শিক্ষার্থীদের। আমাদের ২৩ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক রয়েছেন। 

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক এম লুৎফর রহমান বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের থেকে আদায় করা টিউশন ফি'র টাকা দিয়েই চলে। কিন্তু ডুয়াল সেমিস্টারের কারণে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ায় আমরা এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এর ওপর আইন বিভাগে সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়া আমাদের জন্য বাড়তি চাপ।

তার প্রস্তাব, ৭৫ জন করে দুই সেমিস্টারে ১৫০ জন শিক্ষার্থী হলে এ সমস্যা থাকে না। আবার স্থায়ী ক্যাম্পাসে ফেরার কারণেও শিক্ষার্থী পাওয়া নিয়ে একটু চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। উপাচার্য বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। আশা করি সুরাহা হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিল বলছে, আইন শিক্ষা একটি সুশৃঙ্খল ধারায় রাখতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন সীমিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে বার কাউন্সিলের লিগ্যাল এডুকেশন কমিটির চেয়ারম্যান আবুল বাতেন বলেন, কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে ৫০ জনের অধিক শিক্ষার্থী ভর্তি করানো যাবে না। যদি করা হয় তাহলে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটবে। 

এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে আইনে নির্ধারিত আসনের বেশি ভর্তি নেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বার কাউন্সিল আসন সংখ্যা নির্ধারণের বিষয়ে এই ছাড়পত্র দিয়ে থাকে। আইন কলেজে আসন নির্ধারণে কোন অনুমতি নিতে হয় না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে সেটি বিবেচনা করা হবে৷


সর্বশেষ সংবাদ