সৃজনশীলতা দেখিয়ে ঢাবি ছাড়তে হয় সৈয়দ হককে

সৈয়দ শামসুল হক
সৈয়দ শামসুল হক  © টিডিসি ফটো

উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে স্ববিরোধী হতে পারেননি সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক। প্রথাগত বিদ্যাভ্যাসকে পাশ কাটিয়ে ধরেছেন সৃজনশীলতার পথ। তবে সে পথে হাঁটলে যে আর স্বকীয়তা থাকে না। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ছাত্রত্ব বিসর্জন দিতে হয় থাকে। কিন্তু বিশ্বপাঠশালার অফুরন্ত সবক নিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন নিজেকে। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়ে হয়েছেন বিশ্বের ছাত্র। বেঁচে থাকলে হয়তো সৃজনশীলতায় আরো ছাড়িয়ে যেতেন নিজেকে। কিন্তু মরণশীলতার অনিবার্য টানে তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই।

আজ ২৭ ডিসেম্বর, তাঁর জন্মদিন। ১৯৩৫ সালের আজকের এই দিনে কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ শামসুল হক। শুভ জন্মদিন সব্যসাচী লেখক, কথাশিল্পী, কবি সৈয়দ হককে।

১৯৫৭ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র তিনি। কয়েকদিন ধরেই শিক্ষক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন জন মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ পড়াচ্ছিলেন। একদিন হঠাৎ করেই ওই কাব্যেরই একটি দিক নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের লিখতে দিলেন। সঙ্গে দিলেন সহায়ক কিছু বইয়ের সূত্র; সেখান থেকে নেয়া তথ্যের আলোকেই লিখবেন শিক্ষার্থীরা। সবই ঠিক ছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো সৈয়দ হকের বেলায়। শিক্ষকপ্রদত্ত সূত্রের পরোয়া করলেন না তিনি। লিখলেন নিজের বোধবুদ্ধি ও মেধা খাঁটিয়ে। যার ফল মারাত্মক হলো। খাতা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন শিক্ষক। বললেন, ‘তুমি আমার পরামর্শমতো সূত্র ব্যবহার করোনি, উদ্ধৃতি দাওনি, লিখেছ নিজের মতো করে।’

ইংরেজিতে তিনি সৈয়দ হককে বললেন, ‘..অ্যান্ড ইফ ইউ গো অন লাইক দিস, ইউ ক্যান নট হোপ টু গেট আ ফার্স্ট ক্লাস ইন ইয়োর ফাইনাল!’ (যদি এভাবেই চলতে থাকো, ফাইনালে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার আশা ছেড়ে দাও)। শিক্ষকের এমন কথায় ছাত্র তাৎক্ষণিক উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ফার্স্ট ক্লাসের জন্য আসিনি। ক্লাস কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে শেখায় না। আপনার অনুমতি পেলে আমি কি এই মুহূর্তে আপনার ক্লাস এবং বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করতে পারি?’ এভাবেই স্নাতক পাসের আগে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাপ্তি টানেন সৈয়দ শামসুল হক। [তথ্যসূত্র: বিশ্ব যাঁর বিশ্ববিদ্যালয়- পিয়াস মজিদ]

সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। সেখানে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলে। ১৯৫০ সালে গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

বাবার ইচ্ছা ছিল তাঁকে তিনি ডাক্তারি পড়াবেন। বাবার এ রকম দাবি এড়াতে তিনি ১৯৫১ সালে বম্বে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি বছরখানেকের বেশি এক সিনেমা প্রডাকশন হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। পরের বছর দেশে ফিরে এসে জগন্নাথ কলেজে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী হিউম্যানিটিজ শাখায় ভর্তি হন। কলেজ পাসের পর ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তীতে স্নাতক পাসের আগেই সেখান থেকে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে আসেন।

এর কিছুদিন পর তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’ প্রকাশিত হয় । সৈয়দ হক সাহিত্যসাধনার জন্য বহু পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার ১৯৬৬, একুশে পদক ১৯৮৪, চিত্রনাট্য, সংলাপ রচনা ও গীতিকার হিসাবে বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ইত্যাদি।

ফায়জুর রহমান লিখেছেন, সৈয়দ হকের গল্পে উঠে এসেছে সকল শ্রেণিপেশার মানুষের জীবনচিত্র। বয়ানের ঢং, বিষয় ও প্রকরণের বৈচিত্র্যে গল্পগুলো যেমন পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, তেমনি আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে বিস্তর। ভুলভাবে সমালোচিতও হয়েছে বারবার। তবুও তাঁর ছন্দময় গদ্যের আলপথে হেঁটে পাঠক যখন গল্পে প্রবেশ করে, তখনই তাঁর গল্প বলার গতি ও ভঙ্গির মায়ায় পড়ে যায়। আর সে মায়াময় পথে তিনি বাক্য থেকে বাক্যে গড়িয়ে নেন পাঠককে। ক্রিয়াপদের নিপুণ স্থাপনে পাঠককে দোলা দেন কখনো এখানে কখনো ওখানে।

সৈয়দ হকই আমাদের শিখিয়েছেন গল্পে ক্রিয়াপদের বিবিধ ব্যবহার। ক্রিয়াপদের নিত্যবৃত্ত বর্তমান কালরূপ, সাধারণ অতীত কালরূপ ও পুরাঘটিত অতীত কালরূপের ব্যবহার দেখিয়েছেন গল্প কথকের জনপদে দাঁড়িয়ে। পথপ্রদর্শকের ভূমিকায়।

শুধু কি ক্রিয়াপদের ব্যবহার? শব্দের সচেতন ব্যবহারে, গল্পের কাঠামোগত বৈচিত্র্য, বিষয়ভাবনার দুঃসাহসিকতা ও অনন্য উপস্থাপনশৈলীর মাধ্যমে একনিষ্ঠ জীবনপাঠে এগিয়েছেন তিনি। নাগরিক জীবনযন্ত্রণার নানা অভিক্ষেপ, মধ্যবিত্তের অস্তিত্বের অভিনব সংকট, জাতিসত্তার ক্রম জাগরণ, মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলনের ঘাত-প্রতিঘাতে সমকালীন জীবনচেতনা তাঁর গল্পকে করেছে বর্ণময়। তাঁর গল্প বলার ঢংয়ে সময়ের ক্যানভাসে সাধারণের জীবনকে আঁকতে গিয়ে, তাদের ভাষায় বলতে গিয়ে, আন্তরিক ও সাবলীল বর্ণনায় আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার করেছেন নিপুণভাবে। যে অঞ্চলের গল্প লিখেছেন, ঠিক সেই অঞ্চলের ভাষা বলেছেন, শুদ্ধতার সাথে। সবচেয়ে বড় বিষয়, তাঁর গল্পের ভাষাশৈলী পরবর্তী গল্পের সাথে মিল নেই; যার মাধ্যমে বোঝা যায় তিনি শব্দ প্রয়োগে সচেতন ছিলেন। যার ব্যাখ্যা তিনিই দিয়েছেন : ‘চিত্রকর কত মাধ্যমেই না ছবি আঁকেন। কোনো ছবি জল রঙে, কোনো ছবি তেল রঙে, কোনোটি বা শুধু কালি ও কলমে। লেখকেরাও অবিকল তাই। একেক গল্পের জন্য একেক ধরনের বাক্য গঠন শব্দচয়ন তাকে ভেবে নিতে হয়। গল্প আর ভাষা’।

সৈয়দ শামসুল হক নিজেই বলেছেন, দু’এক জায়গায় লিখেছেনও, লেখকমাত্র খুনি। না, হাতে তীক্ষ্ম তরবারি নিয়ে কারও গলায় চালিয়ে দেন না গল্পকার, ফিনকি দিয়ে বের হয় না টাটকা রক্ত। কিন্তু গল্পকার তবুও খুনি। গল্পকার কেন খুনি? পাঠকের মনের আস্তিনে লুকিয়ে রাখা রিরংসাকে গল্পকার বের করে আনেন চাতুর্যের ঘোড়ায় চড়ে, চরম দক্ষতায়, নিমিষে পাঠককে নিয়ে যান রক্তমাখা তেপান্তরের মাঠে। দাঁড় করিয়ে দেন উন্মুক্ত কৃপাণের সামনে, যে কৃপাণ একদিন নিজেই ধার দিয়েছিলেন, অন্যকে বধ করবার জন্যে!

২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প তথা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য সৈয়দ হককে ‘সব্যসাচী লেখক’ বলা হয়। যিনি মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান।