বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: স্বদেশে পরবাসী বাংলা

ইউজিসি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
ইউজিসি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ফটো

ইতিহাসে ভাষার জন্য জীবন দেয়ার অনন্য নজির সৃষ্টির কৃতিত্ব একমাত্র বাঙালিরই। তার উপর দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩ এ বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। তবে আইন-ইতিহাসের দায়কে অনেকটা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পুরোপুরি ইংরেজি নির্ভর হয়ে উঠছে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। 

বাইরের সাইনবোর্ড-বিলবোর্ডের মতো পত্র-পত্রিকার বিজ্ঞাপনেও বাংলা এড়িয়ে চলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। বিষয় হিসেবে বাংলা পড়ানো হয় হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইটে ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় লেখা নাই। ছাপ নেই দাপ্তরিক কাগজপত্রগুলোতেও। যদিও একই চিত্র সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইটেও। 

নাম থেকে দাপ্তরিক— কাজ সবখানে উপেক্ষিত বাংলা

২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এক আদেশে দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বরপ্লেট, সরকারি দপ্তরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেন। আদালতের আদেশের সূত্র ধরে ২০১৮ সালের শুরুর দিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় থাকা ইংরেজি বা মিশ্র শব্দ ব্যাবহার করে লেখা সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ৭ দিনের মধ্যে সরিয়ে নিতে গণবিজ্ঞপ্তিও দিয়েছিল ডিএনসিসি। হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশনে (১৬৯৬/২০১৪) দেয়া আদেশে বলা হয়, সব প্রতিষ্ঠানের (দূতাবাস, বিদেশি সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র ব্যতীত) নামফলক, সাইনবোর্ড-বিলবোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক। তবে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার সবকিছুতে ইংরেজিই অনেকটা একমাত্র ভাষা।

ইউজিসির পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের বাংলা শেখানো এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করে তুলতে ২টি কোর্স বাধ্যতামূলক করে দিয়েছি। সে হিসেবে অন্তত ৩ ক্রেডিট পড়াতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, আমাদেরকে অবশ্যই মাতৃভাষায় ফিরে আসতে হবে--ইউজিসি সচিব

অন্যদিকে, দেশের সবক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ করা হয় ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ।  সে আইনের ৩ এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘‘এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস-আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার‌্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে। এই ধারা মোতাবেক কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে’’।

তবে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পুরোপুরি উল্টো প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের করা আবেদন অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে লিখতে হয় ইংরেজিতে। বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাংলায় লেখা আবেদনপত্র দাপ্তরিকভাবে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি দক্ষতা বা যোগ্যতার ঘাটতি হিসেবে দেখা হয়। ১১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আংশিকভাবে বাংলায় দাপ্তরিক কার্যক্রম চালানো যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিডিয়ার জন্য পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আর কিছু নোটিশ প্রকাশ করা হয় বাংলায়। বাকি দাপ্তরিক কার্যক্রম বাধ্যতামূলকভাবে ইংরেজিতে করতে হয়।

বাংলা পড়ার শিক্ষার্থী নাই
ইউজিসি সূত্রে জানা যাচ্ছে, দেশের ১১৩ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৮টিতে বাংলা পড়ানো হয়। বাংলা বিভাগ থাকার দাবি করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে- সেন্ট্রাল উইমেন্স, এশিয়ান, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, লিডিং, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ, সাউথইস্ট, প্রাইম, নর্দান, শান্ত-মারিয়াম, উত্তরা, ইউনিভার্সিটি অব লিভারেল আর্টস, সোনারগাঁও, চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার, রাজশাহীর নর্থবেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল, শেখ ফজিলাতুন নেছা, সিসিএন, খুলনার নর্দান এবং কুষ্টিয়ার রবীন্দ্রমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়। 

তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলা বিভাগ থাকার দাবি করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে হাতেগোনা ৫-৬টি ছাড়া বাকিগুলোতে বাংলা বিভাগের অস্তিত্ব নেই। আবার যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু আছে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটিতে শুধু স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। প্রকৃতপক্ষে স্নাতক পর্যায়ে বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনা করার মতো শিক্ষার্থী পায় না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সবত্র মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পূর্ণ কমিশন সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যতটা সম্ভব মাতৃভাষায় পাঠদান করা প্রয়োজন। এজন্য আলোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে--সৌমিত্র শেখর

আবার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষার্থী সংকটে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে তাদের বাংলা বিভাগ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাকরির বাজার সীমিত তাই টাকা খরচ করে পড়তে চায় না শিক্ষার্থীরা। একই কারণ দেখিয়ে বাংলা বিভাগ পরিচালনা করতে চায় না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। 

বেসরকারি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের বাংলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক শামীম রেজা বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে একটা অনাগ্রহ আছে যেটার কারণ আমরা নিজেরাই। বিভিন্ন জাতীয় দিবস থেকে শুরু করে সবকিছুতে একটা অনাগ্রহ লক্ষ্যনীয়।  বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অন্যান্য বিভাগের তুলনায় বাংলায় শিক্ষার্থী পাওয়া আশাব্যঞ্জক বলেও জানান তিনি।

বাধ্যতামূলক বাংলার বেহাল চেহারা

বর্তমানে উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার লালন ও বাঙালি জাতীয় মূল্যবোধ বৃদ্ধিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার অংশ হিসেবে সবার জন্য আবশ্যিক ১০০ নম্বরের একটি বাংলা কোর্স চালু আছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। চালু করার সময় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দিক থেকে শিক্ষার্থীদের বাংলা শেখানোর কারিকুলাম বলা হলেও শিক্ষাবিদরা সেটাকে ‘সংক্ষিপ্ত সিলেবাস’ হিসেবে মূল্যায়ন করতে চান।

দুই ভাগে বিভক্ত সে সিলেবাসে বাংলা ভাষা অংশে রাখা হয়েছে ধ্বনি, ধ্বনির উচ্চারণ ও বানান। আর ভাষার অংশ হিসেবে রাখা হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলা ভাষা, বিশ্বায়নের কয়েকটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর রচনা। আর সাহিত্য অংশে আছে কয়েকটি কবিতা, প্রবন্ধ আর ছোটগল্প। তবে এই সিলেবাস থেকে শিক্ষার্থীদের শিখনফল বা অর্জন কী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে শিক্ষাবিদদের মধ্যে। আবার বাধ্যতামূলক সে কোর্স পড়ানোও হয় অনেকটা দায়সারাভাবে। 

কথা হয় রাজধানীর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তারা বলছেন, ব্যাচের বন্ধুদের একসাথে  বান্দরবান সফরকে বাধ্যতামূলক বাংলা র্কোসের অংশ হিসেবে চালিয়ে নিয়েছেন তারা। সফরের জানাশোনা থেকে এসাইনমেন্ট জমা দিতে হয়েছে তাদের। তবে এ সফরের সাথে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সম্পর্ক বুঝতে পারার বিষয়ে সন্দিহান তারা। একই চিত্র বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। সরকারি নির্দেশনা থাকায় দায় সারতে বাধ্য হয়ে বাংলাকে সাথে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

পরবাসে বাংলা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বেশিরভাগেই শ্রেণি কার্যক্রমে শিক্ষকদের বাংলায় পাঠদান বা বক্তৃতা নিয়মবহির্ভূত। এছাড়াও মোটামুটি সবকটি  বিশ্ববিদ্যালয়েই বাংলা ভাষায় উত্তর লেখা নিষিদ্ধ। সভা-সেমিনারের পাশাপাশি সহপাঠ্যক্রমিক কিংবা সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে যেসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়; তার সঞ্চালনা থেকে বক্তব্য উপস্থাপন, ব্যানার সবটা জুড়েই ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয় ইংরেজি। শিক্ষার্থীরা বলছেন, এসব দেখে মনে হতে পারে এ যেন স্বদেশের বুকে একখণ্ড ইউরোপ।

এ বিষয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সবত্র মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পূর্ণ কমিশন সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যতটা সম্ভব মাতৃভাষায় পাঠদান করা প্রয়োজন। এজন্য আলোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সচিব ড. ফেরদৌস জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা ইউজিসির পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের বাংলা শেখানো এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করে তুলতে ২টি কোর্স বাধ্যতামূলক করে দিয়েছি। সে হিসেবে অন্তত ৩ ক্রেডিট পড়াতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, আমাদেরকে অবশ্যই মাতৃভাষায় ফিরে আসতে হবে। শিক্ষার্থীদের যা কিছু শিখাতে চাই, বুঝাতে চাই তা মাতৃভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষায় সেভাবে বুঝানো সম্ভব না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। এটা তাদের বুঝা উচিত। এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সবাইকেই এগিয়ে আসার আহ্বান ইউজিসি সচিব।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence